আজীবন লড়াকু একজন আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মোজাহিদ : অবশেষে হেরে গেলেন : চীরতরে চলে গেলেন : স্মৃতিকথা
মুজিবুর রহমান মুজিব ॥ দশ জানুয়ারী ১৭ জানুয়ারী মঙ্গলবার সকাল ছ’টায় মৌলভীবাজার জেলা সদরস্থ আড়াইশ-শয্যার আধুনিক হাসপাতালে আজীবন লড়াকু সৈনিক আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মোজাহিদ অবশেষে অসুখের কাছে হেরে গেলেন-চীর তরে চলে গেলেন। দশই জানুয়ারী ভোরের সূর্য্যােদয়ের সাথে মানব প্রেমিক আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মোজাহিদের জীবন প্রদীপ নিভে গেল। মহান মৃত্যোকে আলিঙ্গন করে তিনি চীরতরে চলে যান না ফিরার দেশে। রেডক্রিসেন্টের ভাইস-চেয়ারম্যান, জাতীয় অন্ধ কল্যান সমিতি মৌলভীবাজার জেলা শাখার অবৈতনিক সাধারন সম্পাদক আবু মোহাম্মদ ইয়হিয়া মোজাহিদ বেশ ক’বছর যাবত কিডনী জিিটলতায় ভূগছিলেন। কষ্টসাধ্য ও ব্যয় বহুল-ডায়লসিস-এর মাধ্যমে লেজারতির জীবন যাপন করছিলেন সমাজ কর্মি মোজাহিদ। পেশাগত ভাবে আইনজীবী এবং পারিবারিকভাবে ভালো ব্যবসা বানিজ্যের মালিক হলেও আইন পেশা কিংবা ব্যবসা কোন পেশায়-ই-জড়িত ছিলেন না বলিষ্ট সমাজ কর্মি মোজাহিদ। অন্ধ কল্যানে নিবেদিত প্রান হয়ে মাতারকাপনস্থ বি.এন.এস.বি চক্ষু হাসপাতালে সকাল-সন্ধ্যা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন এবং চক্ষু রুগীদের দেকভাল করতেন। ছুটির দিন ছাড়া এই চক্ষু হাসপাতালই ছিল তাঁর ধ্যান-প্রান-সকাল-সন্ধ্যা-দিবা রাত্রির মহাকাব্য। অপরূপ প্রাকৃতিক নিসর্গ, দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা এবং হাসপাতাল পরিচালনা পরিষদ ও কর্মকর্তা-কর্মচারিেেদর মায়া-মমতা আন্তরিকতায় দিন দিন চক্ষু রুগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বি.এন.এস.বি পরিচালিত সিলেট বিভাগের একমাত্র হাসপাতাল এবং হাসপাতালে কর্মরত চক্ষু চিকিৎসকদের পেশাদারিত্ব এবং সুনামের কারনে দৈনিক শত শত রুগী চক্ষু চিকিৎসা নিতে এই হাসপাতালে আসেন। হাসপাতাল পরিচালনায় রয়েছে একটি নির্বাচিত শক্তিশালী কমিটি। জেলা প্রশাসক সাহেব পদাধিকার বলে কমিটির সভাপতি। জেলার সিভিল সার্জন সহ সমাজের গন্যমান্য নাগরিক-সুশীল সমাজ এর সমন্বয়ে গঠিত নির্বাহী কমিটি এবং হাসপাতাল প্রশাসনের কর্ম্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে একটি চমৎকার সু-সম্পর্ক বিদ্যমান।
বেটে খাটো-মাজারি উচ্চতার গোলবাটা মুখ সমেত সুঠাম শরীরের অধিকারী নিঃস্বার্থ সমাজ সেবী আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মোজাহিদ জেলা সদরের একজন চেনা মুখ-প্রিয় মুখ-প্রিয় জন। ফর্সা চেহারার ক্লিনশেভে-আকর্ষনীয় পূরুষালি গোফ এর নিচে একচিলতে মুচকি-মিষ্টি হাসি লেগে থাকত সবসময়। কিডনি জটিলতার সঙ্গে ডায়বেটিশ-ব্লাড প্রেসার, বয়োঃবৃদ্ধি তাঁকে কাহিল করলেও কাবু করতে পারেনি। প্রিয়তমা জীবন সঙ্গিনী নারীনেত্রী বেগমআলেমা মোজাহিদ এর নিঃশর্ত সমর্থন ও সহযোগিতায় আইন পেশা ও ব্যবসা বানিজ্যের পরিবর্তে সার্বক্ষনিক সমাজ সেবা, রেডক্রিসেন্ট ও বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। শারীরিক চিকিৎসা সেবায় সঙ্গে নিয়মিত কিডনী ডায়লসিস চলছিল। গত ১৩ অক্টোবর তারিখ ব্রেন ষ্টোকে আক্রান্ত হলে তাঁকে নূরজাহান হাসপাতাল-সিলেটে ভর্তি করা হয়। অবস্থার উন্নতি না হলে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা