অন্তর্বর্তী সরকার : প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ সমান্তরালে
ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ: অন্তর্র্বতী সরকারের যাত্রা শুরু হলো যে প্রেক্ষাপটে তা আমাদের কারোরই অজানা নয়। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের বলতে গেলে সূচনালগ্নের কাছাকাছি সময়ে রাজনৈতিক সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছে নতুন বাংলাদেশের অভিমুখে। বলা যায়, এমন যাত্রাই শুরু হয়েছিল নব্বইয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর। কিন্তু যে প্রত্যয়ে সেই যাত্রা শুরু হয়েছিল তার কিছুই পূরণ বা বাস্তবায়িত হয়নি পরবর্তী সময়ে। আজকের প্রেক্ষাপটে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, এবার কি পূরণ হবে ছাত্রজনতার প্রত্যাশাকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা আন্দোলনের কাঙ্ক্ষিত ফল? অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু হলো অন্তর্র্বতী সরকারের যাত্রা এবং বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, তাদের দিতে হবে অগ্নিপরীক্ষা।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে যে আন্দোলন হলো তার প্রাথমিক সূচনা করে শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগিয়েছে। ক্রমেই রূপ নিয়েছে গণঅভ্যুত্থানে। যুক্ত হয়েছে অভিভাবকসহ দেশের আপামর জনতা। একসময় এই আন্দোলন দমনের জন্য সরকার পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করতে শুরু করে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুড়তে শুরু করে। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ বাহিনী নির্মমভাবে গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। ফলে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয় এবং আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের অনেককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহত হওয়ার পরও অনেক শিক্ষার্থী আন্দোলনের ময়দান থেকে পিছপা হয়নি।
প্রাথমিক পর্যায়ে সহিংস অর্থাৎ আন্দোলন এমনটি ছিল না। শিক্ষার্থীরা তাদের একটি যৌক্তিক দাবি উপস্থাপন করেছে এবং শান্তিপূর্ণভাবেই তা সম্পন্ন করতে চেয়েছে। এই স্তম্ভেই তখন আমি এ আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় বিষয়ে আলোচনা করি। কিন্তু সরকার এক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং ইন্টারনেট বন্ধ করে দীর্ঘদিন মানুষকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখেছে। শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি বাতিল করার দাবি করেনি। তারা যৌক্তিক হারে কোটার সংস্কার দাবি করেছিল। এই যৌক্তিক দাবির জন্য রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদকে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হলো। একটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। তারপর পুলিশি সহিংসতায় আরও শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরতে শুরু করে। তখনই শুরু হলো সংকট। আবু সাঈদের মৃত্যু বিফলে যায়নি। সারা দেশে তার মৃত্যুর খবর মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলল।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলন নতুন উদ্যমে তার গতিবেগ পায় আবু সাঈদের মৃত্যুর পর। তারপর একে একে আরও মর্মস্পর্শী মৃত্যুর ঘটনা ছাত্রজনতার হৃদয়কে নাড়িয়েছে। বেদনাকে শক্তিতে পরিণত করে শেষ পর্যন্ত সংঘটিত হলো বিপ্লব। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়ে যায়। এই আন্দোলনের মোড় ঘুরে গেল। তারপরও সরকার তাদের ভুলত্রুটি বুঝতে পারল না। বরং রাজনৈতিক পক্ষ এমন কিছু মন্তব্য করল যা শিক্ষার্থীদের আরও ক্ষেপিয়ে তোলে। শিক্ষার্থীদের বলা হলো রাজাকার। দেশের তরুণ প্রজন্ম রাজাকারদের পছন্দ করে না। সঙ্গত কারণেই তারা ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা এবং তা-ই হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম রাজাকারদের ঘৃণা করে এবং প্রতিবাদেও তারা এই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতার যে চেতনা তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিরজাগ্রত।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় আমি স্কুলে পড়ি। ওই সময় পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সংস্কৃতি জোর করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। শাসকরা ভেবেছিল এভাবে যদি পাকিস্তানের কৃষ্টি চাপিয়ে দেওয়া যায় তাহলে শিক্ষার্থীরা তা পড়বে এবং কৃত্রিমভাবে এর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করবে। কিন্তু তৎকালীন শাসকরা সফল হতে পারেনি। কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনও সাধারণ মানুষের মনে দানা বেঁধে রইল। ওই ক্ষোভ ও জাতীয় চেতনা ঊনসত্তরে প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এর প্রতিফলন ঘটে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
