অটোয়ায় বাংলাদেশ হাই কমিশনের উদ্যেগে অমর একুশে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত
সদেরা সুজন, সিবিএনএ কানাডা থেকে॥ বাংলাদেশ হাই কমিশন, অটোয়ার আয়োজনে ২১শে ফেব্রুয়ারী অমর শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভষা দিবস পালিত হলো, যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে। ২১ তারিখ কানাডায় কর্মদিবস থাকায় নগরীর রিচলিউ ভ্যানিয়ার কমিউনিটি সেন্টারে ২৫ ফেব্রুয়ারী শনিবার সন্ধ্যায় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর হাই কমিশনার মিজানুর রহমন। শুরুতেই ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ‘৭১এর মহান মুক্তযুদ্ধ ও ‘৭৫এর কালরাতে শাহাদাৎ বরণকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যগণ সহ সকল শহীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর ঢাকা থেকে প্রাপ্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করে শোনান যথাক্রমে দূতাবাসের মিনিস্টার নাইম আহমেদ, কাউন্সিলর মাকসুদ খান, প্রথম সচিব আলাউদ্দিন ভুঁইয়া ও প্রথম সচিব অপর্ণা পাল। এর আগে, ২১ ফেব্রুয়ারী সকালে বাংলাদেশ হাউসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন মান্যবর হাই কমিশনার মিজানুর রহমান। বাংলাদেশ হাই কমিশনের সকল কূটনীতিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। মহান ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ‘৭৫এর কালরাতে শাহদাৎ বরণকারী সকল শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় এ সময় বিশেষ মোনাজাত করা হয়। অমর একুশের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণে কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর হাই কমিশনার বলনে, বাঙালীর মাতৃভাষা বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করেই আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। তিনি ভাষা শহীদদের, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যবৃন্দের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে,তাঁর সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ ও কূটনৈতিক প্রয়াসের ফলেই ২১শে ফেব্রুয়ারী আজ জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা পৃথিবীতে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। এক্ষেত্রে তিনি কানাডার বৃটিশ কলাম্বিয়া প্রবাসী সংগঠন International Mother Language Lovers Association এর সালাম এবং রফিকের অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, এটি আনন্দের বিষয় যে আজ কানাডায় উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষাও অন্তর্ভৃক্ত হয়েছে। এই কানাডারই অটোয়াসহ বিভিন্ন শহরে ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ড -এর অধীনে পরিচালিত স্কুলগুলোতে বাংলা ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। প্রবাসী বিভিন্ন কমিউনিটি সংগঠন বাংলা ভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করে চলেছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট স্কুল/বোর্ড কর্তৃপক্ষ, বাংলা ভাষার শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবকসহ বাঙালী কমিউনিটি সংগঠনসমূহকে তিনি বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসেবে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ হাই কমিশনের উদ্যোগে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারী মহান শহীদ দিবস, ১৭ই মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ এবং ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের বিশেষ দিনগুলোতে সাংস্কৃতিক ও নানামুখী অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে বাঙালী সংস্কৃতিকে উৎসাহ প্রদান এবং এর প্রসার চলমান রয়েছে, যার অন্যতম অংশীদার অটোয়াসহ কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীগণ। প্রবাসে শিশুদের বাংলা ভাষা চর্চায় অধিকতর উৎসাহ প্রদান এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি অভিভাবকদের বিশেষ অনুরোধ জানান। কানাডার টরন্টো, মন্ট্রিয়ল এবং অটোয়াসহ বাংলাদেশী অধ্যূষিত শহরগুলোতে শহীদ মিনার নির্মাণে প্রবাসীদের উদ্যোগে বাংলাদেশ হাই কমিশনের পূর্ণ সমর্থন থাকবে বলে তিনি উপস্থিত সকলকে আশ্বস্ত করেন। এ সময়ে অটোয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, মক্তিযোদ্ধাগণ, পেশাজীবী, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, সংস্কৃতিকর্মী এবং সর্বস্তরের প্রবাসী নাগরিক উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ হাই কমিশনারের সহধর্মিনী মিসেস নিশাত রহমান, দূতাবাসের কূটনীতিকগণ এবং হাই-কমিশন পরিবারের সদস্যবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রণে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-পরিরচালক পিটার ফসেট অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উপর প্রদর্শিত ভিডিও ডকুমেন্টারী (তথ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে প্রাপ্ত) উপস্থিত সকলকে বিমুগ্ধ করে।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে অটোয়ার শিল্পীবৃন্দ ভাষা আন্দোলন, রাষ্ট্রভাসা সংগ্রাম ও গণজাগরণের বিভিন্ন গান কবিতা ও নাচ পরিবেশন করেন। সমবেত কণ্ঠে শিল্পীরা পরিবে শিত হয় “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি”; সালাম সালাম, হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে”, “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়”; “ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছো প্রাণ, ভুলিন আমরা”; এবং “তীর হারা এই ঢেউ এর সাগর পাড়ি দিব রে”। একক কণ্ঠের পরিবেশনায় ছিলো”মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা” (ফারজানা মাওলা অজন্তা), “রাষ্টভাষা আন্দোলনো করিলি রে বাঙালী, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসালি” (দূতাবাসের প্রথম সচিব, শিল্পী,খাওয়াত হোসেন), “মাগো আর তোমাকে ঘুমপাড়ানি মাসি হতে দেব না” (ডালিয়া ইয়াসমীন) এবং “আমি বাংলায় গান গাই” (দেওয়ান মাহমুদ)। কবিতা আবৃত্তির মাঝে ছিলো, “মানুষ জাগবে ফের/শপথ” (মাসুদুর রহমান); “ফেব্রুয়ারীর কবিতা” (শিউলী হক) এবং “আমাদের মা” (মাকসুদ খান)। শিশু শিল্পীদের পরিবেশনায় ছিলো “রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা” (সমবেত); কবিতা “ফেব্রুয়ারীর গান” (দেওয়ান ফাতিমা সহীহ্); সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে” (এ্যালিসিয়া ও আলিনা) এবং “যে দেশেতে শাপলা-শালুক ঝিলির জলে ভাসে” (ওয়াজিদ ও ইষ্টি)। “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী” গানটির সাথে নৃত্য পরিবেশন করে দুই সহোদরা নৃত্যশিল্পী লারিসা ও সানোভা। পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে তবলায় সঙ্গত করেন সাদী রোজারিও, গীটারে ছন্দ রাখেন আরেফিন কবীর। সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করেন গিয়াস ইকবাল সোহেল, সাখাওয়াত হোসেন, হেলাল খান, আরেফিন কবীর, দেওয়ান মাহমুদ, ডালিয়া ইয়াসমীন,ফারজানা মাওলা অজন্তা, শিউলী হক, মাকসুদ খান ও মাসুদুর রহমান। পরিশেষে হলভর্তি দর্শকসহ শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে সমস্বরে গেয়ে ওঠেন কালজয়ী সেই অমর গান “আমর ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি . . . .আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি”। এ গানটির সাথে সাথেই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষিত হয়।অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় ছিলেন বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রথম সচিব ও দূতালয় প্রধান আলাউদ্দিন ভুঁইয়া। গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় ছিলেন দূতাবাসের প্রথম সচিব (বাণিজ্যিক) দেওয়ান মাহমুদ। অটোয়া, মন্ট্রিয়েল, কর্ণওয়াল, অরলিন্স, বার হেভেন ও কানাটাসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন শহর থেকে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশীল ও কানাডীয় নাগরিক এ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
মন্তব্য করুন