থেকে চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী তাকে জেলা সদরস্থ আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানেই চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি ছেষট্টি বছরের যাপিত মানব জীবন শেষে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর লাশ সৈয়ারপুর সড়কস্থ নিজ বাসাবাড়িতে নিয়ে এলে কান্নার রোল উঠে। তার মৃত্যুসংবাদে জেলা শহরে শোকের ছায়া নেমে আসে। সৈয়ারপুর সড়কস্থ তাঁর নিজ বাসভবনে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে সমাজের সর্বশ্রেণী পেশার নাগরিকগণ ছুটেযান। সিপিবি’র কেন্দ্রীয় সম্পাদক কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমদ সহ সর্বদলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জেলার প্রবীন এই রাজনীতিবিদ এর প্রতি শেষ সম্মান জানান। ঐ দিন সকালে মাতার কাপনস্থ বি.এন.এস.বি চক্ষু হাসপাতালে মরহুমের লাশ আনা হলে এখানেও শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তার মরদেহের প্রতি পুস্পিত শ্রদ্ধা জানান সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মোশাহিদ আহমদ। এ সময় সংস্থার সভাপতি জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজার তোফায়েল ইসলাম সহ সমিতির কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ, হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর মরহুমের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মৌলভীবাজার পৌরসভা প্রাঙ্গনে। পৌর মেয়র মোঃ ফজলুর রহমানের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। সি.পি.বি.-র আয়োজনে এডভোকেট নিলিমেষ ঘুষ এর সঞ্চালনায় এই শ্রদ্ধানুষ্ঠানে মরহুমের কর্ম্মময় সংগ্রামী জীবনের উপর আরোকপাত করে বক্তাগন তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। বিকাল পৌনে পাঁচটায় টাউন ঈদগায় মরহুম ইয়াহিয়া মোজাহিদের বিশাল নামাজে জানাজায় উপস্থিত হয়ে জেলাবাসি এই মরহুম পৌর কমিশনারকে শেষ বিদায় জানান, তাঁর বর্ণাঢ্য কর্ম্ম জীবনের ভূয়শী প্রশংসা করতঃ তার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। এডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিবের সঞ্চালনায় জানাজা পূর্ব সমাবেশে প্রাসঙ্গিক ও প্রসংসাসূচক বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম, পৌর মেয়র হাজি ফজলুর রহমান, সাবেক মেয়র ফয়জুল করিম ময়ূন, মরহুমের কনিষ্ট ভ্রাতা জিয়াউল আলম খিজির এবং সভার সঞ্চালক মুজিবুর রহমান মুজিব। বক্তাগন মরহুমের বর্ণাঢ্য কর্ম্ম জীবন, তার সমাজ কর্ম্ম, শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের ভূয়শী প্রশংসা করতঃ রুহের মাগফিরাত এবং শোক সন্তপ্ত পরিবার বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। জানাজার নামাজ শেষে তাঁকে দরগাশরীফ গোরস্থানে দাফন করা হয়। যে মাটি ও মানুষের জন্য ইয়াহিয়া মোজাহিদ আজীবন আন্দোলন-সংগ্রাম-মিটিং-মিছিল করেছেন সেই সব মানুষের কাছ থেকে চীর বিদায় নিয়ে এই মাটির কোলে, এই শ্যামল মাটির কোমল বিছানায় চীর শয়ানে শায়িত হলেন তিনি। মরহুমের রুহ চীর শান্তিলাভ করুক, মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন-এই মোনাজাত। আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মোজাহিদ আদিতে আমাদের নিকট প্রতিবেশী হবিগজ্ঞি। মৌলভীবাজার হবিগঞ্জের নিকট প্রতিবেশি ঐহিত্যবাহী জেলা। প্রাচীন কাল থেকে দু’জেলার মধ্যে আসা যাওয়া-ব্যবসা বানিজ্য বিয়েশাদী চলছে। পিতার কর্ম উপলক্ষ্যে মুজাহিদ মৌলভীবাজার মহকুমা শহরের বাসিন্দা হন। পৌর এলাকাধীন সৈয়ারপুর সড়ক এলাকায় নিজস্ববাসাবাড়ি নির্মান করতঃ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
