অযত্ন ও আর অবেহলায় ঝোঁপ ঝাড়ে আবদ্ধ কমলগঞ্জের শমশেরনগর বধ্যভূমি
প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ॥ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরের ভূমিকা ছিল অনেক বেশী। সে ভূমিকার কথা স্মরণ করে সরকারী অর্থায়নে শমশেরনগর-কুলাউড়া সড়কের বিমান বন্দর এলাকায় বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আবার বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভের পাশেই সরকারী অর্থায়নে আরও একটি সম্মুখ সমর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। প্রতি বছরে স্বাাধীনতা দিবস ও আর বিজয় দিবস এলে এক দিনের জন্য বধ্যভূমি পরিষ্কার করে শুধু পুষ্পার্পণ ছাড়া সারা বছর থাকে অযতœ আর অবহেলায় ঝোঁপঝাড়ে আবদ্ধ এ বধ্যভূমি।
সোমবার ১২ ডিসেম্বর বিকালে সরেজমিন শমশেরনগর বধ্যভূমি এলাকায় গিলে দেখা বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভের ফটকে তালা ঝুলে আছে। পুরো স্মৃুতস্তম্ভ এলাকা ঝোঁপঝাড়ে ভরা। সামনে বাঁশ ঝাড়ের আগাছা ফেলে প্রবেশ পথ বন্ধ রাখা আছে। স্মৃতিস্তম্ভের পাকা স্থাপনা দেখে মনেই হয় না ২৬ মার্চের পর আর একদিনও পরিষ্কার করা হয়নি।ঝেঁঅপ ঝাড়ে আচ্ছাদিত থাকায় বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ এলাকায় বিষাক্ত সাপেরও ভয় রয়েছে। ২০০৮ সালের ১৮ আগষ্ট তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান এ বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেছিলেন। তার পাশে ২০০১২-২০১৩ অর্থ বছরে মুক্তিযুদ্ধকালীণ উল্লেখযোগ্য সম্মুখ সমরের স্থানগুলো সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হয়েছে “ শমশেরনগর সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ”।
বধ্যভূমি স্মৃতি স্তম্ভ ও সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ দুটিই নির্মাণ করে গণপূর্ত বিভাগ, মৌলভীবাজার। মৌলভীবাজারের গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শরিফ উদ্দীন জানান, শমশেরনগর বধ্যভূমি নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ৮ লাখ ২৬ হাজার টাকায়। আর সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ৪৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা। মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টরের কমলপুর সাব সেক্টরের সাব কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব:) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শমশেরনগর বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ ও সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ দুটিই রক্ষণা বেক্ষণ করবেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। তিনি আরও বলেন, শমশেরনগর বাজার থেকে কিছু দূরে ও নির্জন স্থানে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হওয়ায় এখানে দায়িত্বের অবহেলা হচ্ছে। যেহেতু বিমান বাহিনীর নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ এলাকায় এটি সেহেতু একটু উদ্যোগী হলে বিমান বাহিনী কর্তৃপক্ষ এটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শমশেরনগর থেকেই বৃহত্তর সিলেটের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, বধ্যভূমি রক্ষাণা বেক্ষণের বিষয়ে শমশেরনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। শমশেরনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জুয়েল আহমদ বলেন, ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। আর উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্পন করা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে ঢাকার রেস কোর্স ময়দানে ৭ই মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষনের পর থেকে প্রতিদিন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরে মুক্তিপাগল মানুষজন পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মিছিল ও সভা করতেন। এ খবরটি স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা আরিফ মুন্সী ও তার অনুসারীদের মাধ্যমে মৌলভীবাজার জেলা সদরে অবস্থানরত পাক সেনা বাহিনীর কর্তাদের কাছে পৌছে যায়। মার্চ মাসের ২০ তারিখের পর থেকে পাক সেনা বাহিনী একটি পিক আপ নিয়ে প্রতি দিন বিকালে শমশেরনগরে টহল দিতে এসে বাঙ্গালীদের ভয় ভীতি প্রদর্শণ করতো। পাক সেনা বাহিনীর টহল দল শমশেরনগরে প্রবেশ করলে নিরস্ত্র বাঙ্গালীরা ভয়ে দৌড়ে পলাতেন। ২৭ মার্চ পাক সেনারা শমশেরনগরের ৮০ বছর বয়সী যাদুকর সিরাজুল ইসলামকে ব্যয়নট কুছিয়ে ও পরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল শমশেরনগর বাজারে।
এতে শমশেরনগরের মানুষজন পাক সেনাদের প্রতিরোধে মারমুখী হয়ে উঠেন। মধ্য মাচ্যে পাক সেনা বাহিনীর বাঙ্গালী কর্তা খালেদ মোশাররফকে পাঠানো হয়েছিল নকশাল দমনের জন্য শমশেরনগরে। স্থানীয় সরকারী ডাক বাংলোয় অবস্থান নিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ স্থানীয় আন্দোলনকারীদের ডেকে নিয়ে সভা করে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে এলো পাতাড়ি না করে একটি পরিকল্পিত হামলার সু-পরামর্শ দিয়েছিলেন।
পাক সেনা প্রতিরোধে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সর্ব প্রথম শমশেরনগরে পরিকল্পিত অভিযান চালিয়ে একজন ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলসহ ১১ পাক সেনাকে হত্যা করেছিল মুক্তি পাগল এলাকাবাসী। তার পর থেকে পাক সেনা বাহিনী স্থানীয় সরকারী ডাক বাংলোয় শক্ত ক্যাম্প স্থাপন করে নিরিহ বাঙ্গালীদের ধরে এনে বট গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন ও নির্যাতন কক্ষে নির্যাতনের পর শমশেরনগর বিমান বন্দরের রানওয়ের উত্তর পশ্চিম কোণের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করেছে।
মন্তব্য করুন