অনলাইনে অবাক অনুষ্ঠান
সায়েক আহমদ॥ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য সারাদেশের মত মৌলভীবাজার জেলাতেও চালু হয়েছে অনলাইন ক্লাসরুম। মৌলভীবাজার জেলায় বেশ কয়েকজন আইসিটিতে দক্ষ এবং শ্রেষ্ঠ ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতা শিক্ষক রয়েছেন। এরা জেলা আইসিটি অ্যাম্বাসেডার হিসেবেও অব্যাহতভাবে আধুনিক শিক্ষাসেবা দিয়ে আসছেন। এদের মধ্যে একজন বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়ের আইসিটি শিক্ষক এবং জেলা অ্যাম্বাসেডার ফয়সল আহমেদ। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু নিয়ে আমি তার সাথে আলাপ করে জানতে পারি বিগত মার্চ মাস থেকেই তারা এ বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে গড়ে তুলেছেন ‘মৌলভীবাজার জেলা অনলাইন ক্লাসরুম’। বর্তমানে এ অনলাইন ক্লাসরুমের নতুন নামকরণ করা হয়েছে, ‘Learning Bee’. . ফয়সল আহমেদ জানালেন এর গতি আরো বৃদ্ধি করার জন্য এবং পরিধি আরো ব্যাপক করার জন্য তারা সিলেট বিভাগীয় অনলাইন কøাসরুমের সাথেও কানেক্ট হয়েছেন। শ্রীমঙ্গল বাডস রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এণ্ড কলেজের অভিজিৎ সিংহ, মৌলভীবাজার ফ্লাওয়ার্স কেজি এণ্ড হাইস্কুলের শ্যামল সিংহ সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রাঃ) কলেজের প্রভাষক মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ সহ বেশ কয়েকজন চৌকষ শিক্ষক এ প্ল্যাটফরমটি তৈরি করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে আরো অনেক ভাল ভাল শিক্ষক এর সাথে যুক্ত হয়েছেন। তাদের কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হয়ে এবং তাদেরকে আরো বেশি উৎসাহদানের জন্য একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমিও বেশ কয়েকটি ভিডিও ক্লাস এবং লাইভ ক্লাস প্রচার করি। আমি বেছে নিয়েছিলাম উচ্চতর গণিতের মত একটি কঠিন বিষয়কে। কারণ এ বিষয়টি সকল শিক্ষার্থীরা সহজে আয়ত্ত্বে নিয়ে আসতে পারে না। এমনিতেই তারা গণিত বিষয়টাকেই ভয় পায়। উচ্চতর গণিত নিয়ে তো আরো বেশি আতংক। এর উপর উচ্চতর গণিত বিষয়ে প্রাইভেট শিক্ষকও সহজে তারা পায় না। এ কারণে তাদের এ আতংক নিরসনের জন্য আমি ‘মজার গণিত’ নামে একটি গ্রুপ খুলে ‘Learning Bee’. এর সাথে কানেক্ট হই। পাশাপাশি মেসেঞ্জারে শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত ‘For Higher Math’ নামে একটি গ্রুপের সাথেও কানেক্ট হই। এ গ্রুপের সাহায্যে প্রতিদিন নোটিশ দেয়া এবং হোমওয়ার্ক দেখার কাজও সহজেই করা যায়। শিক্ষার্থীরা তাদের হোমওয়ার্ক তৈরি করে স্মার্টফোনের সাহায্যে ছবি তুলে মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়। আর আমিও তাদের ভুলত্রুটি দেখে প্রতিদিনই হোমওয়ার্ক মূল্যায়ন করা অব্যাহত রেখেছি। এতে শিক্ষার্থীরা বাসায় সরাসরি হোমওয়ার্ক তৈরির জন্য যথেষ্ট পড়াশোনা করছে। কারণ টিভির ক্লাসে তারা হোমওয়ার্ক তৈরি করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। আর যদি স্কুলগুলো খুলে যায় তবে এতগুলো হোমওয়ার্ক শিক্ষকগণের দ্বারা একসাথে মূল্যায়ন হওয়া কতটুকু বাস্তবসম্মত, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। তবে প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন আদায় হয়ে গেলে শিক্ষকগণও তৃপ্ত হন, শিক্ষার্থীরাও আনন্দ পায়। ঈদের পরেও আমরা সকল শ্রেণির, সকল বিষয়ের পাঠদান কার্যক্রমের এ ধারা অব্যাহত রাখবো। অন্তত আমি আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষকমন্ডলীকে এতে অব্যাহতভাবে ক্লাস তৈরি এবং হোমওয়ার্ক আদায় করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করব। আমার মনে হয় সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যদি শিক্ষাবিভাগ কর্তৃক এ নির্দেশনাটুকু প্রদান করা হয় এবং ডিজিটাল মনিটরিং করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে বসে অলস সময় কাটাবে না। শিক্ষকরাও সানন্দে এগিয়ে আসবেন।
