অবশেষে পিডিবির উপ-সহকারী প্রকৌশলী আনসারুল কবির শামীমের বদলি
হারিস মোহাম্মদ॥ বিদ্যুৎ বিভাগের শুভ বুদ্ধির উদয় হলো। অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশের পর অবশেযে বদলি হলেন মৌলভীবাজার জেলার জুড়ীতে কর্মরত পিডিবি’র উপ-সহকারী প্রকৌশলী আনসারুল কবিরকে (শামীম)। এ প্রকৌশলীর অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন গনমাধ্যমে বেশ কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশের পর বিষয়টি পিডিবি’র উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়। অবশেষে বৃহস্পতিবার ১৭ আগস্ট বিউবি সিলেট অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল কাদির ও বিতরণ বিভাগের উপ-পরিচালক মোঃ আরাফাত-আল-মাজিদ ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক দপ্তরাদেশে তাঁর বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পিডিবির দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তার বদলির খবরে জুড়ী উপজেলার সাধারণ গ্রাহকরা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। এছাড়াও তাৎক্ষণিক ভুক্তভোগী অনেক সাধারণ গ্রাহক মিষ্টি বিতরণ করেছেন। এসময় তারা এ কর্মকর্তার অনিয়ম দুর্নীতির বিচার চেয়ে চাকুরী থেকে অপসারণ দাবি করেন। সম্প্রতি সময়ে এ প্রকৌশলীর অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে পিডিবি অফিসসহ পুরো উপজেলায় তার বদলির বিষয়ে গুঞ্জন উঠে। বদলির গুঞ্জন উঠায় তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী অনেক সাধারণ গ্রাহক ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে পিডিবি অফিসে অভিযোগ দাখিল করেছেন।
এছাড়া গনমাধ্যমে প্রকৌশলী আনসারুল কবির শামীমের দুর্নীতির বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে বৃহস্পতিবার ১৭ আগস্ট উপজেলা পরিষদের মাসিক সাধারণ সভায় নির্বাচিত বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা পিডিবির এ দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক সম্পাদক রিংকু রঞ্জন দাস বলেন, পিডিবির এ কর্মকর্তা দীর্ঘ দিন জুড়ীতে থাকার সুবাদে দুর্নীতির সীমা লংঘন করেছেন। তাকে অবিলম্বে এ উপজেলা থেকে অপসারণের করে দুর্নীতি অনিয়মের বিচার দাবি করেন। সদর জায়ফরনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুম রেজা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এত অনিয়ম দুর্নীতির পরও এ কর্মকর্তা জুড়ীতে ৯ বছর ধরে বহাল আছেন। গত কয়েকদিন আগে অনিয়মের মাধ্যমে এ কর্মকর্তা একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ীর লাইন কেটে নিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধারাও তার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পূর্বজুড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওবায়দুল ইসলাম রুয়েল বলেন, আমার ইউনিয়নের হতদরিদ্র আব্দুল বারী নামের এক কৃষককে ১৪ হাজার টাকার বিনিময়ে বৈধ মিটার না দিয়ে অন্য নামের আরেকজনের মিটার সংযোগ দেয় পিডিবির এ কর্মকর্তা। পরবর্তীতে কয়েকমাস পর এ সংযোগ অবৈধ আখ্যা দিয়ে ৮৭ হাজার টাকার মামলা দিয়ে ওই কৃষক কে জেল খাটান পিডিবির এ কর্মকর্তা। সভায় ফুলতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম সেলু এ কর্মকর্তার অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরে অবিলম্বে তার অপসারণসহ বিচার দাবি করেন।
পিডিবির জুড়ী অফিসের ইলেকট্রিশিয়ান রবিউল আলম অভিযোগ করে বলেন, আমি দীর্ঘ ১৫/২০ বছর যাবৎ ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করছি। বিভিন্ন সময়ে গ্রাহকদের নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ২২ টি ফাইলে স্বাক্ষর বাবদ প্রকৌশলী শামীম আমার কাছ থেকে মোট ৪৪ হাজার টাকা ঘুষ নেন। এ প্রকৌশলীর অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় পর বদলির গুঞ্জন উঠলে আমি ঘুষের ৪৪ হাজার টাকা ফেরত চাই। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আমাকে সকল স্টাফদের সামনে দরজা বন্ধ করে পেটান। আমি আমার টাকা ফেরত সহ অবিচারের বিচার চাই।
উপজেলার উত্তর সাগরনাল গ্রামের মৃত কারী আরজান আলীর ছেলে কৃষক হাবিবুর রহমান কালা (৬০) অভিযোগ করে বলেন, প্রকৌশলী শামীম কয়েকমাস আগে আমার বাড়ীর সংযোগ অবৈধ বলে মিটার কেটে নেন। পরে অফিসে গেলে তিনি বলেন মামলা হলে ৬০/৭০ হাজার টাকা খরচ হবে। খরচ বাবদ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করলে পরবর্তীতে ৩৩ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে মিটার সংযোগ দেন। আমার মত একজন নিরীহ কৃষককে মামলার ভয় দেখিয়ে ৩৩ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ার বিচারসহ টাকা ফেরত চাই।
ঠিকাদার ও আওয়ামীলীগ নেতা জামাল উদ্দিন বলেন, আমারা তার বদলিতে খুশি হলেও তার দুর্নীতির ও অপকর্মের বিচার চাই।
পূর্বজুড়ী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কল্যাণের জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ প্রকৌশলী শামীমের মতো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য সরকারের বদনাম হচ্ছে। শামীম একজন কর্মকর্তা নয় সে একজন ডাকাত। আমরা তার অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার চাই।
জানা যায়, ২০১৪ সালের মে মাসে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ীতে যোগদান করে ৯ বছর ধরে একই অফিসে কর্মরত প্রকৌশলী আনসারুল কবির শামীম।
নানা দূর্নীতির অভিযোগে ২০২০ সালে কর্তৃপক্ষ তাকে বদলি করলেও তদবির করে অদৃশ্য হাতের ইশারায় ৩ মাসের মাথায় আবারও ফিরে আসেন জুড়ীতে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন এক উপজেলায় কর্মরত থাকার সুবাদে নিজ অফিসে গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নানা অজুহাতে সাধারণ গ্রাহকদের মিটার কেটে এনে মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করতেন শামীম। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেলে গ্রাহকদের মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে ভুরিভুরি। তার মামলার অত্যাচারে অনেকে ইতিমধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন। নিজ অফিসকে তার ব্যক্তিগত ব্যবসায় পরিণত করেছিলেন এ কর্মকর্তা। তার অত্যাচারে পিডিবিতে অস্থায়ী চাকুরীকৃত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী এখন নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, বিভিন্ন অবৈধ করাতলে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে নিয়মিত মোটা অংকের মাসোয়ারা নিতেন উপসহকারী প্রকৌশলী শামীম। শামীমের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বারবার গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টনক যেন নড়ছিল না। এছাড়া অনেক গ্রাহকরা বৈধ মিটার পেতে আবেদন করলে তাদেরকে অনেক মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পিডিবি অফিসে জমাকৃত পুরাতন মিটার দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হত। পরে আবার এসব মিটার অবৈধ আখ্যা দিয়ে মামলার মাধ্যমে গ্রাহকদের হয়রানি করত। বিভিন্ন এলাকায় অটোরিকশার গ্যারেজের অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা পেত পিডিবির এই অসাধু কর্মকর্তা। প্রকৌশলী শামীম নিজ বলয়ের কর্মচারীদের মাধ্যমে শক্তিশালী সিন্ডিকেট করে অনিয়ম দুর্নীতি করত হরহামেশা। তার বিরুদ্ধে নিজ অফিসে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। অফিসে কেউ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললে ও তার কথামত না চললে বদলীসহ চাকুরিচ্যুতির হুমকি দিত সে। তার অত্যাচারের স্বীকার হয়ে ইতিমধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তা চাকুরী ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
জুড়ী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবির আবাসিক প্রকৌশলী কবির আহমদ বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, প্রকৌশলী শামীমের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন গ্রাহক অনিয়ম ও দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ গুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জুড়ীর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আনসারুল কবির শামীমের হবিগঞ্জে বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করে পিডিবির সিলেট বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল কাদির বলেন, অনিয়ম দুর্নীতি করে কেউ ছাড় পাবে না। প্রকৌশলী শামীমের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মন্তব্য করুন