বয়সও লেখাপড়াগত ভাবে এহিয়া মোজাহিদ বেশ ক’বছর আমার জুনিয়র ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কবেথেকে আমার পরিচয় ও সম্পর্ক সেদিন তারিখ আমার মনে নেই, তবে সময়টা ষাটের দশক এবং প্রেক্ষিত প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষ। ষাটের দশকে পাকিস্তানী সামরীক জান্টা এবং পাকফৌজি প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান বিরোধী ছাত্র-গণ আন্দোলন গনতন্ত্রের দাবীতে তুঙ্গে উঠে। তখন এভডো প্রডোরকারনে রাজনৈতিক দলগুলি শক্তিশালী ও বিকশিত ছিল না। ফলতঃ সংগ্রামী ছাত্র সমাজকেই আন্দোলনে-সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হত। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এবং কিছুকাল মিজানুর রহমান শেলীর (পরে ডক্টর। সচিব, মন্ত্রী) নেতৃত্বাধীন ছাত্র শক্তি-শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন ছিল। উনসত্তোর সালের ছাত্র গনআন্দোলন-গনঅভ্যোত্থানে রুপনেয়। সেই আন্দোলন-অভ্যোত্থানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্র সমাজের ঐতিহাসিক ভূমিকা ইতিহাসের গৌরবোজ্জল অধ্যায়। ষাটের দশকের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের কর্মি-সংগঠক-নেতা হিসাবে কাজ করি। প্রথমে কলেজ শাখা অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম পারিবারিক সমস্যা ও বন্ধন না থাকায় সার্বক্ষনিক সংঘটক হিসাবে কাজ করি। কাজের মাঝেই তুখোড় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা, শক্তিমান সংঘটক, সুবক্তা আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মোজাহিদের সঙ্গে আমার পরিচয় সম্পর্ক-সখ্যতা-যা আজীবন বহাল ছিল। ছাত্রলীগ-ছাত্রইউনিয়ন-দর্শনগতভাবে দুই মেরু হলেও আমাদের মধ্যে একটি চমৎকার সু-সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্ক বন্ধুত্ব ব্যবসা বানিজ্যের না হলেও ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য মূলক ছিল। সম্প্রিতির বন্ধন ছিল। ছাত্র জীবন শেষে ছাত্রনেতা মোজাহিদ যুবইউনিয়নের দায়িত্বভার নিয়ে জেলা শাখার সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় যুবইউনিয়নের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি, মৌলভীবাজার সদর উপজেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একজন নিবেদিত প্রানরাজনীতিবিদ হিসাবে তিনি জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন, মৌলভীবাজার পৌর সভার তিন মেয়াদে পৌর কমিশনার নির্বাচিত হয়ে আন্তরিকতা, কৃতিত্ব ও জনপ্রিয়তার সাথে জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন। চুরাশি সালের ভয়াবহ বন্যায় যখন সমগ্র পৌর এলাকা দশফুটাধিক পানির নিচে গিয়ে জনজীবন লন্ড-ভন্ড হয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্য্যয় দেখা দেয় তখন আর্তমানবতার ত্রান ও কল্যানে জনপ্রতিনিধি-জনসেবক আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মোজাহিদ ও তাঁর পৌর পরিষদ-পৌর চেয়ারম্যান সৈয়দ মহসিন আলীর (পরে সাংসদ। মাননীয় সমাজকল্যান মন্ত্রী। পরলোকে।) বলিষ্ট নেতৃত্বে যে ভূমিকা রেখেছিলেন পৌরবাসি এখনও তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ ব্যাপারে মরহুমের সহকর্মি ও সমসাময়ীক পৌর কমিশনার জালাল আহমদ, মনবীর রায়, মোঃ মাসুদ এবং এ প্রজন্মের প্রিয় মুখ আসাদ হোসেন মক্কু প্রমুখ পৌর কমিশনারগণ নাগরিক সেবায় তার ত্যাগী মনোভাব ও বলিষ্ট ভূমিকার কথা স্বীকার করেন।
