অবাধে পাহাড়-টিলা কাটার প্রভাবে পরিবেশ বিপর্যয় বড়লেখা-জুড়ীতে ২৫ হাজার মানুষের পাহাড় টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস
আব্দুর রব॥ মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পাহাড়ের চুড়া আর টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। বেশিরভাগ সরকারী খাস জমিতে এসব বসতি গড়ে উঠলেও ভুমি প্রশাসন নির্বিকার। ফলে প্রতি বছর পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে টিলা ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। গত ৩ বছওে টিলা কাটতে গিয়ে মাটি চাপায় ও টিলা ধসে অন্তত ২০-২৫ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। হতাহতের ঘটনা ঘটলেই প্রশাসন ২-৪ দিন গণসচেতনতায় মাইকিং লিফলেট বিতরণ করেই চুপশে যায়। পরিবেশ বিপর্যয়ের মুল কারণ টিলা কাটা রোধে প্রশাসন কঠোরভাবে পরিবেশ আইন প্রয়োগ না করায় অকাল বন্যা, ভুমিকম্পসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে।
পাহাড়ি এলাকা ঘুরে জানা গেছে, পাহাড়ের চুড়া ও টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের অধিকাংশই ভুমিহীন, হতদরিদ্র ও অসহায় প্রকৃতির। মাথা গুজার বিকল্প স্থান না থাকায় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এরা বৈধ-অবৈধ পথে সরকারী টিলা দখল করে বসবাস শুরু করে। জীবিকার তাগিদে এরা বৃক্ষ নিধন, টিলার মাটি ও পাথর বিক্রির মত পরিবেশ বিধংসী কাজে জড়িয়ে পড়ে। বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার স্থানীয়দের দেয়া তথ্যানুযায়ী পাহাড়ের চুড়া ও টিলার পাদদেশে বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। শেল্টারদাতা প্রভাবশালী মহল ৩-৪ যুগ ধরে এসব বসবাসকারীদের সামান্য সুবিধা দিয়ে বছরের শুষ্ক মৌসুমে টিলা কেটে লাখ লাখ টাকার বিক্রি করছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় নির্বিচারে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটলেও রহস্যজনক কারণে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা থাকেন নীরব। বর্ষা মওসুমে টানা ভারী বর্ষন হলেই আগের কাটা পাহাড়ের অবশিষ্ট অংশ ধসে পড়ে। আর এসময় পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে বসবাসকারীরা দূর্ঘটনা কবলিত হন। ভৌগলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে পাথারিয়া পাহাড় ও হাকালুকি হাওর বেষ্টিত এ দুই উপজেলায় এরকম র্দূঘটনা এড়াতে স্থানীয় প্রশাসনের যে ভূমিকা থাকার কথা সে রকম ভূমিকা নেয়া হচ্ছেনা বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। কোন অঘটন ঘটলেই দৌড় ঝাঁপ শুরু হয়। দূর্ঘটনার আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের সচেতন করতে কোন ভূমিকা চোখে পড়েনি। ইতিপুর্বে বড়লেখার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের বোবারতল এলাকায় ঘটে যাওয়ায় এমন দু’টি ঘটনা এর প্রমান। দূর্ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন দূর্ঘটনা এড়াতে স্থানীয়দের সচেতন করতে কিছুটা তৎপর হতে দেখা গেলেও তা আশানুরুপ নয় বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর। এই ২টি উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন প্রতিবছরই পাহাড়ে বসবাসকারীরা আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে অবাধে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করে। তারা সরকারী নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাহাড়ী টিলা কেটে চূড়া ও পাদদেশে নির্মাণ করেন ঝুঁকিপূর্ণ বসতঘর। তাদের এমন আচরনে উজাড় হচ্ছে পাহাড়ী বনবৃক্ষ ও জঙ্গল। এমন নির্মমতায় বাসস্থান হারাচ্ছে বন্য প্রাণী। হুমকির মুখে পড়ছে পাহাড়ী টিলা বেষ্টিত এ অঞ্চলের পরিবেশ। প্রকাশ্যে প্রশাসনিক কার্যালয়ের সামনে দিয়ে পাহাড়ী টিলার মাটি কেটে পরিবহন করে নেয়া হলেও রহস্যজনক কারনে সংশ্লিষ্টরা থাকেন নির্বিকার।
