অহংকারের একুশ আমাদের আত্মপরিচয়
মকিস মনসুর॥ মায়ের গর্ভ থেকে এসেই আমরা প্রথম যে ভাষার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তাহা হলো আমার প্রানের বাংলা।
মানুষের কাছে যেসব বিষয় তার প্রাণের মতোই প্রিয়, মাতৃভাষা তার অন্যতম। মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে, তুলে ধরে তার জাতিসত্তার পরিচয়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কোনো জাতিই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, পারে না নিজের পরিচয়কে পৃথিবীতে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করতে।
মাতৃভাষা বিশেষ কোনো ব্যক্তি-মানুষের যেমন অন্যতম পরিচয়-উৎস, তেমনি তা একটি জাতিসত্তার অস্তিত্বেরও শ্রেষ্ঠ স্মারক। যে জাতির মাতৃভাষা যত উন্নত, সে জাতি সব দিক থেকেই তত উন্নত-এমন ধারণা সর্বজনস্বীকৃত। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীতে অনন্য ভাষার চেয়ে গর্বের এই জন্য যে, তা একটি রাষ্ট্রের জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশ ছাড়া এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। আমাদের দেশই পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। বাঙালির ইতিহাসে মাথা উঁচু করে বলার মত যত ইতিহাস রচিত হয়েছে, তার মধ্যে বাংলা ভাষার ইতিহাস অন্যতম। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধানতম ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র।
এ দেশের ৯৮.৯ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। ভাষাবিকাশের ইতিহাসে ১৩৭২ বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ পুরোনো এ ভাষা। পাল এবং সেন সাম্রাজ্যের প্রধান ভাষা ছিল বাংলা। সুলতানি আমলেও এ অঞ্চলের অন্যতম রাজভাষা ছিল বাংলা। মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য রচিত হয়েছিল বাংলায়। আরাংকান রাজসভার আনুকুল্যে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত সমৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী বাংলার নবজাগরণ উত্থান এবং বাংলার কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক বিকাশকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছিল বাংলাভাষা ও সাহিত্য।
ইতিহাসে হার না মানা বাঙালি জাতির পরিচয় যে বাংলা ভাষা, সেটি বিশ্বজয় করতে সময় লেগেছে মাত্র ৫২ বছর। এই ৫২ বছরের ৫২ সালের ইতিহাসের যেমন অবয় ঘটবে না বাঙালি হৃদয় থেকে, তেমনি বিশ্ব মানচিত্রে একমাত্র ভাষার জন্য রক্তদাতা জাতি হিসাবে সমুন্নত থাকবে বাঙালির শির।
মানুষের ভাষা ব্যবহারের সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান সপ্তম। জাতিসংঘের ৬টি দাপ্তরিক ভাষা রয়েছে- আরবি, চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, রাশিয়ান ও স্প্যানিশ। পৃথিবীতে চার সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে সপ্তম স্থানে থাকা বাংলা ভাষা প্রকৃত অর্থেই দাবি করতে পারে গৌরবের আসন।
বিশ্বের প্রায় ২৫ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ সংখ্যাতত্ত্বও আমাদের মাতৃভাষায় গৌরবের অন্যতম ভিত্তি-উৎস।ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ রফিক-সালাম-বরকত- জব্বারকে বাঙালি জাতি ও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। তাঁদের সাহসী ভূমিকা ও গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগের ফলেই পাকিস্থানি ঔপনিবেশিক শক্তির ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়, রা পায় বাংলা ভাষার অনন্য গৌরব। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা রার অস্তিত্বের রাজপথের মিছিলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর এর রক্তের বিনিময়ে আমাদের বাংলা ভাষা আমাদের বর্ণমালা, ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত দিনটিই মহান শহীদ দিবস হিসাবে জাতি পালন করে আসছে।
২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদানদের নাম নিচে দেয়া হলো:
ভাষা শহীদ আবদুস সালাম,ধর্মের দ্বৈরথে ভাঙ্গলো ভারত। মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠলো পাকিস্তান রাষ্ট্র। কিন্তু এক ধর্মের মানুষে এত বৈষম্য কেন? ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রশ্নে দুই প্রান্তে আকাশ পাতাল ব্যবধান। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় শাসন মেনে নেওয়া যাচ্ছে না আর। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে উর্দু ভাষা। মন ব্যথিত হয়ে ওঠে আবদুস সালামের। অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে ঢাকায় এসেছেন তিনি। পড়ালেখার বড় শখ ছিল। অভাবের তাড়নায় ম্যাট্রিক ফাইনালটা দেওয়া হলো না। শিক্ষার চেয়ে পেট বাঁচানো আগে জরুরি। এখন ছোটখাটো একটা চাকরিতে আয়েশ না হোক, পরিবারের খরচটা জুটে যায়।
এই কদিন আগে গ্রাম থেকে ঘুরে এলেন। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মা নিজের হাতে পাত্রী পছন্দ করছেন। সামনের শীতে বিয়ে হবে। কাজের ফাঁকে সালামের বড় ভাল লাগে এসব ভাবতে।
ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন, মানিকগঞ্জের রফিক উদ্দিনের গল্পটা আবার অন্যরকম। জগন্নাথ কলেজে পড়ার পাশাপাশি বাবার সাথে প্রেসের ব্যবসা শুরু দিয়েছেন। অনেকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে এই প্রেসে আদর্শলিপি ছাপান তিনি। প্রতিটা অক্ষর ছাপানোর সময় গভীর মমতায় ছুঁয়ে দেখেন। একদিন এই ভাষা ব্যবহারের উপর শাসকের বাধার কালো হাত থাকবে না। সে হাত ভেঙ্গে দিতে হবে। মায়ের ভাষার উপর কারো খবরদারি চলবে না। তাই তো ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় রফিক উদ্দিন। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি রাঙানো হয়েছে তার রক্তে।
ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার, ময়মনসিংহের আব্দুল জব্বারের পড়ালেখা একদমই আগায় নি। একদম ছেলেবেলায় ঘর পালিয়ে বার্মা পাড়ি জমান। এক যুগ পরবাসে কাটিয়ে দেশে ফিরেন তিনি। জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়ে বিয়েটা করে সংসারী হলেন। একটা ফুটফুটে পুত্রসন্তান এলো ঘর আলো করে। এতটুকু পুতুলের মত একটা মানুষ! আব্দুল জব্বারের বুকটা মায়ায় ভরে যায় ছেলেকে কোলে নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা যে বড় কঠিন। শাশুড়ির চিকিৎসা করাতে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করান। চার মাস বয়সী দুধের সন্তানের কথা ভেবে বুকে অনবরত রক্তক্ষরণ হয় তাঁর।
ভাষা শহীদ আবুল বরকত, সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া আবুল বরকত বরাবরই পড়ালেখায় ভাল। উচ্চ পর্যায়ের পড়াশোনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে পাড়ি জমালেন তিনি। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। অত্যন্ত মেধাবী বরকতকে আলোড়িত করলো ভাষা আন্দোলন। ভাষার টান যে প্রাণের প্রতি স্পন্দনে। আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। ছাত্র জনতার সাথে মিছিলে নেমে পড়লেন বরকত। ভাষার দাবী যে সবার আগে!
ভাষা শহীদ শফিউর রহমান,
ভাষা শহিদ শফিউর রহমান হাইকোর্টের একজন কর্মচারী। ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল দশটার দিকে রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। সকাল প্রায় সাড়ে দশটায় নওয়াবপুর রোডে, দৈনিক সংবাদ’ অফিসের সামনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া মিছিল সংগঠিত হয়। সেখানে পুলিশ ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের একটি গুলি সোজা অফিস গমনরত শফিউর রহমানের পিঠে এসে লাগে। দ্রুত তাকে তৎক্ষণাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তাঁকে ডা. অ্যালিনসন তার অপারেশন করেন। কিন্তু বিধি বাম! ঐদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
একুশের পথ ধরেই বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি বাংলার স্বাধীনতা, লাল বৃত্ত সবুজ পতাকা, একুশ আমাদের অহংকার, একুশ আমাদের গৌরব ও গবের প্রতীক।
একুশ মানে রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের মায়ের মুখের ভাষা। একুশ মানে বাঙালি জাতির অন্যায়ের সাথে আপোস না করার গৌরবময় ইতিহাস। একুশ আমাদের অহংকার : একুশ আমাদের আত্মপরিচয়, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতিসত্তা ও ভাষাভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষাসহ সকল সংগ্রাম ও আন্দোলনের উৎস ও প্রেরণা। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক বাঙালির অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হলে আমাদের সেই চেতনাই বিশ্বে প্রসারিত হয়। জাতিসংঘের ঘোষণায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এ দিবস ‘১৯৫২ সালের একুশে ফ্রেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি’।
আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯ সালে ১৭ই নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো সদর দফতরে প্রস্তাব পাঠানোর পর দীর্ঘ পরিক্রমায় ২০০০সালে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিশ্বজয় তথা আরেকটি নব ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। আমাদের মাতৃভাষার জন্য এ এক বিশাল গৌরব। যাহা আজকের এই লেখার মাধ্যমে আবার উপস্থাপন করছি।
২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ পরিণত করার ভাবনা প্রথমে আসে কানাডার ভাংকুভারে প্রবাসী বাঙালি জনাব রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের মাথায়। বাংলা ভাষা রার জন্য বাঙালিরা প্রাণ দিয়েছে, কাজেই তাদের এই অবদানের সম্মানার্থে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে যেন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করা হয়, এ ব্যাপারে তারা ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে চিঠি লেখেন। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করার এই দাবি উপস্থাপন করেন কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা-প্রেমিক একটি গোষ্ঠী। দাবির সমর্থনে স্বার করেন সাত জাতির সাত ভাষার ১০ জন সদস্য। ইতিমধ্যে প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে। এরপর জাতিসংঘ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে তারা বিষয়টি প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে প্রেরণ করেন। সেখান থেকে তাদের ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে জানানো হলো, ‘তোমাদের বিষয়টি খুবই ইন্টারেস্টিং, ইউনেস্কো এ ধরনের প্রস্তাব পেলে আলোচনা করে থাকে। বিষয়টি অক্টোবরে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ইউনেস্কো সম্মেলনে তুলতে হবে এবং তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে হলে চলবে না, কোনো সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক অফিসিয়াল ভাবে উত্থাপন করতে হবে।’ এরপর রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম বিষয়টি সবিস্তারে ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠান। এদিকে হাতে সময় ছিল খুবই কম। কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনেস্কো সদর দফতরে এ প্রস্তাব পাঠানোর শেষ তারিখ ছিল ১০ সেপ্টেম্বর।
তৎকালিন শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিষয়টি তাৎণিকভাবে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ম্যাদার অব ইউম্যানিটি শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে আনলে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে সময় নষ্ট না করে ত্বরিত সিদ্ধান্ত দেন প্রয়োজনীয় পদপে নেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে শিা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা সংরণ’ সম্পর্কিত ইউনেস্কোর নীতিমালার আলোকে ইউনেস্কোর ৩০ তম সাধারণ সম্মেলনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করার ব্যাবস্থা করা হয়।
প্রস্তাবটি প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দফতরে নেয়া হয়। এরপর ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কো সচিবালয়ে এ প্রস্তাব নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে বাজেটের কথা বিবেচনা করে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। মহাপরিচালকের মতামত এই প্রস্তাবটিকে রীতিমতো অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের শেষ আশা জাগিয়ে তোলে ইউনেস্কোর অধিবেশনে যোগদানকারী শিামন্ত্রীর নেতৃত্যে একটি বড়সর বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, দতা ও বিচণতা এ ব্যাপারে মূল্যবান অবদান রাখে। ইউনেস্কোর ডেপুটি মহাসচিব কলিন পাওয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, আমাদের প্রস্তাাবে যে বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে তা হলো, পৃথিবীর বুক থেকে দ্রুত বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করা এবং তা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে বৃহত্তর সচেতনতা গড়ে তোলা। বাংলাদেশের প্রস্তাবটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একজিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণের সুপারিশ করেন। পাকিস্থানসহ সার্ক এবং প্রতিবেশী অন্যান্য ২৮ টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রস্তাবকে লিখিতভাবে সমর্থন জানায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রস্তাবটি যদি একবার পরীক্ষা নিরিক্ষা জন্য একজিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণ করা হতো তাহলে আর কোনো দিন তা আলোর মুখ দেখত বলে মনে হয় না। ইউনেস্কোর টেকনিক্যাল কমিটি কমিশন-২ এ বাংলাদেশের প্রস্তাবটি পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী উত্থাপিত হয় ১২ নভেম্বর। কারো কোনো আপত্তি না থাকায় সভাপতি তিনবার হাতুড়ি পিটিয়ে প্রস্তাবটি গৃহীত হলো বলে ঘোষণা দিলেন। হাততালিতে মুখরিত হলো সম্মেলন কক্ষ।
