শ্রীমঙ্গলে প্রধান শিক্ষক ছাড়াই চলছে ৭০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
এহসান বিন মুজাহির : শ্রীমঙ্গল উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে ৭০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়াই।
২০১৭ সাল থেকে এই শূন্য পদগুলোতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, যা শিক্ষার মানে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের ২২টি পদও শূন্য রয়েছে।
শ্রীমঙ্গলের ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় মোট ১৩৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রধান শিক্ষক না থাকায় ৭০টি বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। এমনকি ৭টি বিদ্যালয়ে কেবল চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মাধ্যমেই প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ফলে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস কার্যালয় সূত্র জানা যায়, শ্রীমঙ্গলে উপজেলায় মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৩৮টি। এরমধ্যে ১৯৭২ সালে জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয় ৬৬টি, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে তিন দফায় জাতীয়করণ করা হয় ৬৯টি বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয় আরও ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এ ১৩৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সুইলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ধোবারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছাত্রাবট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যতরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাচাউন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাত্রিকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলীসারকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তেলিআব্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দূর্গানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জাম্বুরাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কামারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিন্দুরখাঁন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জানাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভৈরবগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর জিলাদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টিকরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামনগর মণিপুরি বস্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাসন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাইটুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চাঁনমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইলামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ধনসিং বস্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বালিশিরা খাসিয়া পুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কামাসিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খোয়াজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আশীদ্রোন নোয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ওয়াজিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রায়পরান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কৃষ্ণরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ববান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাকড়িছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ববানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাজঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিরালা পুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চাতালী চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মির্জাপুর চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাতগাঁও চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালিঘাট চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাকিয়াছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফুলছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিন্দুরখাঁন চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উদনাছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিদ্যাবিল চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেজুরীছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাকড়িছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টিপরাছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভুনবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বৌলাছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইছামতি চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জেরিন চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোহাজেরাবাদ পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হারপাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাজডিহি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লাখাইছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমরাইলছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাড়াউড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভুরভুরিয়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জাগছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিনারপুর চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাজঘাট (লালটিলা বস্তি) চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুটিয়াছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশেলবাড়ি চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জঙ্গলবাড়ী চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হরিণছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বর্মাছড়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এম. আর. খান চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং জুলেখানগর চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এ ৭০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ শুন্য রয়েছে। বাকি ৬৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত প্রধান শিক্ষক রয়েছেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ, একজন সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হলে, তার সময় সীমিত হয়ে যায়। এতে করে তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠদানে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না, যা শিক্ষার মানে প্রভাব ফেলছে। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক না থাকলে শিক্ষকদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা বজায় থাকে না, এমন মন্তব্য করেছেন শিক্ষকরা। তারা জানান, শিক্ষকরা নিজেদের ইচ্ছামতো কর্মব্যস্ততার মাঝে নিয়মিত পাঠদানে মনোনিবেশ করতে পারেন না। এর ফলে শিক্ষার্থীরা যে যথাযথ শিক্ষা পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছে না। বিদ্যালয়ে কার্যক্রমের জটিলতার কারণে শিশুদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ কমে যাচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যত জীবনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক অভিভাবক জানিয়েছেন, শিক্ষক সংকটের কারণে শ্রেণি কক্ষে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের ফলে শিক্ষকরা পাঠদানে মনোযোগ দিতে পারছেন না, যার ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সমস্যা নিয়ে শিগগিরই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকরা, যাতে করে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা স্বাভাবিক পরিবেশে চলতে পারে।
বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি এবং স্থানীয়রা বলছেন, শ্রীমঙ্গলের ৭০টি স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য থাকা, একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে এটি শিক্ষার গুণগত মানে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা উচ্চমানের শিক্ষা লাভে ব্যর্থ হচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তারা সবাই একমত, যে দ্রুত প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা প্রয়োজন। অন্যথায়, এই সমস্যা আরো গুরুতর রূপ নেবে এবং শ্রীমঙ্গলে শিক্ষার মান আরও কমে যাবে।
এমন পরিস্থিতি স্বীকার করে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গলে ৭০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত প্রধান শিক্ষক নেই। এর মধ্যে ৩৫ জনের পদ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলমান, আর বাকি ৩৫টি বিদ্যালয়ে পদোন্নতি জটিলতা ও নিয়োগ স্থগিত থাকার কারণে প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে। ২০১৭ সালের পর থেকে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য থাকার কারণে সহকারী শিক্ষকদের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। অনেক সহকারী শিক্ষককে একই সময়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, যাতে পাঠদান ও প্রশাসনিক কার্যক্রম একসঙ্গে চলতে হচ্ছে। এই কারণে শিক্ষকদের ওপর চাপ বেড়েছে এবং নিয়মিত পাঠদানেও ব্যাঘাত ঘটছে। তিনি আরও বলেন, পদোন্নতি বন্ধ ও প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগ বন্ধ থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত এলেই প্রধান শিক্ষকের পদ পূরণ করা হবে।
মন্তব্য করুন