ঊনসত্তরে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ বইটি বাতিল করার দাবি শুরু হলো। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একচেটিয়া জয় পায়। মওলানা ভাসানী অবশ্য বলেছিলেন, এত মৃত্যুর পর এই নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রফেসর শামসুজ্জোহা এবং আসাদের মৃত্যুর মতো ঘটনা তখনও তাজা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তারপরও নির্বাচন করলেন। পাকিস্তান সরকার চাইলে ওই সময় নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারত। সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়ী হলো আওয়ামী লীগ। জয়ী হওয়ার পরও সংগ্রাম থামেনি। তারপর আবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হলো স্বাধীন দেশেও। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ওই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক জোট হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাননি বলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়।
দেশের মানুষ সত্যিকার অর্থেই ভোটাধিকার প্রয়োগে বিশ্বাসী। তারা যে সঠিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রত্যাশা করেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় সরকার অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি দানা বাঁধতে শুরু করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি থাকে তাহলে মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে এমন একটি বিশ্বাস সবার ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলন চাঙ্গা হলো এবং দাবি আদায়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলো। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের এই ধারা থেকে আওয়ামী লীগ শিক্ষা নিতে পারেনি। শুধু আওয়ামী লীগই নয়, কোনো সংগঠনই পারেনি। কারণ বিগত কয়েকটি নির্বাচনে দেশের ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টিই ভুলে গেছে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে অর্থাৎ ভারতে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫ দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্তেও আমরা সুষ্ঠু ভোট পদ্ধতি চালু করতে পারিনি। উপরন্তু একচেটিয়া নির্বাচন পদ্ধতি চালু করে আওয়ামী লীগ মানুষের বিরাগভাজন হয়ে উঠল। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রাণ রয়েছে। কিছুদিন আগে মালদ্বীপেও ক্ষমতাসীন দলকে হটিয়ে বিরোধী দল ক্ষমতায় এলো। পাকিস্তানের বিষয়টি একটু ব্যতিক্রম হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। এরশাদের পতনের সময় সামরিক বাহিনী যেমন নিশ্চুপ ছিল, এবারও সামরিক বাহিনী তেমন ভূমিকা পালন করেছে। তারা সরকারের নির্দেশনা অনুসারে আন্দোলন দমনে এগিয়ে আসেনি। সামরিক বাহিনী সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের প্রবণতা ও মানসপটকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে এবং সে অনুসারেই প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ তিনি সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের বন্ধু হিসেবেই ভূমিকা রেখেছেন।
ড. ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করা হয়েছে। অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলনের বিষয়টিকে জোর দেওয়ার কথা বলেছেন সেনাপ্রধান। অন্তর্র্বতী সরকারে যারা দায়িত্ব পাবেন তাদের কাছে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রত্যাশাই রয়েছে। শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষকÑ এভাবে বিভাজন করে সরকার পরিচালনা করা যাবে না। বরং সরকার পরিচালনায় দক্ষ এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের ভূমিকাই বেশি প্রভাব রাখতে পারে। ড. ইউনুসকে গরিবের বন্ধু বলা হয়। কিন্তু আমাদের এখন ভাবতে হবে বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সুনীতি বাস্তবায়নের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। দেশের মানুষকে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। এসবের ভিত্তিতেই দেশকে আগামী দিনের জন্য এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। জননিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিতে হবে সর্বাগ্রে। দেশে এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতিতে রয়েছে। ফলে একটি অশুভ মহল নানা অপতৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন এবং ভাস্কর্য ভাঙার মতো ঘটনা ঘটছে। দোকানপাট লুট হচ্ছে। মানুষ সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে শঙ্কায় ভোগে। এসব ঘটনার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাই এই অশুভ মহলকে চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অর্থাৎ পুলিশকে সচল করা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে কিছু সংস্কার আনা জরুরি অবশ্যই। পুলিশ এই মুহূর্তে জনগণের আস্থা হারিয়েছে। তাই পুলিশে সংস্কার আনতে হবে। সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে সব স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়োজিত করা সম্ভব নয়। ফলে দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংস্কার এবং তাদের সচল করার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নতুন পুলিশ প্রধানের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। পুলিশ ও জনগণের মধ্যকার আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। অনেক থানায় হামলা হয়েছে। এসব থানায় দুষ্কৃতকারীরাই হামলা করেছে। এসব দুষ্কৃতকারীকে কোনো অনুকম্পা দেখানো চলবে না। অন্তর্র্বতী সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যার তাকেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। নতুন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। আর প্রত্যাশাও রয়েছে বহু গুণ।
লেখক : স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন