॥ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী কৃষক নেতা নওয়াব আলী সফদার খাঁন রাজা সাহেবঃ ষোলই জুলাই, মরহুমের মৃত্যো বার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যুর মধ্যবর্তী অন্তবর্তী কালীন সময়ের নাম জীবন। দোলনা থেকে কবর-জন্ম থেকে মৃত্যু কালীন সময়টুকু অনির্ধারিত। অনিশ্চিত। ক্ষনস্থায়ী। মায়াময়, এই সুন্দর পৃথিবী একটি পান্থশালা। এই সরাই খানার মেহমান মানুষ ক্ষনিকের অতিথি। মায়াময় এই পৃথিবী, এই প্রেম ভালবাসা, স্নেহ মমতা, এই ফুল পাখী, এই অপরূপ প্রকৃতি নিসর্গ, দক্ষিনা হাওয়া, এই ধন জনমান, বিত্ত বেসাত, দোকান পাট, মামলা মোকদ্দমা, সর্ব ফেলে, সব ছেড়ে একদিন আমাদেরকে চলে যেতে হবে। একদিন আমাদেরকে চোখ বুঝতে হবে। শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করতে হবে। এক সময় আতর লোবানের গন্ধ বাতাসে উবে যাবে। নতুন কবরের মাটি পুরাতন হয়ে যাবে। উঠবে ঘাস। ফুটবে নাম না জানা ঘাসফুল। স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যাবেন সেই মুর্দা। কিন্তু মায়াময় এই পৃথিবীতে কিছু কৃতীমান লোক খন্ডিত ক্ষনস্থায়ী, এই মানব জীবনে, মানব জাতির কল্যানে এমন সব কাজ করে যান যা পরবর্তী প্রজন্ম স্মরন করেন শ্রদ্ধায়। ভালোবাসায়। আন্তরিকতায়। পৃথিমপাশার জনদরদি জমিদার, “রাজা সাহেব” হিসাবে বিখ্যাত নওয়াব আলী সফদার খান এমনি একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। জনদরদি জননেতা। ১৯১৯ সালেরর ১৬ আগষ্ট থেকে ১৯৭৪ ইং সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত সময় কালে এই ভুবনের বাসিন্দা ছিলেন মহানস্বাধীনতা সংগ্রামী নওয়াব আলী সফদার খান রাজা সাহেব। শৈশব, কৈশোর, পেরিয়ে যৌবনের সোনালী দিন গুলি জননেতা রাজা সাহেব কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতার ত্রান কল্যানে নিবেদন করেছেন। অনেক সুবিধাবাদি অসৎ রাজনীতিবিদ রাজনীতি ও ক্ষমতাকে উপরে উঠার সিড়ি হিসাবে ব্যবহার করেছেন। অসৎ আমলাতন্ত্রকে করায়ত্ব করে আংগুল ফুলিয়ে কলা গাছ হন, ফকির থেকে আমীর হন আর পৃত্থিম পাশার জমিদার এক আলী সফদর খাঁন সমাজ ও রাজনীতির কারণে ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু থেকে জনতার কাতারে নেমে এসেছেন। উপরে থেকে নীচে নেমে এসেছেন। নবাব সাহেব, বড় হুজুর, বড় সাহেব, জমিদার সাহেব, খান সাহেব এর পরিবর্তে তিনি পৃথিমপাশা, বৃহত্তর সিলেট, বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতার কাছে ‘রাজা সাহেব’ রাজা ভাই হিসাবে খ্যাতি ও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। পঞ্চাশ থেকে সত্তোর দশকের বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতা কর্মীদের নিকট নওয়াব আলী সফদর খান ছিলেন কৃষক রাজা- রাজা সাহেব। রাজা ভাই। এই তিন দশকের বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভুবনে রাজা ভাই ছিলেন একজনই। তিনি নওয়াব আলী সফদার খাঁন। পৃথিমপাশা, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার, সিলেটই নয় সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যেই তিনি ছিলেন অতি অভিজাত খান্দানী পরিবারের কৃতি সন্তান। নওয়াব আলী সফদরখানের পূর্ব পুরুষ পার্যশ্য দেশীয় রাজ বংশের এক রাজ পুরুষ সকি সালামত। তার পূর্ব পুরুষ “দানিশমন্দ” খেতাবে ভূষিত ‘দানিশাব্দের’ প্রবর্তক মৌলভী রবি খাঁ, তাঁর পিতা নবাব আলী হায়দার খান। দাদা বিখ্যাত জমিদার আলী আমজাদ খান। নানা মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর সৈয়দ ওয়াসিক আলী মির্জা। মাতা সৈয়দা হুসনে আরা বেগম। তাঁর জন্ম মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারী হাভেলীতে। শান শওকত, মান মর্যাদার দিক দিয়ে আলী সফদার খাঁন ছিলেন এই উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের গৌরবোজ্জল উত্তরাধিকার। নানা বাড়ী মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারী হাবেলীতে সোনার চামচ মুখে নিয়ে নবাবজাদা আলী সফদার খানের জন্ম। বেড়ে উঠেন নবাবী পরিবেশ। বাল্য কৈশোর