অর্ধশতক বছর ধরে বিরামহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন মৌলভীবাজারের শুদ্ধ প্রাণ মুক্তিযুদ্ধের পলিটিক্যাল মটিভেটর অধ্যাপক সাইয়্যিদ মুজিবুর রহমান
বিকুল চক্রবর্ত্তী॥ মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ও জড়াগ্রস্থ সমাজ সংস্কারের পুরোধা শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের মানুষের কাছে সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক সাইয়্যিদ মুজিবুর রহমান ১৯৬৫ সাল থেকেই নিরন্তর যুদ্ধেলিপ্ত। বাঙ্গালী জাতীর জাতীসত্তা ফিরিয়ে আনতে তিনি ৬৬-র ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানসহ প্রত্যেকটি আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে চালিয়েছেন সংগ্রাম। ৭১-এ বাঙ্গালীর বিজয়ের চুড়ান্ত যুদ্ধে নিদ্রাহীন এক জাগরুক সৈনিকের ভুমিকায় ছিলেন তিনি। আর তার এ ত্যাগের ফসল ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধ থেমেছে ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে। কিন্তু তাঁর যুদ্ধ শেষ হয়নি। তাঁর যুদ্ধ চলছে। তাঁর এ যুদ্ধ নিজের আহার সঞ্চারের যুদ্ধ নয়। অন্ধকারাচ্চন্ন মানুষদের আলোয় আনার যুদ্ধ, শিক্ষা বঞ্চিত মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌছে দেয়ার যুদ্ধ, দূর্ণীতিগ্রস্থ মানুষদের সচ্ছতায় ফিরিয়ে আনার যুদ্ধ, মাথা নুয়ে নুয়ে এগিয়ে চলা ৭১-র এর পরা শক্তি, সেই দেশদ্রোহীদের মাথাচাড়া না দেয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার যুদ্ধ, সর্বোপরি দেশকে জঙ্গিবাদ মুক্তরাখার যুদ্ধ। বলা চলে তার যুদ্ধ এখনও যৌবনা। তার তরবারিতে এখনও চলছে সানের কাজ। তাইতো আজও ওরা ভীত। প্রায়ই ওদের রক্তচোখা দৃষ্টিও পড়ে তাঁর উপর। কিন্তু পরাশক্তি ও পরা শক্তিরবীজ যতই ভয় প্রদর্শন ও ক্ষতির চেষ্টা করুক না কেন কোন অবস্থায় তাঁকে দমানো যাবেনা।
সাইয়্যিদ মুজিবুর রহমান যাকে নিয়ে কলম ধরা যায় কিন্তু লিখে শেষ করা যায়না। যার চিন্তা চেতনা চলা ফেরা সবই জনকল্যানে।
তাঁর হাত দিয়ে সুচিত হয়েছে শ্রীমঙ্গলে অনেক গুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিনি ১৯৬৯ সালে শ্রীমঙ্গলের কিছু দানশীল ব্যাক্তিদের নিয়ে স্থাপন করেন বর্তমান শ্রীমঙ্গল সরকারী কলেজ। তিনি ছিলেন সরকারী কলেজের প্রতিষ্টাতা সাধারণ সম্পাদক। একই সাথে শ্রীমঙ্গল সরকারী কলেজ (শ্রীমঙ্গল মহাবিদ্যালয়) এ শিক্ষকতাও করেন। একই সাথে তিনি শ্রীমঙ্গল মনাইউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্টাতা সাধারণ সম্পাদক, শ্রীমঙ্গল উদয়ন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, শ্রীমঙ্গল রাধানাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্টাতা সভাপতি, শ্রীমঙ্গল কলেজ রোডস্থ দেওয়ান সামছুল ইসলাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। শ্রীমঙ্গল আদর্শ বালিকা মহা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। এ ছাড়াও শ্রীমঙ্গল সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। বলাচলে তিনি একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অতোপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে শ্রীমঙ্গল উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ কলেজ। আব্দুস শহীদ কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষের দ্বায়িত্বও পালন করেন তিনি। বিশেষ করে শ্রীমঙ্গল সরকারী কলেজ প্রতিষ্টা করা তাঁর একটি যুগান্তকারীকর্ম। তাঁর এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহন করেছে এবং করছে।
শিক্ষামুলক প্রতিষ্টান ছাড়াও তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীমঙ্গল সাধারণ গ্রন্থাগার ও শ্রীমঙ্গল বধ্যভুমি একাত্তরসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষা জীবন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের গুরুদ্বায়িত্ব পালনকরে যাচ্ছেন তিনি। তিনি জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির শ্রীমঙ্গল শাখার সহ-সভাপতির দ্বায়িত্বে ছিলেন বহুদিন। বর্তমানে রয়েছেন শ্রীমঙ্গল অনুশীলন চক্রের সভাপতি, নাটাবের সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সভাপতি, কঁচিকাচার মেলা শ্রীমঙ্গল এর সভাপতি। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন সচেতন নাগরিক কমিটি সনাক শ্রীমঙ্গল শাখার দুইবারের সভাপতি, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি দ্রুপক এর উপজেলা প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কমিউনিটি শ্রীমঙ্গল উপজেলা শাখার সমন্বয়ক, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শিক্ষক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বধ্যভুমি একাত্তর পরিচালনা পরিষদের সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংরক্ষণ পরিষদ মৌলভীবাজার জেলা এর সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান
মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। তিনি ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি ছিলেন।
একই সাথে তিনি ৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, শ্রীমঙ্গলে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান আন্দোলন পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয়া, অসহযোগ আন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচনে ভুমিকা রাখা ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে শ্রীমঙ্গলে বিমান থেকে সেলে আহতদের উদ্ধার করে ভারতের হাঁসপাতালে প্রেরণ, নিহতদের দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থা, অর্থ সংগ্রহ, জ্বালানীসংগ্রহসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ভারতের কমলপুর মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। ভারতের খোয়াই প্রশিক্ষন কেন্দ্রের পলিটিক্যাল মটিভেটর এর দ্বায়িত্ব পালন করেন। একই সাথে আইআরসি প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রজেক্টেরও ইনর্চাজ ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ উত্তর তিনি নিজের অর্থ ও শ্রমে যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাড়ান। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষনে বিশাল ভুমিকা রাখেন।
বিশেষ করে আমি যখন ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের কাজ করি তখন তিনি শ্রীমঙ্গলের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় স্থান গুলো নিজে গিয়ে দেখিয়েদেন। সংগ্রহ করেন বধ্যভুমির মাটি। এখনও শ্রীমঙ্গলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষনে সর্বাগ্রে তারই ডাক পড়ে।
অধ্যাপক সায়্যিইদ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ খ্রি. মৌলভীবাজারস্থ তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবার নাম মরহুম সাইয়্যিদ খলিলুর রহমান ও মাতার নাম মৃত সৈয়দা খয়রুন নেছা। তাদের গ্রামের বাড়ি কমলগঞ্জ উপজেলায় হলেও স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই তিনি শ্রীমঙ্গল শ্যামলী আবাসীক এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
তিনি কমলগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে প্রবেশিকা, ১৯৬৫ সালে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৬৮সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স ও ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স পাস করেন।
৬৯ সালেই শ্রীমঙ্গল মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্টা করে সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তিতে তিনি ১৯৮০ সালে ভাওয়াল বদরে আলম সরকারী কলেজে তাঁর চাকুরী হয়। দেশের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা শেষে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে (এমসি) বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে চাকুরীকালীন সময়ে অবসরে আসেন।
ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং ৩ কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা। বর্তমানে তিনি স্বপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করছেন।
মন্তব্য করুন