সরেজমিনে বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার কয়েকটি এলাকায় পাহাড়ী টিলা কেটে মাটি বিক্রি করায় পাদদেশের বসতবাড়ীগুলো অত্যন্ত ঝুকিতে থাকতে দেখা গেছে। জুড়ীা ভজিটিলা নামক একটি বিশাল টিলা শুস্ক মওসুমে কেটে ফেলায় নিচের প্রায় ২০০ পরিবারের সহ¯্রাধিক নারী-পুরুষ মারাত্মক ঝুকি নিয়ে বসবাস করছে। বসতবাড়িগুলোতে দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে। এলাকার বাসিন্দা সেলিম মিয়া, জুলেখা বেগম, রুবেল আহমদ, পারভিন বেগম, ডেইজি বেগম, আব্দুস সহিদ প্রমূখ জানান, শুস্ক মওসুমে অবাধে এসকল এলাকায় পাহাড় কাটা চলে। বর্ষায় কিছুটা কম হলেও থেমে থাকে না পাথর খেকো চক্র। প্রভাবশালী একটি চক্রের ছত্রছায়ায় স্থানীয় লোকজন প্রতিবছর টিলা কেটে মাটি ও পাথর বিক্রি করছে। পরে মাটি কাটা স্থানে নির্মাণ করছে বসতঘর। আইনী ঝামেলা এড়াতেই ওই স্থানে বসতবাড়ি নির্মানের জন্য কৌশলে ভুমিহীন অথবা হতদরিদ্র মানুষকে বসিয়ে দেয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন অথবা সরকারী পাহাড়ী টিলার পাদদেশে বসতবাড়ি নির্মাণ করে থাকা লোকজনকে ওই প্রভাবশালী চক্র নানাভাবে প্রলোভনে ফেলে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অভাবী লোকদের পাহাড়ী টিলা কাটতে উদ্ভুদ্ধ করে। স্থানীয়রা জানান, জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় পাহাড়-টিলায় মারাত্মক ঝুকি নিয়ে অন্তত ৫ হাজার মানুষ বসবাস করছে।
বড়লেখার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের চুড়ায় অন্তত ২০ হাজার মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। বর্ষায় অতিবর্ষণে পাহাড় ধসে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটলেই কেবল প্রশাসন দৌড়ঝাপ শুরু করে। অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা এড়াতে প্রচারনা আর নানা সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হলেও পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন না করায় হতাহতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
গত কয়েক দিনের মুষলধারে বৃষ্টির কারনে বড়লেখার দুর্গম বোবারথল, ডিমাই, তেরাদরম, কাশেমনগর, বিওসি কেছরিগুল এলাকায় পাহাড়ী চুড়ায় ও টিলার পাদদেশে নির্মিত বসত ঘরের আশ পাশের মাটি ধসে গেছে। যেকোন সময় প্রাণহানীসহ বড় ধরনের দূর্ঘটনার আশংকা রয়েছে। ইতিপুর্বে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী আব্দুল হাসিবের বসতঘর মাটি চাপা পড়লেও অলৌকিভাবে পরিবারের ৬ সদস্য বেঁচে যায়। এর কয়েক দিন আগে ওই এলাকায় আরেক ব্যক্তি পাহাড় চাপায় প্রাণ হারান। এর আগের বছর শাহবাজপুর চা বাগানে পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। স্থানীয় সুত্রে জানা যায় বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলায় ইতিপুর্বে অবৈধভাবে টিলার মাটি কাটতে ও পাহাড় ধসে অন্তত: ২০-২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনায় পাহাড়ের চুড়া ও পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার আহবান জানিয়ে বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা প্রশাসন গত ১৪ জুন সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাইকিং করেছে। দুই উপজেলার উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, থানার ওসি, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা ঝুকিপুর্ণ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
বড়লেখা ইউএনও এসএম আবদুল্লাহ আল মামুন, জুড়ী ইউএনও মিন্টু চৌধুরী ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজাদের রহমান জানান, পাহাড়-টিলা ধসে পড়ার আশংকা রয়েছে এমন জনবসতি এলাকায় তারা পরিদর্শন করেছেন। ঝুকিপুর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদেরকে পাহাড়-টিলায় বসবাস না করতে এলাকায় গণসচেতনতা মুলক মাইকিং করতে বলা হয়েছে।
মন্তব্য করুন