তনু, রিশা, আফসানা, নিতু, খাদিজা এরপর কে?

October 6, 2016,

এহসান বিন মুজাহির॥ সোহাগি জাহান তনু, সুরাইয়া আখতার রিশা, আফসানা, নিতু, খাদিজা এরপর কে?   কোথায় ওত পেতে আছে মানুষরুপী হিং¯্র পশুরা! এই অমানবিক ও বর্বর আক্রমণের শেষ কোথায়? ওবায়দুল, বদরুলদের পিপাসা মিটবে কবে? এই অন্ধকার সময়ের অধ্যায় শেষ হয়ে আলো আসবে কবে? নাকি কোনোদিনই আর দেখা মিলবে না সেই আলোর! আমরা শুধু দিনের পর দিন অসহায়ের মতো লক্ষ করছি, যে সমাজে, যে রাষ্ট্রে আমরা বসবাস করছি তা কোনোভাবেই আর নারীদের জন্য, ইমাম-মুআজ্জিনসহ রাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের জন্যই নিরাপদ নয়! বর্বরতা, অমানবিকতা ও হত্যার মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু  ঘটে যাওয়া এসব ঘটনসমুহের সঠিক তদন্ত, আসামিদের গ্রেপ্তার করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা নিয়ে জনমনে বহু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে!
ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা, মাদারীপুরের কালকিনির নবম শ্রেণির ছাত্রী নিতু মন্ডলের পর এখন একই ধরনের ঘটনার শিকার হলো সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস। গত পাঁচ বছর ধরেই খাদিজার প্রেম প্রত্যাশী ছিলেন বদরুল। কিন্তু বারবার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় ক্ষোভে সোমবার বিকালে খাদিজা নার্গিসের ওপর নৃশংস হামলা চালায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শাবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগ সহসাধারণ সম্পাদক বদরুল আলম।
৩ অক্টোবর সোমবার বিকেলে সিলেট এমসি কলেজে কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দিয়ে বেরোনোর সময় কলেজের পুকুর পাড়ে খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কোপান বদরুল। বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র।
প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় কলেজ ছাত্রী খাদিজার ওপর অমানবিক বর্বর আক্রমণ চালান শাবিপ্রবি শাখার ছাত্রলীগ সহসাধারণ সম্পাদক বদরুল আলম। নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষরুপী হিংস্র পশুদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধিই পাচ্ছে। এসব উন্মাদ, খুনি, লম্পট, ধর্ষকরা প্রকাশ্যে বিভিন্ন ভর্সিটির ক্যাম্পাসসহ পথে-ঘাটে নারীদের উপর বর্বর আঘাত হানছে। আক্রমণের সময় সন্ত্রাসী-বখাটেরা অ্যাসিড প্রয়োগ, ছুরি, দা, চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করছে। আমানবিক আর বর্বর আক্রমণের শেষ কোথায়! এই নৃশংস আক্রমণের ভিডিও প্রকাশ হয়ে ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ঘটনার একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, ঘটনার সময় পাশে অনেকেই উপস্থিতি ছিলেন। তবে বদরুলের হিংস্র রূপ দেখে এবং সে ছাত্রলীগ নেতা হওয়ায় কেউ তাকে বাধা দিতে সাহস পায়নি। ফলে সন্ত্রাসী বদরুল খাদিজাকে মাটিতে ফেলে দীর্ঘ সময় ধরে কোপানোর সুযোগ পায়। শত ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত থেকেও একজন ছাত্রলীগ নেতার আক্রমণ থেকে একজন নারীকে রক্ষা করতে পারলো না; ভয় পেলো একজনের ছাত্রলীগ নেতাকে! মনবতা ও নৈতিক অবক্ষয় আজ লোপ পেয়েছে! একজন কোপ খাবে আর বাকিরা ভিডিও করবে এটাই যেন এসমাজের নিয়ম! এর বাহিরে আর কোন নিয়ম বা দায়বদ্ধতা নেই! থাকলে হয়তো সবাই সম্মিলিতভাবে নরপশুর হামলা থেকে খাদিজাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতো! ঘটনার সময় খাদিজাকে বাঁচাতে ভয়ে কেউ সামনে যায়নি। বদরুল মটর সাইকেলে উঠার সময় কিছু মানুষ এগিয়ে এসে তাকে আটক করে গণপিঠুনি দেয়!
বদরুলের চাপাতির আঘাতে খাদিজার মস্তিস্ক ভেদ করে তার মগজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মারাত্মক জখমপ্রাপ্তখাদিজা এখন ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক! সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। গত মঙ্গলবার তার মাথায় অপারেশনের পর চিকিৎসকরা তাকে ৭২ ঘন্টার পর্যবেক্ষণে রাখেন। এই লেখাটি যখন লেখছি তখনও খাদিজা হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে। জানি না সে বাঁচবে কিনা। মহান আল্লাহর কাছে কাছে দোয়া করি সে বেঁচে থাকুক।
দিনপুরে একটি ভার্সিটির ক্যাম্পাসে ছাত্রী খাদিজার ওপর এই নৃশংস হামলা! নারীবাদিরা কেনো আজ নিশ্চুপ! খাাদিজার বেলায় কলামিস্টদের কলাম কেনো চোখে পড়ছে না! অপরাধীকে বদরুলকে দৃস্টান্তমূলক শাস্তির জন্য মিডিয়ায় কেনো তেমন মায়াকান্না নেই! দোষী বদরুলকে আড়াল করতে কেউ কেউ তার পক্ষে কলম ধরছেন, প্রতিবেদন লেখছেন! একজন নারীকে এভাবে প্রকাশ্যে কোপানোর পরও নারীনেত্রীদের সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে না! ইডেন কলেজের সাধারণ ছাত্রীদেরকে ছাত্রলীগ তাদের নেতাদের মনোবাসনার জন্য উপঢৌকন হিসেবে পাঠালেও তাদের চেতনা ঘুমিয়ে থাকে, বর্ষবরনের দিনে ছাত্রলীগ নারীর শ্লীলতাহানি করলেও তাদের চেতনা ঘুমিয়ে থাকে, ছাত্রলীগ নেতা ধর্ষণের সেঞ্চুরি করলেও তাদের চেতনা ঘুমিয়ে থাকে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদেরকে নামাজ পড়া কিংবা হিজাব পড়তে বাধা দিয়ে নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলেও তাদের চেতনা ঘুমিয়ে থাকে, রাস্তায় প্রকাশ্যে নারীকে কোপালেও তাদের চেতনা ঘুমিয়ে থাকে!
বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮-০৯ সেশনের অর্থনীতি বিভাগের অনিয়মিত শিক্ষার্থী। ৮ মে ঘোষণা করা ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে তাকে সহ সম্পাদক হিসেবে রাখা হয়। খুনি বদরুল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহসম্পাদকের মত এত বড় নেতা হওয়া স্বত্বেও তারা তাকে বখাটে হিসেবে উপস্থাপন করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। অথচ বিরোধী কোনো ছাত্রসংগঠনের বেলায় সংগঠনের সাথে দূরতম কোনো সংশ্লিষ্টতাকেও তারা ফলাও করে প্রচার করে! নিষিদ্ধের দাবিতে হাঁকডাক শুরু করে। অথচ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের এক দশমাংশও বাংলাদেশের কোনো ছাত্রসংগঠন করেনি। নারীধর্ষণ, টেন্ডারবাজী, হলদখল, ভর্তি নিয়ে বাণিজ্যসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যেখানে ছাত্রলীগ সম্পৃক্ত নয়! এভাব ছাত্রলীগ এবং বখাটে সন্ত্রাসীরা আর কত নৃশংস আক্রমণের করবে, প্রাণঝড়াবে কত মা-বোনের?
এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় নিতু ম-ল নামে ১৫ বছরের এক কিশোরীকে একই গ্রামের মিলন ম-ল নামে এক বখাটে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর মাগুরা সদর উপজেলার সাংদা লক্ষ্মীপুর গ্রামের ৭ম শ্রেণির ছাত্রী হ্যাপী (১২) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। এরআগে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে ছুরিকাঘাতে মারাত্মক জখম করে ওবায়দুল খান নামে আরেক বখাটে। দুই দিন চিকিৎসার পর রিশার মৃত্যু হয়। রিশাকে দীর্ঘদিন ধরে মোবাইলে ও স্কুলে যাওয়া-আসার পথে উত্ত্যক্ত করে আসছিল এই বখাটে। তার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় অবশেষে ২৪ আগস্ট রিশার পরীক্ষা শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে স্কুলের সামনেই ওবায়দুল রিশাকে ছুরিকাঘাত করে। গত মাসের মাঝামাঝিতে পুরান ঢাকায় আজিমপুর সাফির আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী এক বখাটের হামলায় আহত হয়। কলেজে আসা-যাওয়ার পথে ইমন আলী নামে বখাটে সেই কলেজছাত্রীকে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। কিন্তু রাজি না হওয়ায় মেয়েটিকে মারধর করে ইমন তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। ফিল্মি স্টাইলে এ ধরনের ইভটিজিং, নারী নির্যাতন ও ধষণের ঘটনা সামাজিক অবয়ের চিত্র প্রকাশ করে।
একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, একের পর এক নারী প্রাণ হারাচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তার তো কোনোই প্রতিকার হচ্ছে না। তনুর হত্যাকারীদের আজও ধরা যায়নি। ধামাচাপা পড়ে গেল মিতু হত্যার বিষয়টিও। আফসানার নামও আর কেউ উচ্চারণ করছে না। রবিন তো নাকি ভারতেই পালিয়ে গেছে। কারণ যখন কোনো অপরাধ করে কেউ পার পেয়ে যায় তখনই নতুন আরো অনেক অপরাধীর জন্ম হয়। কারণ তখন সম্ভাব্য অপরাধী দেখে কই কিছুই তো হলো না। তখন সে আস্ফালন করার সুযোগ পায়, সে অপরাধ করতে সাহসী হয়। তার উপর যদি সে হয় কোনো রাজনৈতিক দলের লোক তাহলে তো আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।  প্রশ্ন হলো, আর কত অপকর্ম করলে বা কতজনকে প্রকাশ্যে কোপালে বন্ধ হবে এসব জঘন্য কার্যক্রম! অপরাধীরা কি এতই শক্তিশালী? কেনো তাদের গ্রেফতার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হচ্ছে না!
হামলাকারী ব্যক্তি যে বা যারাই হোক না কেনো তারা সমাজের সভ্য কোনো মানুষ হতে পারে না। ওরা মানুষরুপী জানোয়ার। ওদের কোনো দল নেই, পরিবার নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। থাকা উচিতও নয়। এদের একমাত্র পরিচয় এরা দুষ্কৃতিকারী, বদমাশ, খুনি। কোনো প্রতিষ্ঠানের, কোনো সংগঠনের, কোনো দলের উচিত নয় এদের দায়িত্ব নেওয়া বা এদের আড়াল করার চেষ্টা করা। বরং খুনি, বদমাশ যে দলেরই, যে প্রতিষ্ঠানেরই হোক তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সহযোগিতা করা উচিত প্রত্যেকের।
সঠিক বিচারের মধ্য দিয়ে এদেশে আইনের নজিরবিহীন শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন যেন অধরা! তনু, রিশা, আফসানা, নিতু পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনা আজ জ্বলন্ত স্বাক্ষী হয়ে আছে! সম্প্রতি খাদিজা আখতার নার্গিস নৃশংসতার মিছিলে নতুন যোগ হয়েছেন। জানি না এঘটনায় খাদিজা পরিবার যথার্থ বিচার পাবে কিনা! তাদেও বেলায় বলা যায় বিচারের বাণী-নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। কথাটি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। এই কথাই তনু, র রিশা, আফসানা, নিতুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ্অনেক দিন আগে ঘটে যাওয়া হত্যা যথার্থ  বিচার বিলম্বিত শুধু হচ্ছে না, বিচার কাঁদছে। বিচার কাঁদে তনুদের মা-বাবা স্বজন শুধু নয়, সারা দেশের বাবা-মায়ের অন্তরে কাঁদে। আর বিচার বিলম্বিত হচ্ছে তদন্তের  ধীরগতি, তদন্ত আটকে যাওয়া, বিষয়টি নানা কারণে আটকে যাওয়া, আবার বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে!   তবে বুকে হাত দিয়ে  জোর গলায় একথা বলতে পপারি-অশ্রুই মজলুম- অসহায়ের সম্বল। আর আছে মহামহীমের দরবারে নিরন্তর প্রার্থনা। নির্মল প্রার্থনা ছাড়া আমাদের আর কিইবা করার আছে? আসুন সোচ্চার হই সন্ত্রাসী বদরুলদের বিরুদ্ধে। দাবি তুলি দৃষ্টান্তুমূলক শাস্তির। তারই সাথে দাবি তুলি অনতিবিলম্বে তনু, নিতু, রিশা, আফসানাদের খুনীদেরও ফাঁসি কার্যকর করা হোক।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com