রাজনীতিবিদ ও সমাজ সেবক আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মোজাহিদ একজন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংঘঠক ছিলেন। আশির দশকে বিশ্বব্যাপী ফুটবল খুবই জনপ্রিয় খেলা। মফস্বল পর্য্যায়ে ক্লাব ও ক্রীড়া আন্দোলন খুবই বেগবান ছিল। আমার তখন ভরা যৌবনকাল। অসুখ বিসুখ-বার্ধক্যজনিত ব্যাধি ও দূর্বলতা নেই, ফলতঃ ক্রীড়া আন্দোলন ছিল খুবই বেগবান। আবাহনী মোহামেডান ওয়ান্ডারার্স, সান ফ্লাওয়ার-ক্লাবগুলির সভাপতি ছিলেন যথাক্রমে শফকতুল ওয়াহেদ (বিশিষ্ট সাংবাদিক। পরলোকে।) এবাদুর রহমান চৌধুরী (প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী। এডভোকেট সুপ্রীম কোর্ট) এবং সৈয়দ মহসীন আলী (বীর মুক্তিযোদ্ধা। মন্ত্রী। পরলোকে) প্রমুখ বলিষ্ট ক্রীড়া সংঘটকগণ। তখন ইলেভেন ষ্টার মৌলভীবাজারের ক্রীড়াঙ্গনের আলোড়ন সৃষ্টিকারি ক্রীড়া সংগঠন। কৃতি ফুটবলার রায়হান এর নেতৃত্বে ফুটবলের দুটি টিম ছিল। আমি এবং ইয়াহিয়া মোজাহিদ দীর্ঘদিন ইলেভেন ষ্টারস এর সভাপতি-সম্পাদক ছিলাম। এই দায়িত্ব পালনে কোনদিন ব্যক্তিত্ব কিংবা কৃতিত্ব কিংবা নেতৃত্বের দন্ধ হয়নি। বরং মিলে মিশে সৌহার্দ্য ও সম্প্রিতির মাধ্যমে ক্লাব পরিচালনা করেছি। স্বাধীনতা উত্তরকালে আমি স্থানীয় রেডক্রসের সেক্রেটারি ও আজীবন সদস্য ছিলাম। বর্তমান কমিটিতে তিনি নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেণ। এখানে দায়িত্ব পালনেও তিনি ছিলেন আন্তরিক। হৃদয়বান।
বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যান সমিতির সঙ্গে আমাদের আবেগ-অনুভূতি-ভারোবাসা ও শ্রদ্ধার আত্বিক সু-সম্পর্ক শুরু থেকেই বিদ্যমান। স্বাধীনতা উত্তর কালে শীতের মৌসুমে আমরা সমিতির স্থানীয় শাখার মাধ্যমে অন্ধজনেদেহ আলো-এই মানবিক শ্লোগানে উদ্ভোদ্ধ হয়ে ভ্রাম্যমান চক্ষু শিবির করতাম। চক্ষু চিকিৎসা শিবির এর স্থান ছিল বিদ্যালয় ভবন সমূহ। এ ব্যাপারে আমাদের দুইজন শ্রদ্ধেয় অগ্রজ মানবতাবাদি চিকিৎসাবিদ ডা. এস এ হক এবং ডা. শাহ নুরুল ইসলামই (উভয়ই পরলোকে। মহান মালিক তাদের বেহেশত নসীব করুন) মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। ভ্রাম্যমান মৌসুমী চিকিৎসা শিবির থেকে মহান আল্লাহর অপার রহমত-বরকত এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজকের এই বিশাল হাসপাতাল এই বি.এন.এস.বি. পরিবার। পূর্বে উল্লেখিত দুই মরহুম চিকিৎসক দীর্ঘদিন স্থানীয় বি.এন.এস.বি-র সভাপতি/সম্পাদক এর গুরু দায়িত্ব আন্তরিকতা ও কৃতিত্বের সাথে পালন করেছেন। আমি একজন লেখক ও সমাজ কর্মি হিসাবে তাদের অনুপ্রেরনায় সেই সময় সমিতির আজীবন সদস্য হয়ে সহ-সম্পাদক ভার প্রাপ্ত সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে ভাই-প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্বে আছি। সমাজ কর্মি এহিয়া মোজাহিদ এর সমাজ কর্ম জীবনের সম্মান ও গৌরবজনক অধ্যায় বি.