অপেন বুক এক্সামিনেশন
সায়েক আহমদ॥
পটভূমি :
সারাবিশ্ব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে করোনা ভাইরাসের বিষাক্ত থাবায়। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও। কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কবে থেকে চালু করা হবে কিংবা কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে চালু করা হবে? ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এটা নিশ্চিত যে, আমাদের দেশ থেকে করোনা মহামারী বিদায় নেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও শিক্ষার্থীদেরকে আবারো সহজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করবেন অভিভাবকেরা। তাহলে কীভাবে চলমান রাখা যাবে শিক্ষা কার্যক্রম? যদিও দেশের ৯০% শিক্ষক অনলাইন ক্লাসগুলোতে বিশেষ পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন, তারপরও ৭০% শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে এসব ক্লাস দেখার সুযোগ পাচ্ছে না। এদের মধ্যে বেশিরভাগ অভিভাবকই হতদরিদ্র, শিক্ষায় অনগ্রসর এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে উদাসীন। ইতোমধ্যে বিদ্যালয়সমূহে বার্ষিক পরীক্ষার সময়ও এগিয়ে আসছে। যদি অক্টোবর মাসেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকে তাহলে কীভাবে এবং কোন পদ্ধতিতে বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে ‘অপেন বুক এক্সামিনেশন’ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
‘অপেন বুক এক্সামিনেশন’ পদ্ধতির ধারণা
‘অপেন বুক এক্সামিনেশন’ পদ্ধতি হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের সাহায্য নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ‘অপেন বুক এক্সাম’ ব্যবস্থায় পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময়ে অনলাইনে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৯:৩০-১৪:৩০ পর্যন্ত মোট ৫ ঘন্টায় এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। করোনাকালীন সময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী ১ লা অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ‘অপেন বুক এক্সাম’ ব্যবস্থায় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ফল প্রকাশ করা হবে ৩১ অক্টোবর। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের নিজস্ব পোর্টাল থেকে পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে প্রশ্ন পাবে পরীক্ষার্থীরা। নিজস্ব উত্তরপত্রে পরীক্ষা দেওয়ার পর ওই দিনের মধ্যেই পোর্টালে উত্তরপত্র আপলোড করতে হবে ছাত্রছাত্রীদের। পোর্টালের পাশাপাশি ইমেল এবং হোয়াটসঅ্যাপেও উত্তরপত্র পাঠানো যাবে। যেসব পরীক্ষার্থীর স্মার্টফোন নেই তাঁরা নিজেদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা শুরুর আধ ঘন্টা আগে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করতে পারবে। পরদিন সকালের মধ্যে উত্তরপত্র পৌছে দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কলেজে।
বাংলাদেশে ‘অপেন বুক এক্সামিনেশন’ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে কি?
বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেল পর্যন্ত ‘অপেন বুক এক্সামিনেশন’ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ পরীক্ষা পদ্ধতির নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যে ব্যবস্থাপনায় এ পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে তার একটি সুপারিশপত্র নিম্নে ব্যাখ্যা করা হল। যেহেতু এটি আমার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনায় প্রণয়ন করা হয়েছে, কাজেই শিক্ষা বিভাগ সুপারিশপত্রটি বিবেচনাপূর্বক নিজস্ব পদ্ধতি প্রণয়ন করে পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। যদি সুপারিশপত্রটি বিবেচনার আওতায় পড়ে তাহলে তা পরিমার্জিত করেও পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
বাংলাদেশের জন্য ‘অপেন বুক এক্সামিনেশন’ পদ্ধতির ধারণা
১. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন :
২. করোনাকালীন সময়ে প্রকাশনা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণে সারাদেশের জন্য একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পরীক্ষা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিভাগওয়ারী কিংবা জেলাওয়ারীও প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা যেতে পারে। তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের দক্ষ শিক্ষকগণ দ্বারা অভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে তা প্রতিটি জেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে প্রেরণ করা যেতে পারে।
৩. প্রশ্নপত্রের ধরণ :
ক) দেশের ৭০% শিক্ষার্থী অনলাইনের আওতায় বাইরে আছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবকই হতদরিদ্র, শিক্ষায় অনগ্রসর এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে উদাসীন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে।
খ) শিক্ষার্থীরা যেন অভিভাবক এবং শিক্ষকের সহায়তা ছাড়াই স্ব স্ব গৃহে অবস্থান করে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে।
গ) জটিল প্রশ্নের পরিবর্তে সহজ ও সাবলীল ভাষায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে যাতে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরাও সুন্দরভাবে পরীক্ষা দিতে সক্ষম হয়।
ঘ) প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি এবং ৬ষ্ঠ হতে ১০ম শ্রেণির জন্য বিশেষ সিলেবাসের আওতায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে।
ঙ) সিলেবাসের আলোকে পাঠ্যবইয়ের অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে। প্রতিটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রণয়ন করে তা সেপ্টেম্বর, ২০২০ এর মধ্যেই শিক্ষার্থীদের নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থীরা অক্টোবর এবং নভেম্বর- এ দু মাস বাসায় অধ্যয়ন করে ডিসেম্বর মাসে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে।
চ) প্রাক-প্রাথমিক থেকে ২য় শ্রেণির প্রশ্নপত্র এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যাতে ছোট্ট সোনামনিরা সহজেই প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশ্নপত্রের মধ্যেই উত্তর দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করাটাই উত্তম হবে।
ছ) ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণির প্রশ্নপত্র এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকের পাঠ, অধ্যায় কিংবা অনুশীলনী থেকে সহজেই উত্তর প্রদান করতে পারে।
জ) ৬ষ্ঠ হতে ৮ম শ্রেণির প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রশ্নের উদ্দীপক পাঠের বাইরে থেকে না দিয়ে পাঠের ভেতর থেকেই প্রণয়ন করতে হবে। এতে করে দুর্বল শিক্ষার্থীরাও পাঠ পড়ে কিংবা উদাহরণ(গণিতের ক্ষেত্রে) অনুসরণ করেই উত্তর দিতে পারবে। বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রে সরাসরি পাঠ থেকে যাতে উত্তর খুঁজে বের করতে পারে সে চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। দুর্বল শিক্ষার্থীরাও যাতে সহজেই উত্তর দিতে পারে এ ভাবনা সর্বদাই মাথায় রেখে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে যত্নবান হতে হবে।
ঞ) ৯ম ও ১০ম শ্রেণির প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রে সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে।
চ) ব্যবহারিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাসায় বসে ব্যবহারিক পরীক্ষা দেয়া যায় এমন ধরণের ব্যবহারিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে। মৌখিক পরীক্ষার পরিবর্তে কুইজ টাইপের প্রশ্ন দেয়া যেতে পারে। ব্যবহারিক খাতার ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। পাঠ্যবইয়ের সাহায্য নিয়ে ব্যবহারিক খাতা লিখা যায়, এমন ধরণের নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।
দ্রষ্টব্য ঃ ১০০% শিক্ষার্থী যেন পাশ করতে পারে, এমন মানসিকতা নিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা উচিত। পাঠ কিংবা অধ্যায় থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রশ্ন করলে শিক্ষার্থীদেরকে অবশ্যই পাঠটি পড়ে উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। এতে করে অন্যমনস্ক শিক্ষার্থীও পাঠটা অন্তত পড়বে।
৪. পরীক্ষার সময় : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরীক্ষার সময় ২৪ ঘন্টা হওয়া উচিত।
৫. প্রশ্নপত্র সরবরাহ : যদি সারাদেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয় তবে জেলা/উপজেলা প্রাথমিক/মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হবে। যদি উপজেলা ভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয় তবে উপজেলা প্রাথমিক/মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকমণ্ডলী, ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষানুরাগী সমন্বয়ে প্রশ্নপত্র সরবরাহের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে। নির্দিষ্ট কিছু গ্রাম, এলাকা কিংবা পয়েন্টে প্রশ্নপত্র সরবরাহ কমিটির একজন সদস্যের তত্ত্বাবধানে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হবে। অভিভাবকগণ/শিক্ষার্থীবৃন্দ সেখান থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করবেন।
৬. উত্তরপত্র সংগ্রহ : যেখান থেকে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হবে, সেখানেই অভিভাবকগণ/শিক্ষার্থীবৃন্দ পূর্বদিনের পরীক্ষার উত্তরপত্র জমা দিয়ে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করবেন। এক্ষেত্রে শুক্রবারেও পরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
৭. উত্তরপত্র মূল্যায়ন : প্রচলিত পদ্ধতিতে শিক্ষকমণ্ডলী স্ব স্ব বিষয়ের উত্তরপত্রসমূহ বিদ্যালয় হতে সংগ্রহ করবেন এবং যথানিয়মে মূল্যায়ন করবেন।
৮. ফলাফল প্রকাশ : প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট তারিখে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ফলাফল প্রকাশ করবেন। ফলাফল প্রকাশের সর্বশেষ তারিখ থাকবে ৩০ অথবা ৩১ ডিসেম্বর।
উপসংহার : বাংলাদেশ সরকার করোনাকালীন সময়েও সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূে হর শিক্ষকবৃন্দের বোনাস/ইনক্রিমেন্টসহ পূর্ণাঙ্গ বেতন প্রদান করেছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকবৃন্দেরও এমপিও এর বেতনের অংশ ইত্যাদি প্রদান করেছেন। কাজেই শিক্ষকমণ্ডলীকে এ পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র সরবরাহ, সংগ্রহ এবং মূল্যায়নের কাজ গুরুত্ব সহকারে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে করা উচিত।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন