তিন মাস বন্ধ থাকার পর মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোয় নতুন পাতায় নানা আনুষ্ঠানিকতায় উৎপাদন শুরু

March 24, 2025,

স্টাফ রিপোর্টার : শুষ্ক মৌসুমে টানা তিন মাস বন্ধ থাকার পর ছাটাইকৃত চা গাছে সেচ দিয়ে ও বৃষ্টির ছোয়ায় মৌলভীবাজারের বিভিন্ন চা বাগানে গাছে গাছে আসছে নতুন কুড়িঁ। শুরু হয়েছে চা পাতা চয়ন উত্তোলন।

এতে খুশি চা শ্রমিক ও বাগান মালিকরা। বাগানে বাগানে বইছে আনন্দের হিল্লোল। দোয়া ও পূজাসহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় নতুন পাতা উত্তোলণ করে চা বাগানগুলোতে উৎপাদন শুরু হয়েছে। ২০২৫ সালে চায়ের লক্ষমাত্রা নিধার্রণ করা হয়েছে ১০৩ মিলিয়ন কেজি। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে লক্ষমাত্রার চেয়েও বেশি উৎপাদন হবে বলে জানান চা বিজ্ঞানীরা।

চা প্রকৃতি নির্ভর একটি কৃষিজ পণ্য। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে চায়ের উৎপাদনও ভালো হয়। এর জন্য প্রয়োজন পরিমিত বৃষ্টি ও সূর্য কিরণ। মার্চের শুরুতে কিছু বৃষ্টি হওয়াতে ছাটাই করা চা গাছে আসতে শুরু করেছে নতুন কুঁিড়। বেশ কিছু বাগানে শ্রমিকরা শুরু করেছেন পাতা তোলা।

চা বিজ্ঞানীরা জানান, চায়ের উৎপাদন বাড়াতে চা গাছে প্রুনিং (ছাঁটাই) এর বিকল্প কিছু নেই। এর ফলে চা গাছে প্রচুর পাতা গজায়। চা সংশ্লিষ্টদের কাছে চা গাছের পাতাই হচ্ছে সোনা। এটাকে অনেকে সবুজ সোনাও বলে থাকেন। তাই যত পাতা গজাবে তত সবুজ সোনায় ভরে যাবে দেশ।

২০২৩ সালে ১০৩ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। আর ২০২৪ সালে হয় ৯৩ মিলিয়ন কেজি। যা লক্ষমাত্রার চেয়ে ১০% কম ছিল। বাংলাদেশে নিবন্ধনকৃত ১৬৮টি চা বাগান রয়েছে। পাশাপাশি পঞ্চগড়ে রয়েছে ক্ষুদ্রায়িত অনেক গুলো চা বাগান। পঞ্চগড় ও দেশের ১৬৮টি চা বাগান মিলিয়ে ২০২৫ এর লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৩ মিলিয়ন কেজি।

কমলগঞ্জের শ্রী গোবিন্দ পুর চা বাগানের শ্রমিকরা জানান, ‘চা বাগানে ডিসেম্বরে চা গাছ প্রুনিং করা হয়। এই সময় থেকে বৃষ্টি ছিলনা। বিকল্প ব্যবস্থায় ইরিগ্রেশন সেচ করা হয়েছে। আর মার্চের শুরুতে অল্প কিছু বৃষ্টিপাত পাওয়া গেছে। এর ফলে মার্চ মাসেই চা গাছে পাতা আসতে শুরু করেছে। এর পর মালিক এসে সবাইকে নিয়ে মিলাদ মাহফিল করার পর তারা এখন পাতা তুলছেন।

ন্যাশনাল টি কোম্পানীর পদ্মছড়া চা বাগানের শ্রমিক লক্ষী চাষা ও পূনীর্মা বারাইক জানান, ‘দুই মাসের উপরে পাতা তোলা বন্ধ ছিল। এখন গাছের মুখ খুলছে। সপ্তাহ দশ দিনের মধ্যেই গাছের উপরের অংশে সবুজ ঝাড় বাঁধা শেষ হবে টিপিং এর পর তারা পাতা তুলবেন। এখন চলছে টেপিং ঝুপ বাঁধা এর কাজ।

একই বাগানের বিজয়া গোয়ালা ও মাধবী চাষা জানান, ‘বাগানের ম্যানেজম্যান্ট ও শ্রমিক সবাই মিলে পূজার্চনার মধ্যদিয়ে তারা পাতা তুলা শুরু করেছেন। তিনি বলেন, চা উৎপাদন প্রকৃতি নির্ভর। সারা বছর যেন হাত ভরে পাতা তুলতে পারেন তাই ভগবানের নামে পূজা দিয়ে তারা পাতা তোলা শুরু করেন। এটা তারা প্রত্যেক বছরই করেন।’

মাধবপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক দিপন সিংহ জানান, ‘চায়ের জন্য বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতির পাশাপাশি প্রকৃতির উপরও নির্ভর করতে হয়। চায়ের জন্য মূলত প্রয়োজন পরিমিত বৃষ্টিপাত ও সূর্যের আলো। অনেক জায়গায় ইরিগেশন পৌছানো সম্ভব হয়না। তাছাড়া বর্ষায় যদি অতি বৃষ্টি হয় তাও চায়ের জন্য ক্ষতিকর। আবার প্রচন্ড তাপদাহ হলে তাও ক্ষতিকর। যে কারণে এর জন্য কিছুটা প্রকৃতির উপরতো নির্ভর করতেই হয়। তিনি বলেন, মৌসুমের একেবারে শুরু থেকেই তারা নতুন কুঁড়ি পেয়েছেন। এই জন্য দোয়া মিলাদ মাহফিল ও পূজার্চনার মধ্যদিয়ে তারা এ মৌসুমের কার্যক্রম শুরু করেছেন।’

শ্রীমঙ্গল জেরিন চা বাগানের জিএম সেলিম রেজা জানান, ‘পাতা তোলার শুভ সূচনায় করা হয়েছে দোয়া মিলাদ মাহফিল ও পূজার্চনা। বাগানে পাতা চয়নের কাজ শুরু হওয়ায় ফিরছে প্রাণচাঞ্চলতা। তিনি বলেন, বিগত বছর প্রকৃতিগত কারনে লক্ষমাত্রার চেয়ে প্রায় ৮ থেকে ১০ পার্সেন্ট ঘাটতি ছিল। তবে এ বছর এই ঘাটতি পুরণ হবে বলে তিনি আশাবাদী। তিনি বলেন তার বাগানের শ্রমিকরা আন্তরিকতার সহিত কাজ করছে। ম্যানেজমেন্ট, স্টাফ ও শ্রমিক সবাই টিম ওয়ার্ক করে কাজ করলে নিশ্চই তারা লক্ষমাত্রার চেয়ে বেশি চা উৎপাদন করতে পারবেন। যা গত বছরের ঘাটতি পুষিয়ে নিতেও কাজ করবে।’

বাংলাদেশীয় চা সংসদ সিলেট অঞ্চলের ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যান গোলাম মো. শিবলী জানান, ‘খরা চায়ের বড় একটি প্রতিবন্ধকতা। খরার সময় বৃষ্টি পাওয়া যায়না। এতে গাছ মরে যায় দেখা দেয় বিভিন্ন রোগবালাই। এই সময়ে চা সংশ্লিষ্টদের খুব সর্তক থাকতে হয়। একটি চা গাছ বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবাইকে প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কারণ এক একটি চা গাছ এক এক জন চা শ্রমিক, ম্যানেজার ও স্টাফদের জীবন। তিনি বলেন, খুব বেশি বৃষ্টি পাওয়া যায়নি। বিকল্প ইরিগেশন দিয়ে তারা চা গাছকে প্রাণবন্থ রাখছেন।’

শ্রীগোবিন্দপুর চা বাগানের মালিক ও ন্যাশনাল টি কোম্পানীর পরিচালক মো: মহসীন মিয়া মধু জানান, ‘তিনি তাঁর বাগানের চা গাছগুলোকে সন্তানের মতো পালন করেন। এর জন্য তার বাগানে হেক্টর প্রতি উৎপাদন আশাব্যাঞ্জক। মার্চের শুরুতেই তার বাগানে উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে এ বছর তার মুল লক্ষ কোয়ালিটি চা তৈরী। এই জন্য তিনি তার বাগানে অতিরিক্ত নজরদারী রাখেন। তার বাগান থেকে বিশ্বমানের চা তৈরীর প্রতিশ্রুতি তাঁর।’

আর বাংলাদেশ চা গবেষনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ইসমাইল হোসেন জানান, ‘চা বোর্ড চেয়ারম্যানের নির্দেশে চা গবেষনা কেন্দ্রের সকল কর্মকতার এখন মাঠে কাজ করছেন। কাঙ্খিত লক্ষমাত্রা অর্জনে বছর জুড়েই তারা মাঠে থাকবেন। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে চা গাছের উপরিভাগ ছাঁটাই করা হয়। এই সময়ে চা বাগানের উৎপাদন বন্ধ থাকে। ছাঁটাই এর চার টি ধাপ আছে প্রথম ধাপ হলো লাইট প্রম্ননিং (এলপি) যেখানে আটটি পাতা রেখে কুঁড়ি তুলতে হয়। ২য় ধাপ হলো ডিপ স্কিপ, এ জাতীয় গাছে তিনটি পাতা রেখে কুঁড়ি তুলতে হয়, ৩য় ধাপ মিডিয়াম স্কিপ। মিডিয়াম স্কিপ এর গাছে দুইটি পাতা রেখে কুঁড়ি তুলতে হয়। আর লাইট স্কিপ এ একটি পাতা রেখে কুঁড়ি তুলতে হয়। এই স্কিপ গুলোরও আবার ধাপ রয়েছে ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেক গাছেই এই নিয়মে ছাঁটাই করতে হয়।

আর বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ড. রফিকুল হক জানান, উৎপাদন বৃদ্ধি ও কোয়ালিটি চা তৈরীর জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ড এর চেয়ারম্যান বছর জুড়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা দিয়েছেন। বছর জুড়ে তারা মাঠে থেকে তা বাস্তবায়ন করবেন।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন জানান, ‘উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়েছে। এর জন্য চা বোর্ড থেকে বছর জুড়ে পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। বাগানগুলোতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট, সঠিক সময়ে যেন বাগানে সার পৌছায় তা লক্ষ রাখা, বাগানে বাগানে হাতে কলমে আধুনিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া, চা বিজ্ঞানী ও উন্নয়ন ইউনিটের কর্মকর্তাদেরকে বাগানগুলোর দিকে নিবিড় পর্যবেক্ষনণ রাখাসহ বছর জুড়ে অনেক গুলো পরিকল্পনা রয়েছে। চায়ের মুল্য বৃদ্ধিতে যাতে গুনগতমানের চা তৈরী করা হয় সে বিষয়ে সার্বক্ষনিক নজরদারী থাকবে তাদের। বিশেষ করে উত্তর বঙ্গে। তিনি বলেন, একর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি বাড়াতে হবে। আর একর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে চায়ের উৎপাদন খরচ কমে যাবে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com