এন.এস.বি. চক্ষু হাসপাতালের অবৈতনিক সাধারন সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন। বর্তমানে তার সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালনের দ্বিতীয় মেয়াদ চলছিল। শারিরীক অসুস্থতাও দূর্বলতাকে উপেক্ষা করে তিনি তার সার্বক্ষনিক দায়িত্ব যথারীতি পালন করছিলেন। পাঁচই অক্টোবর সন্ধ্যায় বি.এন.এস.বি সম্পাদক এহিয়া মোজাহিদ ফোন করে বল্লেন ছ’ তারিখ সকাল ৯’টায় মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের মান্যবর প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এস. কে. সিনহার গ্রামের বাড়ি তিলকপুর সৌজন্য সাক্ষাতের এ্যপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে। শারদীয় শুভেচ্ছা এবং সৌজন্য সাক্ষাতটি খুবই জরুরী। আমাকে প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে যেতে হবে। এই ভাবে সমিতির জরুরী প্রয়োজনে মোজাহিদ আমাকে ফোন করেন। কর্ম্মকর্তা হিসাবে সহায়তা চান। আমি জেলা জজ আদালতে মামলা আছে বলে অন্য দুই ভাইস প্রেসিডেন্ট হাজি আবু শাহজাহান কিংবা হাজি জয়নাল হোসেনকে নিয়ে যেতে বলি। কিন্তু শাহজাহান ভাই অসুস্থ বন্ধুবর জয়নাল স্থানান্তরে অতএব আজকেই যেতে হবে। কোর্ট কামাই ছাড়া উপায় নাই। ছ’তারিখ সকালে বি.এন.এস.বি চক্ষু হাসপাতাল সম্পাদক এহিয়া মোজাহিদ সহ একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে তিলকপুর যাই। মান্যবর প্রধান বিচারপতির সাথে পুস্পিত শুভেচ্ছ বিনিময় করি। তাঁকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানিয়ে তার সুস্ব্যাস্থ ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি। চক্ষু হাসপাতালের মানবিক সেবা কার্য্যক্রম শুনে মান্যবর প্রধান বিচারপতি সন্তুষ প্রকাশ করেন। এহিয়া মোজাহিদ এর শারীরিক অসুস্থতা ও দূর্বলতা দেখে দুঃখ প্রকাশ করতঃ কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিলেন, কথা হল মাস খানেকের মধ্যে ঢাকায় যাওয়া হবে।
আট অক্টোবর সাত সকালে ফজরের নামাজের সময় বাসায় দোতলায় সিড়িতে পা ফসকে পড়ে গিয়ে গোড়ালিতে ডান পা ভেঙ্গে যায়। আমার অবস্থা বেগতিক দেখে আমার মেয়ে জেনিফার রহমান আমার কলিগ ও নিকট প্রতিবেশি এডভোকেট বদরুল ইসলাম কে খবর দেয়। এডভোকেট বদরুল এসে আমার কাহিল অবস্থা দেখে হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেয়। সেই জেলাবারের সাবেক সম্পাদক এডভোকেট মিজানুর রহমানকে খবর দিলে তার ট্যেকসী যোগে আমাকে সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে এক্সরে-র ব্যবস্থা না থাকায় আমাকে আমার প্রস্তাব মত ইউনাইটেড কমপ্যেথ নেয়া হয়। সেখানে ডা. সাব্বির হোসেন খান এর তত্ত্বাবধানে এক্সরে করা হয়। অর্থপ্যাডিক্স চিকিৎসক ডা. অলক রঞ্জন দাস মারফত চিকিৎসাসেবা পাই। খবর পেয়েই মোবাইল ফোনে খবর নেন এডভোকেট এহিয়া মোজাহিদ। তাকে খবর না দেয়ায় দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আমাকে এসে দেখতে চান। তিনি নিজে অসুস্থ ও চলাফেরায় অসুবিধার বিধায় আমার বাসায় এসে আমাকে দেখার প্রয়োজন নাই বলে মতামত দিলেও আধ ঘন্টার মধ্যেই এহিয়া মোজাহিদ সদল বলে আমার মুসলিম কোয়ার্টারস্থ পৈত্রিক বাস ভবন রসুলপুর হাউসে এসে হাজির। শয্যাশায়ী অবস্থায় আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এহিয়া মোজাহিদ হায় হুতাশ করলেন, চক্ষু হাসপাতালের একাধিক অভিজ্ঞ চিকিৎসক আমার চিকিৎসা সেবায় সদাপ্রস্তুত বলে আমাকে আস্বস্থ করলেন।