এবারের পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরটা হল সারা বিশ্বের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সাধারণত পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের দিনে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সারা বিশ্বের মুসলমানরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেন। কিন্তু এবারে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে সে আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে। ঈদগাহে গিয়ে ঈদের জামাত পড়া হয়নি, কোলাকুলি করা হয়নি, একে অন্যের বাসায় বেড়াতে যাওয়া হয়নি, দর্শনীয় স্থানেও ঘুরে বেড়ানো সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থা তো আরও শোচনীয়। শিক্ষার্থীরা কত আর বাসায় বসে থাকবে, বিজ্ঞাপনে ভরপুর টিভি চ্যানেলগুলো দেখার জন্য কত আর রিমোর্ট টিপাটিপি করবে? এমন অবস্থায় বাড়তি বিনোদনের জন্য ‘Learning Bee’ তে শিক্ষার্থীদের আনন্দ বিনোদনের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আবৃত্তি, গান, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, ফটোগ্রাফিসহ বিভিন্ন আয়োজনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ঈদের দিন বিকেলে বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সায়েকা আহমদ এর স্বরচিত ছড়া আবৃত্তি সবাইকে বিমোহিত করেছে। মাত্র এক মিনিটের সেই আবৃত্তির মুন্সিয়ানাটুকু না দেখলে বড় একটা কিছু মিস হয়ে যাবে। এরপর আরেকটি অনুষ্ঠান সবাইকে আরো চমকে দিয়েছে। এটা ছিল একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান। সম্ভবত সিলেট বিভাগের ইতিহাসে এই প্রথম একটি অসাধারণ পারিবারিক আয়োজন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন শ্রীমঙ্গলের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেবাশীষ চৌধুরী রাজা। এ আয়োজনে নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে উপস্থাপনা ও ভরাট কণ্ঠে চমৎকার আবৃত্তির মাধ্যমে দর্শকশ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন আবৃত্তিশিল্পী রাজা স্বয়ং। পাশাপাশি হাওয়াইয়ান গিটার বাজিয়ে দর্শক শ্রোতাদেরকে মাতিয়ে রেখেছিলেন ঢাকা বেতারের গ্রেড ওয়ান আর্টিস্ট, দি বাডস্ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, শ্রীমঙ্গল এর সিনিয়র শিক্ষক এবং দেবাশীষ চৌধুরীর সহধর্মিনী মিসেস সুপর্ণা দেবনাথ পুতুল। কী বোর্ডে ছিলেন তাদের জ্যেষ্ট পুত্র ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনিন্দ্য ঋদ্ধ এবং তবলায় ছিলেন তাদের কনিষ্ঠ পুত্র ঢাকা কমার্স কলেজের ছাত্র ঐক্য অনিক। দেশের গান ‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিণু পল্লী জননী’ দিয়ে শুরু হয় হাওয়াইয়ান গিটার পর্ব। একে এসে সুপর্ণা পুতুল বাজালেন নজরুলের ‘আমায় নহে গো ভালবাসো শুধু, ভালবাসো মোর গান’, ‘খেলিছো এ বিশ্বলয়ে বিরাট শিশু আনমনে’ এবং ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার, আঁচল ভরা ফুল।’ দর্শক শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে ফাঁকে ফাঁকে অনলাইনে শুভেচ্ছা জানালেন। মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠানটি শেষ হয় দেবাশীষ রাজার অনবদ্য কণ্ঠের, ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ আবৃত্তি দিয়ে। ৫০ মিনিটের অনলাইনের এ অবাক পারিবারিক অনুষ্ঠানটি ঈদ বিনোদন হিসেবে শিক্ষার্থীদেরকে যথেষ্ট আনন্দ দান করেছে।
ঘরে বসে Learning BEE এর ঈদ আয়োজনের এ ব্যতিক্রমী আয়োজন সবাইকে অন্যরকম আনন্দ দান করেছে। জেলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য এ ধরণের আয়োজনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। এ ব্যাপারে Learning BEE কে উৎসাহিত করার জন্য জেলা প্রশাসন এবং জেলা শিক্ষা প্রশাসনের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এতে করে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদ দূর হবে এবং ঘরে বসে অনলাইনে লেখাপড়া করার অভ্যাসটুকুও গড়ে উঠবে।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন