(ভিডিওসহ) আকস্মিক বন্যা- বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন ও খাদ্য সংকট চরমে

June 20, 2018,

ইমাদ উদ দীন॥ বসত ভিটা বানের পানিতে ডুবন্ত। বন্যা কবলিতরা প্রাণ বাঁচাতে ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা বাসাবাড়ির ছাদে। চারদিকে পানি আর পানি। কিন্তু খাওয়ার মত বিশুদ্ধ পানির জন্য চলছে হাহাকার। নেই সেনিটেশন ব্যবস্থা। আর খাদ্য সংকটও চরমে।

মানুষের মত দূর্ভোগে পড়েছে গবাদি পশুও। এখন বন্যা কবলিতরা অন্তহীন দূর্ভোগে চরম অসহায়। চারদিকে শুধু নেই আর নেই। তাদের সব কেড়ে নিয়েছে আকস্মিক বন্যা। সহায় সম্বল হারিয়ে এখন তারা নি:স্ব। বলতে গেলে এখন মানবেতর দিন কাটছে বন্যার্তদের।

 গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করেছে বানের পানি। তাই প্লাবনের পানিতে ঘরবাড়ির মত তলিয়ে গেছে বিশুদ্ধ পানির উৎস নলকূপ (টিবওয়েল) ও পুকুরও। এরই সাথে ডুবেছে টয়লেট,ধান আর সবজি ক্ষেত। দূষিত বানের পানিতে ছড়াতে পারে পানিবাহিত নানা রোগবালাই।

বিশেষ করে ডাইরিয়া,পেটব্যাথা ও চর্মরোগের প্রার্দূভাব দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের। তাই এই এসময় এ ধরনের রোগবালাই থেকে রক্ষাপেতে ও আগাম সর্তক থাকতে পানি ফুটন্ত করে কিংবা পানি বিশুদ্ধ করন ট্যাবলেট দিয়ে তা জীবানুমুক্ত করে পান করার পরামর্শ চিকিৎসকদের।

১৩ জুন দুপুর থেকে এ জেলায় আকস্মিক বন্যায় দূর্ভোগের যাত্রা শুরু। গ্রামের মত শহরের বাসিন্দাদেরও দূর্ভোগের অবস্থা আরো ভয়াবহ। শহরের বন্যা কবলিত এলাকার প্রতিটি বাসাবাড়িতে পৌরসভাকর্তৃক সরবরাহকৃত বিশুদ্ধ পানির রির্জারভার এখন কয়েক ফুট পানির নীচে। আর নলকূপের পানি বিদ্যুতের মাধ্যমে ট্যাংকিতে রির্জাভ রাখার ব্যবস্থাও এখন অচল। কারন বন্যা কবলিত শহর ও গ্রামের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ রয়েছে বিচ্ছিন্ন। তাই খাওয়ার বিশুদ্ধ পানির যেমন চরম সংকট। তেমনি গোসল,রান্নাবান্না ও প্রয়োজনীয় কাজের ব্যবহারের জন্য মিলছেনা পানি। তাছাড়া টয়লেট ডুবে যাওয়ায় দূর্ভোগের অন্তনেই।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন অতীতের সকল বন্যার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবারকার বন্যা। মৌলভীবাজার শহরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন ১৯৮৪ সালে যে ভয়াভহ বন্যা হয়েছিল এবারকার বন্যা অনেকটাই তারই প্রতিচ্ছবি। আকস্মিক বন্যা হওয়ায় চোখের সামনেই সবকিছুই তলিয়ে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে পৌর এলাকার বাসাবাড়িতে অনেকের ঘরে খাদ্য থাকার পরও পানি ও বিদ্যুৎ না থাকায় তারা অর্ধহারে অনাহারে দিনযাপন করছেন বলে জানিয়েছেন। গ্রাম কিংবা শহরে গাড়ি চলাচলের রাস্তায় ৩ থেকে ৪ ফুট পানি থাকায় এখন সেখানে নৌকা চলাচল করছে। মৌলভীবাজার শহরের বন্যা কবলিত ৩টি ওর্য়াডের প্রতিটি বাসায় নৌকা ছাড়া বের হওয়া যাচ্ছেনা। একতলার বাসিন্দারা বাসার ছাদে কিংবা অনান্য তলায় আশ্রয় নিয়েছেন।

শহর এবং গ্রামের বন্যা কবলিত অনেকেই বানের পানি টেলে পা হেটে অথবা নৌকা যোগে দূর দূরান্ত থেকে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করছেন। তবে অনেক এলাকায়ই বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের কোন ব্যবস্থা না থাকায় বানের পানিই তাদের একমাত্র সম্বল।

জেলা প্রশাসন সুত্রে জানা যায় আর্কস্মিক বন্যায় এ পর্যন্ত জেলার ৪টি উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ৩০ টি ইউনিয়নের ৪০ হাজার পরিবারের ১ লক্ষ ৯৩ হাজার ৪শ জন মানুষ বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ৯.৭ শ মেট্রিক টন বরাদ্ধকৃত চাল ও নগদ ১০ লক্ষ টাকা বন্যা কবলিত এলাকায় বিতরণ করা হয়েছে।

এ ছাড়াও আরো ৫শ মেট্রিক টন চাল ও নগদ টাকা ত্রাণ সহায়তার জন্য চাহিদা পাঠানো হয়েছে। খোলা হয়েছে ৫০টি আশ্রয় কেন্দ্র। তাছাড়া জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে ৭৪টি মেডিকেল টিম বন্যা কবলিত এলাকায় কাজ করছে। তবে নতুন করে কোন এলাকা প্লাবিত হলে আশ্রয় কেন্দ্র ও মেডিকেল টিমের সংখ্যা বাড়ানো হবে। এমন প্রস্তুতিও রয়েছে তাদের। এছাড়া যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের তালিকাও করা হচ্ছে। যাতে বানের পানি চলে গেলে সরকারী তরফে তাদের ঘর বাড়ি মেরামতে সহযোগিতা করা যায়।

তবে ক্ষতিগ্রস্থ লোকজন জানিয়েছেন কুলাউড়া,কমলগঞ্জ,রাজনগর ও মৌলভীবাজারের মনু ও ধলাই নদীর তীরবর্তী প্রায় ৪০ টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার প্রায় চার শতাধিক গ্রামের ৪ লক্ষাধিক মানুষ এখন পানি বন্দি। তাদের ধারণা উজানের পানি আসা না কমলে ও ভারী বৃষ্টিপাত বন্ধ না হলে এই পরিসংখ্যান দ্বীগুন হবে। এমনটি আশঙ্কা তাদের।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান বন্যা কবলিত অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকার পানি জেলার হাকালুকি ও কাউয়াদিঘি হাওরে গিয়ে পড়ায় এখন নতুন করে হাওর তীরবর্তী এলাকাও বন্যা কবলিত হচ্ছে। বানভাসি মানুষের অভিযোগ সরকারী তরফে তারা পাচ্ছেননা পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী। তবে বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা,স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাছাড়া দেশ ও প্রবাসে থাকা অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে এসকল বন্যার্ত অসহায় মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। তারা রান্না করা খাবার, পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট,ওরস্যালাইন,মোমবাতি,ম্যাচ ও শুকনো খাবার বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করছেন। মৌলভীবাজার পৌর সভার উদ্যোগে শহরের বন্যা কবলিতদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে রান্নাকরা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি। বন্যার শুরু থেকে বিষয়টি তদারকি করছেন পৌর মেয়র মো: ফজলুর রহমান।

১৯ জুন মঙ্গলবার ব্যাক্তি উদ্দ্যোগে শহরের বন্যা কবলিতদের রান্নাকরা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করেন সাবেক পৌর মেয়র ফয়জুল করিম ময়ূন ও পৌর কাউন্সিলর মসুদ আহমদ। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠনগুলোও বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। প্রতিদিনই তারা সাধ্যানুযায়ী খাবার ও বিশুদ্ধ পানি বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করছেন। বন্যা শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর একটি দল পুরো জেলায় বন্যা কবলিতদের উদ্ধার, নদীর ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিরক্ষা বাঁধ মেরামত ও ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তাদের এমন প্রশংসনীয় নিরবিচ্ছিন সেবা কাজে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে বন্যার্তদের।

মৌলভীবাজার শহরের ধরকাপন এলাকার সৈয়দ মাহমুদ আলী,সৈয়দ হুমায়েদ আলী শাহিন, শাহ ইমরুল আক্তার  কয়েছ ও বড়হাট এলাকার আ.স.ম সালেহ সুহেল জানান গেল ২-৩ দিন থেকে তারা বিশুদ্ধ পানির জন্য চরম সংকটে ভোগছেন। বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় প্লাবনের পানিতে নিমজ্জিত থাকা বাসা যেমন আলোহীন অন্ধকার। তেমনি বিশুদ্ধ পানিহীনতায় খাবার পানিসহ রান্নাবান্নার কাজও অচল। তাছাড়া পানিবন্দি থাকায় বাসা থেকে বের হওয়াও যেমন কষ্ঠকর। তেমনি রাত দিন বন্দি অবস্থায় অন্ধকার বাসায় থাকাও যন্ত্রনার। বলতে গেলে বিশুদ্ধ পানি সংকট আর বাসায় খাবার থাকার পরও তা পানির অভাবে রান্নাবান্না না করতে পারায় চরম সংকটে শহরের বন্যা কবলিতরা।

কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের মো: আব্দুস ছালাম, মো: কনর মিয়া, শাহীদ আহমেদ ও মাছুম আহমদ জানান তাদের এলাকায় বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে রাস্থাঘাটের উপর দিয়ে প্রবাহিত বানের পানি অনেকটা কমলেও বসতবাড়ি থেকে এখন সরেনি পানি। তারা জানান তাদের এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি,স্যানিটেশন ও খাদ্য সংকট চরমে। তাদের মত একই অবস্থা জেলার অনান্য উপজেলার বন্যাদূর্গতদের।

জানা যায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণ মনু ও ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের অত্যন্ত ৩৫-৪০ টি স্থান ভাঙ্গন ও এখনো ভাঙ্গার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন সোমবার দুপুর থেকে জেলার বন্যা পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতি হচ্ছে। নতুন করে কুশিয়ারা নদীর ১-২টি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিলেও উজান থেকে ঢলের পানি কম আসায় ও ভারী বৃষ্টিপাত না হওযায় মনু,ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভাঙ্গার ঝুঁকি অনেকটাই কমছে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায় বন্যা কবলিতদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে জেলা জুড়ে ৭৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। তারা পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট,ওরস্যালাইন সহ প্রাথমিক চিকিৎসা ও ঔষধ দিচ্ছেন। এবং পানিবাহিত নানা রোগবালাই থেকে নিরাপদ থাকতে বন্যাকবলিতদের পরামর্শও দিচ্ছেন।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com