জীবন কাটে মুর্শিদাবাদে কোলকাতায়, কোলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা, শিলং এর সেন্ট এডমন্ড কলেজ, দার্জিলিং এর সেন্ট এডমন্ড কলেজ, দার্জিলিং এর সেন্ট পালস এ সিনিয়র ক্রেমব্রিজ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন নবাবজাদা আলী সফদার খান। পিতৃ মাতৃ উভয় কুলের দিক দিয়ে অতীব অভিজাত পরিবারের সন্তান নবাব আলী সফদার সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বে সৌখিন জীবন যাপনের অভ্যস্ত ছিলেন। নওয়াব আলী সফদরের কোলকাতার জীবন ছিল খুবই বর্নাঢ্য। বর্ণিল। কোলকাতা মোহামেডান ক্লাবের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। কোলকাতা টেনিসের জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি। বিলিয়ার্ড ও ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। কোলকাতা অবস্থানকালে নওয়াব আলী সফদার খান নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী, প্রিন্স ইউসুফ মির্জা প্রমুখ ভারতীয় রাজনীতিবিদদের সান্নিধ্যে আসেন। তাঁর নানার পার্ক ষ্ট্রিটের বাসভবনে বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ কবি সাহিত্যিকের আসা যাওয়া ছিল। সেখানে তাদের সাহচর্য লাভ করেন নবাব আলী সফদার খান। বৃটিশ শাসনের শেষ ভাগে নবাব আলী সফদার দাদার জমিদারী, পিতৃভূমি পৃথিমপাশায় আসা যাওয়া শুরু করেন। পাকিস্তানী স্বাধীনতার পর সামস্ত শোষন ও জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধাচরন করতঃ সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত হন জনদরদী জমিদার নওয়াব আলী সফদার। যোগ দেন আওয়ামী মুসলিম লীগে। ১৯৫৪ সালে ঐতিহাসিক নির্বাচনে তাঁর পিতা, পরিবারের বিরুদ্ধাচরন করে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন জন নেতা আলী সফদার। তখন সমগ্র দেশ ও জাতি যুক্তফ্রন্টের পিছনে ঐক্যবদ্ধ ছিল। ১৯৫৮ সালে পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ূব খানের সামরিক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেন নওয়াব আলী সফদার। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা জারী হয়। তিনি পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে আত্মগোপন করেন। গেপ্তার হন। কারা যাতনা ভোগ করেন।
পাকিস্তানী শাসনামলে আওমীলীগ ভাগ হয়ে মজলুম জননেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে “ন্যাপ” গঠিত হলে নবাব আলী সফদর খান “ন্যাপ” এ-যোগ দেন। চীন মস্কোর আদর্শিক প্রশ্নে “ন্যাপ” ভাগ হয়ে গেলে তিনি “ভাসানী ন্যাপ” এ থেকে যান। মূলতঃ তিনি ছিলেন সাম্যবাদী। সমাজতন্ত্রের সমর্থক। বাম প্রগতিশীল চিন্তা ধারার অনুসারী। ভাষানী ভক্ত। মজলুম জননেতা মৌলানা ভাষানী ও তাকে পুত্র বৎ স্নেহ করতেন। ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নবাব আলী সফদার খান রাজা সাহেবের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা দেশ, জাতি, এলাকাবাসী চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জল। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় চীন পন্থী বলে পরিচিত “ন্যাপ ভাষানীর” ভূমিকা বিতর্কিত ছিল। ভারত-চীনের বৈরী সম্পর্কের কারনে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভারতে অবস্থানরত চীন পন্থী “ন্যাপ” নেতারা বিব্রতকর অবস্থায় থাকলে ও “ভাষানী ন্যাপ” এর বলিষ্ট নেতা মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী আলী সফদার খান রাজা সাহেব এর ভূমিকা ছিল সুষ্পষ্ট। তিনি চার নম্বর সেক্টারাধীন উত্তর ত্রিপুরাস্থ কৈলাশহরে অবস্থান করে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করেছেন। সশস্ত্র অবস্থায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। সম্মুখ সমরে লড়াই করেছেন। একদা তাঁর পূর্ব পুরুষ ত্রিপুরা মহারাজাদের খাস মেহমান হয়ে ত্রিপুরা এলে ও একাত্তরের রাজা সাহেব কৈলাশহরে সাধারণের সঙ্গে বসবাস করছেন। রাজা ভাইকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কাছে থেকে দেখার, তার সাথে কাজ করার সুযোগ পাই। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ফাইন্যাল এর ছাত্র। তৎকালীন মহকুমা ছাত্রলীগের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি। চার নম্বর সেক্টরাধীন ইয়ূথ ক্যাম্প এর পলিটিক্যাল মবিলাইজার। রাজা সাহেব এর ভ্রাতা নবাব আলী ছরওয়ার খান (চুন্নু নবাব সাহেব) আওয়ামীলীগ দলীয় এম.পি.ছিলেন। আমি ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে তার সঙ্গে সু-সম্পর্ক যুক্ত ছিলাম। খুশনসীব আমার। মরহুম রাজা সাহেব এবং মরহুম চুন্নু নবাব সাহেব উভয়েই আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তাঁদের ইন্তিকালের পর ও তাদের আওলাদগণ সেই সম্পর্ক এখনও বহাল রাখছেন। বিশেষ করে মরহুম রাজা সাহেব এর জ্যেষ্ঠ সন্তান, সাবেক এম.পি. নবাব আলী আব্বাছ খান এডভোকেট এর অকৃত্রিম ভালোভাসা এবং বদান্যতা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। নবাব আলী আব্বাছ খান সাহেব, মরহুম রাজা সাহেব এর সকল সহকর্মী সহযোদ্ধাগণকে আন্তরিকতার সাথে চাচা বলেই সম্বোধন করেন। সম্মান দেখান। রাজা সাহেব এর সু-সন্তান, এই সৎ রাজনীতিবিদ, কুলাউড়া থেকে জাপা প্রার্থী হিসাবে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। মরহুম রাজা সাহেবের সু-সন্তানগণের মধ্যে নবাব আলী মেহদী খান, নবাব আলী নকী খান, নবাব আলী তকি খান এবং নবাব আলী হাসান খান সকলেই সুশিক্ষিত। ভদ্র, নম্র, বিনয়ী। পিতার মত জনদরদী। জনপ্রিয়ও বটেন। নবাব আলী সফদর খান পঞ্চাশ থেকে সত্তোর দশক পর্যন্ত আমৃত্যু বাম প্রগতিশীল রাজনীতির আপোষহীন যোদ্ধা এবং কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছিলেন। এই তিন দশক পৃথিমপাশা ছিল আত্মগোপনে থাকা বাম প্রগ্রতিশীলদের আশ্রয়স্থল। পৃথিমপাশার নবাব বাড়ী ছিল তাদের নিরাপদ আশ্রয়। স্বস্থির ঠিকানা। তিনি তিন দশক বাম রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তাঁর ভিন্ন মতাবলম্বীদের স্নেহ মমতা প্রদর্শন করতেন। সম্মান দিতেন। ভালবাসা দিতেন। তার স্বর্ণ হৃদয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্থান, সম্মানজনক অবস্থান ছিল। বাংলাদেশের বাম রাজনীতির ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব নবাব আলী সফদর খান রাজা সাহেব সতিকার অর্থেই ছিলেন একজন ডিক্লাশড বুর্জোয়া, শ্রেণীচ্যুত বুর্জোয়া। বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে কমরেড মনি সিংহ এবং প্রসূন কান্তি রায় ছাড়া শ্রেণী চে্যুতির এমন নজির খুব একটা নেই। তিনি বুর্জোয়া থেকে সর্বহারা হয়েছেন। গরীব দুঃখী-কৃষক শ্রমিককে তিনি দুহাতে বিত্তবেসাত বিলিয়ে দিয়েছেন। সফেদ পিন পিনে পাঞ্চাবী দর্শনীয় গোফ সমতে নবাব আলী সফদর খান ছিলেন একজন আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর বিশাল হৃদয়, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব, সহকর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মত আদর্শবাদী, সৎ ত্যাগী, নিলোর্ভ নেতা কালে কালেই দেশ ও জাতির জন্য কল্যানকর, মঙ্গলজনক। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য ছিল অপূরনীয় ক্ষতি। বৃহত্তর সিলেট, আসাম বাংলার বিখ্যাত জনদরদী জমিদার, নবাব আলী সফদার খান রাজা সাহেব আর বেঁচে নেই। আছে তাঁর উজ্জল স্মৃতি। তার সুযোগ্য সন্তান, উত্তরাধিকারী, শুভানুধ্যায়ীগণ গঠন করেছেন “রাজা স্মৃতি সংসদ”। সংসদের পক্ষ থেকে দোয়া মাহফিল সহ আকর্ষনীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা হয়ে থাকে। ১৬ইং জুলাই মরহুম রাজা সাহেবের মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর এই মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ তাঁকে বেহেশতবাসি করুন। রাব্বুল আল আমীনের দরবারে এই মোনাজাত সহ আমীন, ছুম্মা আমীন।
[ষাটের দশকের ছাত্রনেতা, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা। সিনিওর এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি ও মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব]
মন্তব্য করুন