আমার এই অসহায় অবস্থায় সহানুভূতি ও সহমর্মিতা জানালেন। সপ্তাহ দুই যেতে না যেতেই তেরো অক্টোবর ব্রেন ষ্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন কিডনী রুগী আবু মোঃ ইয়াহিয়া মোজাহিদ। রুগে ভূগে দশই জানুয়ারী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চক্ষু হাসপাতাল সম্পাদকের দায়িত্ব পালন কালে এহিয়া মোজাহিদ সবচাইতে কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন চক্ষু হাসপাতালের ভূমি রক্ষার আইনী লড়াই ও সামাজিক আন্দোলন করতে গিয়ে। আমি আইনজীবী এবং তাকে বাদিকরে একশত চুয়াল্লিশ ধারার মামলা করেছি। চৌমুহনায়-মিটিং-মিছল-মানব বন্ধনে সর্বত্রই তার সরব উপস্থিতি ছিল। মাঠের লড়াকু সৈনিক হিসাবে তিনি যেভাবে জাতীয় সম্পদ তেল-গ্যাস-রক্ষার-আন্দোলনের জেলা আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন সেভাব চক্ষু হাসপাতালের ভু-সম্পত্তি রক্ষায়ও তিনি ছিলেন সোচ্চার প্রথম কাতারে।
পারিবারিক জীবনেও মানুষ আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মোজাহিদ ছিলেন মহান অভিবাভক-আদর্শ স্বামী- যোগ্য পিতা। বাবা এম এ ইউসুফ এবং মাতা জমিরুন্নেছা ইউসুফ এর সুপুত্র মোজাহিদ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের কৃতিকন্যা আলেমা চৌধুরীর সঙ্গে। মোজাহিদ-আলেমা দম্পতির দুই সন্তান ডা. সায়মা মোজাহিদ লিজা এবং ছারোয়ার মোজাহিদ পলাশ। সন্তানদ্বয় সুশিক্ষিত। কর্ম জীবনে প্রতিষ্টিত। কনিষ্ট ভ্রাতা এ.টি.এম জিয়াউল আলম খিজির ও একজন সজ্জন-প্রবাসী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ অনেকেই ছিলেন তার সন্তানের মত। অসুখের সময় ও দেখেছি লেমন আলম কোথায় বলে ডাকছেন। হাসপাতাল কর্ম্মচারি আলমই আমাকে সর্ব প্রথম তার মৃত্যো সংবাদ দেয়-হাউ মাউ করে আলমের সেকি কান্না-যা এখন শেষ হয়নি। এই কান্না ও আহাজারি একজন কর্মচারির নয় একজন সন্তান তুল্য স্বজনের। মানুষ এহিয়া মোজাহিদের এ এক বড় প্রসান্তি-তৃপ্তি। মানুষ মরনশীল। মৃত্যো প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ আলকোরআনে বলেন-কুল্লুন নাফসিনজ্যায়িকাতুল মউত-জগতের সকল প্রাণীকেই মৃত্যোর স্বাদ গ্রহন করতে হয়-মৃত্যোকে আলিঙ্গন করতে হয়। মৃত্যো স্বাভাবিক হলেও মানুষ স্বজনের মৃত্যো সহজে মেনে নিতে পারে না। একজন কর্ম্মবীরের মৃত্যোর পরও তার কর্মের স্মৃতি থেকে যায়। ইয়াহিয়া মোজাহিদ কোন ভিত্তিপ্রস্তর-পাথরে নাম লিখেননি, কাগজেও নয়, তিনি লিখেছেন তার নাম মানুষের অন্তরে। কবি যথাযথই বলেন পাথরে নয়, কাগজে নয়, হৃদয়ে লিখনাম সে নাম থেকে যাবে। সত্যিকার অর্থেই কর্ম্মবীর লড়াকু সৈনিক আবু মোহাম্মদ এহিয়া মোজাহিদ তার নাম লিখিয়েছেন আমাদের হৃদয়ে-সে নাম থেকে যাবে অনাদি অনন্ত কাল। অনুজপ্রতিম আবু মোঃ ইয়াহিয়া মোজাহিদ এর উজ্জল স্থপতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি, রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মাহান মালিক তার বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করছি।
(সেক্রেটারী, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিওর এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিষ্ট। ভাইস প্রেসিডেন্ট ঃ বি.এন.এস.বি. মৌলভীবাজার।)
মন্তব্য করুন