উত্তাল মার্চ : তেইশ মার্চ ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস : আমাদের প্রতিরোধ দিবস : একাত্তোরের স্মৃতি কথা

March 27, 2025,

মুজিবুর রহমান মুজিব : তেইশে মার্চ একাত্তোর ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের “প্রজাতন্ত্র দিবস” রিপাবলিক ডে। সাতচল্লিশ সালের চৌদ্দ আগস্ট জন্ম নেয়া, পাকিস্তানী পচিশ বৎসরের শাসনামল এই বাংলার বাঙ্গাঁলিদের প্রতি ছিল বৈষম্য মূলক আচরন ফলতঃ পূর্ব পশ্চিমের মানষিক দুরত্ব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে এই অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিব প্রনীত প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসনের দাবী সম্বলিত ছয়দফা কর্মসূচীর প্রতি নিরংকুশ সমর্থন জ্ঞাপন করেন উভয় পরিষদে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করলেও পাকফৌজি প্রেসিডেন্ট লেঃ জেঃ আগামোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রতিনিধি তথা নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে মুজিব ভূট্ট আলোচনার নামে কাল ক্ষেপন ও টাল বাহানা করতে থাকেন। মার্চ মাস থেকেই শুরু হয় অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন। আমি তখন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে মাষ্টার্স ফাইন্যাল এর ছাত্র। ষাটের দশকের শুরু থেকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে দায়িত্বে নেতৃত্বে ছিলাম- প্রথমে মহা বিদ্যালয় শাখা অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্র লীগের সভাপতি ছিলাম। আমার দুঃসাহস, সাংগঠনিক দক্ষতার কারনে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেক নযরে ছিলাম। আমার ‘ছ’ ফুটি দীর্ঘ দেহ, বাবরি চুল আকর্ষনীয় গোফ সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করত। নেতাদের মধ্যে কষ্ট সহিষ্ণু ও তাত্বিক, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্টার গোপন সংঘটন “নিউ ক্লিয়াসের” জনক সিরাজুল আলম খান, সুদর্শন ও সুবক্তা আশম রব, শাহ জাহান সিরাজ প্রমুখ খুব স্নেহ করতেন। আমাদের দীর্ঘ পথপরিক্রিমায় আমাদের মধ্যে দর্শন গত ভাবে মত পার্থক্য হলেও মনোমালিন্য কিংবা সম্পর্ক নষ্ট হয় নি। একাত্তোরের উত্তাল মার্চে ঢাকার রাজনীতিতে টাল মাটাল অবস্থা। সন্ধ্যা হলেই কার্ফূ জারী হত। আমরা হলও নীলক্ষেত এলাকার একদল কর্মি দাদা সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে সন্ধ্যা নামলেই “ইয়াহিয়ার ঘোষনা মানিনা-মানব না-সান্ধ আইন প্রত্যাহার কর”  ইত্যাদি শ্লোগান সহ ভার্সিটি এলাকায় বিক্ষুভ মিছিল করতাম। সাতই মার্চ একাত্তোর রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবের জনসভা। রাজধানী ঢাকায় রাজনৈতিক অঙ্গঁনে বলা বলি হতে লাগল নেতা ঐ দিন দেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করবেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে যাবে। দাদা সিরাজুল আলম খাঁন আমাকে অনেক পোষ্টার লিফলেট এবং কতেক মৌখিক দিক নির্দেশনা সহ মৌলভীবাজার পাঠিয়েদিলেন। আমি এখানে এসে সদ্য প্রাক্তন সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে মহকুমা ছাত্রলীগকে নিয়ে আন্দোলনে সংগ্রামে শরিক হই। তখন মহকুমা ছাত্রলীগের নব নির্ব্বাচিত সভাপতি অনলবর্ষি সুবক্তা-সুদর্শন দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী এবং সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম মুকিত (বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুক্তি যোদ্ধা। অকাল প্রয়াত)। তেইশে মার্চ, রবসিরাজ সিদ্দিকী মাখনের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, তেইশে মার্চকে পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে “প্রচেষ্ট-ডে” প্রতিরোধ দিবস ঘোষনা দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচী ঘোষনা করেন। যথারীতী মৌলভীবাজারে ও প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। চৌমুহনা চত্তরে ঐ দিন বিকালে ছাত্র যুবজনতার মিছিলে গগন বিদারী আওয়াজ উঠে “সব কথার শেষ কথা বাংলার স্বাধীনতা, স্বাধীন কর, স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, দুই চারটা মারুয়াধর সকাল বিকাল নাস্তা কর” ইত্যাদি। ঐ দিন মহকুমা ছাত্রলীগের নব নির্বাচিত সভাপতি দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং ছাত্রলীগের সম্পাদক নুরুল ইসলাম মুকিতের সঞ্চালনায় বিশাল ছাত্র জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে আমি পাকিস্তানী জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি পুড়াই, বাঙ্গাঁলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবের ছবি উঠাই, চান তারা খচিত পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে লাল সবুজের স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠাই। তখন মোবাইল ছিল না, ব্যক্তি গত ক্যেমেরারও এত প্রচলন ছিল না, চৌমুহনার দোতলায় ছিল মুক্তা ফটো ষ্টুডিও। পরবর্তী পর্য্যায়ে আমি দেখেছি আমার হাতে পাকিস্তানের পতাকা পুড়ছে আর লাল সবুজের পতাকা উড়ছে।

মূর্হুমূহু শ্লোগানে শ্লোগানে সেদিন চৌমুহনা চত্তর মুখরিত ছিল। এই ছবি দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাঞ্জাবিরা গুন্ডা মুজিব ক্যাঁহা হায় উসকা পাতা বাতাও বলে আমার শ্রদ্ধেয় স্যার প্রফেসর বিমল কান্তি ঘোষ সহ অনেককেই ঝুলুম নির্যাতন করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে রাষ্ট্র দ্রোহিতার অপরাধে আমার এবং সভার সভাপতি দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী ও সভার সঞ্চালক নুরুল ইসলাম মুকিতের ফাঁসি কিংবা যাবৎজীবন কারাদন্ড হত। পরদিন দেখা ও জানা গেল দেশের সর্বত্র “প্রতিরোধ দিবস” উদযাপিত হয়েছে, স্বাধীন বাংলার  পতাকা উড়ানো হয়েছে- অবশ্য আমাদের ক্যেন্টনমেন্ট সমূহ আন্দোলনের আওতাভূক্ত ছিল না- সেনা নিবাস সমূহে পতপত করে পাকিস্তানী পতাকা উড়েছে। ২৪শে মার্চ আমাদের কমলগঞ্জ থানা এলাকা থেকে খবর এলো সেখানকার শক্তিশালী মুসলিমলীগ এবং স্বাধীনতা বিরোধী চক্র প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচী পালন করতে দেয় নি, স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠানোও সম্ভব হয় নি। সঙ্গেঁ সঙ্গেঁ আমি পরদিন পচিশে মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন এবং প্রতিবাদ সভার তারিখ দিলাম- যথা সময়ে আমাদের নিকট প্রতিবেশী থানা কমলগঞ্জ গেলাম। ঐ দিন বিকালে “চলচল কমলগঞ্জ চল” আওয়াজ তুলে আমি ছাত্রলীগ নেতা দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী, আওয়ামী স্বেচ্ছা সেবক বাহিনীর দুই নির্ভীক সৈনিক পরবর্তী পর্য্যায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার একান্তই আপন ও ঘনিষ্ট জন আব্দুল মালিক ভাই এবং আব্দুল মছব্বির এশ্বাদ মিয়া ও কর্মি বাহিন সহযোগে সমশেরনগর যাই। সাবরেজিষ্টারী অফিস মাঠে বিশাল জন সভায় ভাষন দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। সেই সভানুষ্টান আয়োজনে নেতা গফুর হিসাবে পরিচিত আব্দুল গফুর এবং ছাত্রলীগ সভাপতি ছাত্র নেতা খালিকুর রহমান খালিক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন। এবার ২৩শে মার্চ আনুষ্টানিক ভাবে একটি স্বরন সভা এবং তৎকালীন পতাকা উত্তোলক বর্তমানে জেলা আইনজীবী সমিতির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান মুজিব কে সম্মাননা ক্রেষ্ট প্রদান করেন সভানুষ্টানের আয়োজক গনতন্ত্র মঞ্চের নেতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক এম,এ, রহিম। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সফল সম্পাদক সিনিওর আইনজীবী এডভোকেট বদরুল হোসেন ইকবাল এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মত বিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রবীন ব্যবসায়ী এস,টি করিম, সিনিওর এডভোকেট ফয়সাল আহমদ, সিনিওর এডভোকেট আবুল কাশেম, জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা আহসান উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। প্রধান অতিথির ভাষনে এডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব তাকে সম্মানিত করার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ব্যতিক্রমি সভায় বিপুল শিক্ষক, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও সুধীজন উপস্থিত ছিলেন। একাত্তোরের তেইশে মার্চের কার্য্যক্রম ও কর্ম্মসূচী আমার স্মৃতিতে এখনও সমুজ্জল। আন্দোলনে সংগ্রামের সকল শহীদানের উজ্জল স্মৃতির প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী ও অমর শহীদানের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।

মুক্তিযোদ্ধা : এডভোকেট হাইকোর্ট। সভাপতি শহীদ জিয়া স্মৃতি পাঠাগার, মৌলভীবাজার জেলা শাখা।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com