অরিত্রীদের জন্য ধরিত্রীকে বাসযোগ্য করতে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে?
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ কবি সুকান্তের কবিতার অমর পংক্তিমালা দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। “প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি নবজাতকের কাছে এই আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।” নবজাতকের কাছে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃঢ় অঙ্গিকারই পারে একটি মানবিক সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন করতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা ছিল এ দূর্ভাগা দেশ হতে হে মঙ্গলময়। দূর করে দাও সর্বতুচ্ছ ভয়। আমরা যেমন পারিনি নবজাতকদের কাছে এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে তেমনি আমাদের ভয়ভীতিকে ও দূর করতে পারিনি সামাজিক অস্থিরতা ও অসহিঞ্চুতার কারণে। রাজধানীর ভিকারুন নিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাতী শাখার নবম শ্রেণীর ছাত্রীর (১৫) বাবা দিলীপ অধিকারীকে শিক্ষকরা ডেকে অপমানের জের ধরে ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ইং তারিখে অরিত্রী অধিকারী আতœহননের পথ বেছে নেয়। এ নির্মম ও নিষ্ঠুর ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক হলেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসি, প্রভাতী শাখার প্রধান জিন্নাত আরা এবং শ্রেণীশিক্ষক হাসনা হেনা। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের গঠিত তদন্তে শিক্ষার্থী আতœহননের প্ররোচনার জন্য এই তিন শিক্ষকের বিরূদ্ধে অভিযোগ পাওয়ায় বিভাগীয় মামলা সহ অন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় অপরাধে জড়িত থাকা অভিযুক্তদের রিরূদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে নিদের্শনা দেয়া হয়েছে বলেও জানান শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। পরীক্ষায় নকলের অভিযোগে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারীকে অপমানের কারণেই রাজধানীর শান্তিনগরে গলায় ফাঁস দিয়ে আতœহত্যা করে অরিত্রী অধিকারি। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেছেন তদন্ত প্রতিবেদনে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের যে সব অনিয়ম ও অসঙ্গতি রয়েছে সে গুলোও উঠে এসেছে। অনেকগুলো অনিয়মের অভিযোগ গার্ডিয়ান ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরূদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের নিদের্শ দেওয়া হয়েছে। অরিত্রীকে নিয়ে অনেক ক্ষোভ হতাশা, তীব্র অসন্তোষ সারাদেশে। দেশের অনেক শিক্ষার্থীই শিক্ষার পরিবর্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পায় অমানবিক আচরণ, শাসনের নামে নিষ্ঠুর নির্যাতন, অনাদর, অপমান আর অবহেলা। ৮ ডিসেম্বর ২০১৮ইং তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য, এগার মাসে ১৭১ শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং ২ জন আতœহত্যা করেছে। শিক্ষকদের বলা হয় গার্ডিয়ান অব সিভিলাইজেশন আরকিট্যাক্ট অব দ্যা ন্যাশান। সমাজজীবনের অবক্ষয়ের সময় যারা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সচেষ্ট থাকেন তাদের অন্যতম পুরোধা হলেন শিক্ষক সমাজ। যারা সত্যিকারের শিক্ষক তারাই শিক্ষার আলো দিয়ে আমাদের সমাজ ও দেশকে আলোকিত করেন। ভিকারুন নিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের এই ঘটনায় প্রতীয়মান হয় একটা চুড়ান্ত অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে চলছি আমরা। সামাজিক মূল্যবোধ গুলো এক এক করে যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি দিন দিন যেন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সমাজ যেন দিন দিন পিছনের দিকে যাচ্ছে। আলোর দিকে না গিয়ে আমাদের সমাজ যেন যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। শিক্ষকরা অভিভাবককে অপমানের খবর আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের চুড়ান্ত রূপটিই যেন প্রকাশ করেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই”। সুতরাং জীবনের গুরুত্ব অনেক। আতœহত্যা কোন সমাধান নয়, বেঁচে থাকতে হবে, বেঁচে থেকে অনিয়মের বিরুদ্ধে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। জীবনকে উপভোগ করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে আকাংখা জাগাতে হবে বেঁচে থাকার মাঝে জীবনের সার্থকতা, আতœহত্যা মহাপাপ, আতœহত্যা জঘণ্য অপরাধ। সকল শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে মোবাইল ফোন নিয়ে পরিক্ষার হলে প্রবেশ নিষেধ। জানা গেছে অরিত্রী মোবাইল নিয়েই পরিক্ষার হলে ঢুকেছিল। নকল ধরে শিক্ষকরা তার পরিক্ষা বাতিল করতে পারতেন অথবা মোবাইল ফোনটি নিয়ে স্কুলে রাখতে পারতেন। মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে অপমান করার কোন প্রয়োজন ছিল না। শিক্ষকদের যেমন বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে ধৈর্যশীল ও সহনশীল হতে হবে, সন্তান-সন্ততি যাতে আতœহত্যার দিকে না যায় সে জন্য অভিভাবকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। যে কোন অভিভাবক দেশের সম্মানিত নাগরিক, বাংলাদেশের সংবিধান বলে দিয়েছে বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র যেখানে সব ক্ষমতার মালিক হবে জনগণ। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় দেশের জনগণ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, অকাতরে রক্ত দিয়েছে, নির্যাতন সহ্য করেছে। তারপর তারা পেয়েছে দেশের মালিকানা। শিক্ষকরা যেখানে ছাত্রের অভিভাবককে সম্মান করার কথা সেখানে অপমান দেশের কোন বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারে না। এ সমস্ত শিক্ষকদের শিক্ষক বলা যায় না। ভিকারুন নিসা নুন স্কুলের এই ঘটনা শিক্ষকদের প্রতি নেতিবাচক ধারনার জন্ম দেয়। এই ঘটনা দেশের মানুষের বিবেককে তাড়িত করেছে। শিক্ষক মানে আমরা বুঝি তিনি হবেন আলোকিত এক মানুষ। শিক্ষকদের মানবিক গুণাবলী থাকবে। তিনি হবেন জাতির মেরুদন্ড, শিক্ষকরা হবেন রাষ্ট্রের ও আদর্শ। একটি মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গঠন করতে হলে সময়ের দাবি হলো শিক্ষকদের কাউন্সেলিং করা। শিক্ষকদের শিশুবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করাও দরকার। যে সমস্ত শিক্ষকরা অভিভাবকদের গোয়ালঘরের রাখালের মতো মনে করেন তারা হচ্ছেন শিক্ষক নামের কলংক। তাদের দ্বারা আর যাই হোক সু-শিক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। শিক্ষা সম্পর্কে মোতাহার হোসেন চৌধুরীর মত হলো, “মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীবসত্ত্বা সেই ঘরের নিচের তলা আর মানবসত্ত্বা বা মনুষ্যত্ব ওপরের তলা। জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্ত্বার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা।” কিন্তু আমরা জীবসত্তার মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে গেলাম। মানবসত্ত্বায় উত্তীর্ণ হতে পারলাম না। অন্যায়, অসত্য আর অমঙ্গলের চিন্তা থেকে যতদিন না আমরা মুক্ত হতে পেরেছি ততদিন আমরা জীবই হয়ে থাকবো। মানবসত্ত্বায় পৌঁছাতে পারবো না। প্রমথ চৌধুরী বলে গেছেন “সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত”। কিন্তু আমরা শুধু শিক্ষিতই রয়ে গেলাম, সার্টিফিকেটের বোঝাই বয়ে গেলাম, সুশিক্ষিত হতে পারলাম না। কখনো কখনো আমরা ন্যায়-অন্যায় বুঝার চেষ্টা করি না। সত্যকে উপলব্ধি করার প্রয়াস রাখি না। আমরা আমাদের মানবিক গুণের কথাও ভাবি না। সুশাসনের পূর্বশর্ত হলো সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। শিশু শিক্ষার্থীদের অপমান বা নির্যাতনের কারনে বা অন্যান্য কারনে আতœহত্যার ঘটনা নতুন নয় বিভিন্ন সময় আতœহত্যার ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। শিশুদের সুরক্ষার জন্য উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শিশুদের সবধরনের শারিরীক ও মানসিক সহিংসতা, আঘাত, অবহেলা, নির্যাতন থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ আইনি, প্রশাসনিক, সামাজিক, শিক্ষামূলক ও সচেতনতা মূলক পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ সহ ১৯৬ টি দেশ এ সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শিশু অধিকার বাস্তবায়নের অঙ্গিকার করেছে। সরকার ২০১১ সালে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের এক পরিপত্র জারির মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুর শারিরীক শাস্তি নিষিদ্ধ করেছে। শারিরীক শাস্তি নিষিদ্ধ হলেও মানসিক শাস্তি বা অপমান এবং অবহেলার বিষয়টি উপক্ষিত রয়ে যাচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ, প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন জোরদার করাও জরুরী। পৃথিবীতে ৫৪টি দেশে আইন করে শিশুর প্রতি শারিরীক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিশুদের শারিরীকও মানসিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে হলে আইন প্রণয়নের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। ভিকারুন নিসা নুন এর শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে তাদের দাবি গুলো হলো :
১। শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
২। অধ্যক্ষ সহ দোষী শিক্ষকদের পদত্যাগের লিখিত আদেশ জনসম্মুখে দেখাতে হবে।
৩। ঘটনার সাথে জড়িতদের আইন অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৪। কথায় কথায় টিসির ভয় দেখানো যাবেনা।
৫। শিক্ষকদের মানসিক চিকিৎসক দিয়ে কাউন্সেলিং করতে হবে।
৬। গভর্নিং বডির সবাইকে অপসারণ করতে হবে।
যারা আদর্শ শিক্ষক তাদের নিজ সন্তানের প্রতি যেরকম ভালবাসা থাকে তেমন ভালবাসা থাকে শিক্ষার্থীদের প্রতিও । যারা নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন উত্তম শিক্ষক তাদের ও সংঘবদ্ধ ভাবে শিক্ষক নামক দানবদের প্রতিহত করার অঙ্গীকার থাকতে হবে। সেই অঙ্গীকারই শিশুদের জন্য এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে পারে। লেখক মোহাম্মদ আবু তাহের লেখক ও ব্যাংকার।
মন্তব্য করুন