এরপরের ঘটনা গতানগতিক। কমিশন-২-এ পাস হওয়া প্রস্তাবটি ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সাধারণ সম্মেলনে রুটিন বিষয় হিসেবেই গৃহীত হয়। ৪ জানুয়ারি ২০০০ তারিখে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক কাইচিরো মাটসুরা এক চিঠিতে ইউনেস্কোর সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি তখন থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধু মাতৃভাষার জন্য আমাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকেই স্বীকৃতি দেয়নি, অমর একুশের শহীদদের আত্মদান থেকে উৎসারিত স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জনকেও মর্যাদা দিয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের পৃথিবীর বুকে মহিমান্বিত করেছে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ২১৫ টি দেশে প্রতি বছর আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে উদযাপন করে আসছে।
“একুশের চেতনা, একাত্তরের চেতনা একই চেতনার ধারাবাহিকতা তথা একই সূত্রে গাঁথা, একুশের চেতনার পথ ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা বিজয় অর্জন করি। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা দাবি করতে পারি না আমরা আমাদের বিজয়কে পুরোপুরি সুসংহত করতে পেরেছি। একাত্তরের চেতনা একুশের চেতনার প্রধান শত্রু হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার ডালপালা বাংলাদেশ এখনও রয়ে গেছে। আমরা সেই সাম্প্রদায়িকতার ডালপালা উপড়ে ফেলতে চাই। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য
কন্যারত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলে সুসংহত করতে চাই এটাই হোক এবারের একুশের শপথ।’
আমাদের আগামী প্রজন্ম নিশ্চয় একুশের চেতনা সঠিকভাবে বুকে ধারণ করবে। আর সেই চেতনায় গেয়ে উঠবে- আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই। আমি আমার আমিকে চিনি এই বাংলায়।
এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বলেছিলেন যে, বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের একটি অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু বাংলা ভাষায় বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ কথা বলে এবং এ ভাষার শিল্প, সাহিত্য ও সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। আমাদের সংসদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, যাতে জাতিসংঘকে বাংলাকে তাদের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার অনুরোধ জানানো হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এই ন্যায্য অনুরোধটি গ্রহণ করার জন্য আমি আপনাদের সবার কাছে আন্তরিকভাবে আহ্বান জানাচ্ছি।’
এই দিন আমাদের জাতীয় গৌরবের দিন, আমাদের অস্তিত্বের ও অহংকারের স্মারক। কোনো বিভেদ নয়, সুষ্ঠু গণতন্ত্রচর্চার মধ্য দিয়ে একুশের ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের এগিয়ে যেতে হবে; একুশের হাত ধরে যে-ঐক্যের পরিচয় আমরা পেয়েছি।
বর্তমানে বিশ্বে ২১০ বিলিয়ন লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে এটি বিশ্বে সপ্তম মাতৃ ভাষা, বাংলা ভাষার রয়েছে অনন্য গৌরভ মর্যাদা ও অহংকারের ইতিহাস। সারা দুনিয়াতে ভাষার মর্যাদার জন্যেই বাঙ্গালী জীবন দিয়েছে। আর কোন জাতি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এমন ইতিহাস নেই। বাংগালী ভাষার জন্য পেয়েছে একটি দিন ২১ শে ফ্রেব্রুয়ারী। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ সমগ্র বিশ্বময় উদযাপিত হচ্ছে, সেটা আমাদের জন্য অবশ্যই গৌরবের, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভূলিতে পারি একুশ আমাদের অহংকার একুশ আমাদের আত্তপরিচয়. একুশের পথ ধরে আমরা প্রবাসে বহণ করে চলছি বাংলাদেশের লাল বৃত্ত সবুজ পতাকা; গৌরব ও গর্বের সাথে উচ্চারণ করছি বাংলা আমার দেশ. বাংলা আমার ভাষা।
সারা বিশ্বে বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করতে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাযা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবীতে বিশ্বময় যে ক্যাম্পেইন চলছে তাহা অব্যাহত রাখার দীপ্ত শপথ নেওয়ার আহবান সহ আসুন একই সাথে প্রবাসে বাংলা চর্চায় নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে এবং বহি -বিশ্বের বিভিন্ন স্কুলে বাংলা পাঠ্যবই হিসেবে নিতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে জীবনের সর্বস্তরে প্রচলন করতে হবে এবারকার ৭২ বছরের একুশ উদযাপনে এই হোক আমদের দীপ্ত শপথ,জয় বাংলা।
লেখক ও সাংবাদিক : মোহাম্মদ মকিস মনসুর, কার্ডিফ, ইউকে।
মন্তব্য করুন