আন্দোলন ঃ শমশেরনগর স্টাইল

August 22, 2020,

সায়েক আহমদ॥ প্রায় দেড় যুগ আগে যখন তখন বিদ্যুৎ চলে যাওয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকা এবং মাস শেষে পল্লী বিদ্যুতের ভূতুড়ে বিল প্রদানের প্রতিবাদে মৌলভীবাজার জেলার ঐতিহ্যবাহী স্থান শমশেরনগরে একটি জোরালো আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। শমশেরনগরের শতভাগ গ্রাহক স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন। পল্লী বিদ্যুতের এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে করতে গ্রাহকবৃন্দ যখন অতিষ্ঠ, যখন গ্রাহকবৃন্দের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল, তখনই ঐ আন্দোলন ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছিল সর্বত্র। প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে প্রতিবাদ- সবকিছুই যখন ব্যর্থ হয়েছিল, তখনই স্থানীয় জনতা সেই অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আন্দোলনটা কী ছিল? প্রায় ১০ মাস শমশেরনগরের শতভাগ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিল দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পল্লী বিদ্যুতের কর্মীরা লাইন কাটতে গেলেই সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। অবশেষে ১০ মাস পর গ্রাহকদের সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছিলেন পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা। আমার যতদূর মনে পড়ে তখন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পরিচালক আমার বন্ধু কমলগঞ্জ গণমহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক আব্দুল মুমিত চৌধুরীর তৎপরতায় অবশেষে আলোচনার মাধ্যমে সে সমস্যার সমাধান হয়েছিল। এরপর থেকে অনেক বছর পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শমশেরনগর নাম শুনলেই আঁতকে উঠত।

বর্তমান সময়ে পল্লী বিদ্যুতের অপতৎপরতা সারাদেশজুড়েই চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত অবগত হয়েছেন, তাদের সেই সীমাহীন দূর্নীতির ব্যাপারে। এখন মনে হচ্ছে শমশেরনগর স্টাইলে আন্দোলন করতে হবে সারা দেশজুড়ে। তাহলেই হয়ত পল্লী বিদ্যুতের অত্যাচারের হাত থেকে দেশবাসী রেহাই পাবেন। সারাদেশ না হোক অন্তত মৌলভীবাজার জেলার গ্রাহকবৃন্দকে এখন সোচ্চার হতে হবে। পল্লী বিদ্যুতের স্বৈরাচারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

বিগত ১০ আগষ্ট বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্টায় শিরোনাম হয়ে এসেছিল ‘কর্তাদের হুকুমে ভুতুড়ে বিল, শাস্তি কর্মীদের’ শীর্ষক সংবাদটি। সেখানে শুধু পল্লী বিদ্যুৎ নয়, বরং পুরো বিদ্যুৎ বিভাগের সীমাহীন দূর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছিল। সেই সংবাদ থেকে জানা গেল সারা দেশ জুড়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েই বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল করেছিল ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস নেওয়া। একই সঙ্গে প্রথাগত লোকসান অর্থাৎ সিস্টেম লস কমিয়ে দেখানোর জন্যই ভুতুড়ে বিল করা হয়েছিল। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডিপিডিসি তাদের ৩৬টি কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে বেশি বিল করার নির্দেশ দিয়েছিল। ওই নির্দেশে এলাকাভেদে ১০ থেকে ৬১ শতাংশ বেশি বিল করতে বলা হয়েছিল। জানা যায়, শুধু ডিপিডিসি নয়, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীনে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডসহ (ওজোপাডিকো) দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থার গ্রাহকেরা করোনাকালে ভুতুড়ে বিলের খপ্পরে পড়েছিলেন। এর মধ্যে ওজোপাডিকোর বিতরণকৃত ২১টি জেলার মধ্যে তিনটি জেলায় ১৬০ শতাংশের বেশি বাড়তি বিল নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। প্রথম আলোর সেই প্রতিবেদন হতে জানা যায়, ডিপিডিসি ছাড়া বাকি বিতরণ সংস্থাগুলো তাদের কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে বাড়তি বিদ্যুতের বিল করার নির্দেশ দিয়েছিল কি না, সেই তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে গ্রাহকদের অস্বাভাবিক বিল পাওয়ার ঘটনা সব কটি বিতরণ সংস্থার বেলায় প্রায় একই রকম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সব কটি কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিয়েই গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি বিল নিয়েছিল। বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, ছয়টি বিতরণ সংস্থার মোট ৬৫ হাজার গ্রাহককে বাড়তি বিল দেওয়া হয়েছিল, যা পরে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু বিতরণ সংস্থাগুলোর নথিপত্র বলছে, এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি।

উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ৩ কোটি ৭৪ লাখ, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংস্থা আরইবি। ডিপিডিসি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ কোম্পানি হলেও মূলত ঢাকার দক্ষিণ অংশে ও নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎ বিতরণ করে থাকে।

সারাবিশ্বের মত বাংলাদেশ সরকারও করোনার জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কাজেই সারাদেশেই অঘোষিত লকডাউন চলছিল। করোনার কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার কমে গেছে এটি বিদ্যুৎ বিভাগেরই দাবি। ফলে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের বিল কম হওয়ার কথা। কিন্তু হয়েছে অনেক বেশি। আসলে উপরমহলের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থা ভুতুড়ে বিল করেছে। এই অনৈতিক কাজটি যারা করল তাদের বিচার কে করবে?

এদিকে বাড়তি বিলের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ বিদ্যুৎ বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তার বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও বিদ্যুতের ‘ভুতুড়ে বিল’ পাঠানো হয়েছিল। অর্থাৎ বাঘের ঘরে ঘোগের হানা। কাজেই দেশজুড়ে হইচই সৃষ্টি হলে একপর্যায়ে এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে বিদ্যুৎ বিভাগ গত ২৫ জুন একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি গত ৩ জুলাই প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে পাঁচটি সংস্থার প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে গত ৫ জুলাই ডিপিডিসির একজন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ চার কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হন। এ ছাড়া ৩৬টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রত্যেক নির্বাহী প্রকৌশলীকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে নোটিশ দেওয়া হয়। বদলি করা হয় দুই প্রধান প্রকৌশলীকে। অথচ এসব কর্মকর্তাকে বাড়তি বিল করার নির্দেশনা দিয়েছে খোদ ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ। জানা যায়, ডিপিডিসির চেয়ারম্যান হলেন খোদ বিদ্যুৎসচিব সুলতান আহমেদ। তাহলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর ক্ষমতা বেশি নাকি বিদ্যুৎসচিব সুলতান আহমেদের ক্ষমতা বেশি সে প্রশ্নটির উত্তর কে দেবে?

পরিকল্পনা করে চিঠি দিয়ে বিদ্যুতের বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ডিপিডিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সংস্থাটির ৩৬ জন নির্বাহী প্রকৌশলী সবাই কারণ দর্শানোর জবাব দিয়েছেন। এতে তাঁরা লিখেছেন, প্রতিষ্ঠানের আইসিটি দপ্তর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এপ্রিল এই তিন মাসের বিদ্যুতের বিল গত বছরের তুলনায় কত বেশি করতে হবে, তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী আইসিটি বিভাগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিল তৈরি করে। এরপর আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো শুধু সেই বিল প্রিন্ট দিয়ে গ্রাহকের বাসাবাড়িতে পৌঁছে দেয়।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ডিপিডিসি ও ডেসকোর চার কর্মকর্তা বলেছেন, প্রতিবছরই বিদ্যুতের বাড়তি বিল করে তা গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এগুলো হলো সিস্টেম লস কমিয়ে দেখানো। কোম্পানিগুলো যে সিস্টেম লস দেখায়, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে সিস্টেম লস বেশি। তা ছাড়া যে কোম্পানি যত বিদ্যুতের বিক্রি বেশি দেখাবে, সে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তত বেশি বোনাস পাবেন। অর্থবছরের শেষ চার-পাঁচ মাসে সাধারণত গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল বেশি করা হয়। এবার ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল এই তিন মাসে মাত্রাতিরিক্ত ভুতুড়ে বিল করায় বিষয়টি সামনে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের মালিকানাধীন বিতরণ কোম্পানিগুলো করা হয়েছিল বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করার জন্য। এখানে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল অনুশাসন ও নজরদারি করার জন্য। সে জন্য কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক পেশাদার ব্যক্তিদের দিয়ে পরিচালনা করার কথা ছিল। সেটি না করে নজরদারির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরাই হয়ে উঠছেন কোম্পানির হর্তাকর্তা। ফলে এখানে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হচ্ছে, মন্ত্রণালয় তার কাঙ্খিত ভূমিকা না রেখে কোম্পানির স্বার্থই দেখছে।

ডিপিডিসির চেয়ারম্যান বিদ্যুৎসচিব। এখন ডিপিডিসি সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রাহকদের বাড়তি বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ ধরনের নির্দেশনা শুধু প্রতারণা নয়, বড় ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটির বিচার যিনি করবেন, সেই বিদ্যুৎসচিব নিজেই ডিপিডিসির চেয়ারম্যান। এভাবে প্রতিটি কোম্পানিতে বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা বসে আছেন। কোম্পানিগুলোর বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো এসব অপরাধ জায়েজ করছেন। ফলে বিচার চাওয়ার জায়গা অবশিষ্ট থাকছে না।

করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের কারণে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তিন মাসের আবাসিক গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল নেওয়া বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। গত তিন মাসের যে বকেয়া বিল গ্রাহকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তা দেখে অনেক গ্রাহক হতভম্ব। গত তিন মাসে কোনো গ্রাহকের বিল দশগুন, বারো গুন পর্যন্ত বেশি এসেছে। যে গ্রাহকের বিল আসতো মাসে ৩০০ টাকা তার এসেছে হয়েছে ২৫০০ টাকা, যার বিল আসতো ৩ হাজার টাকা তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকার বিল। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি বিলের চিত্র দেখে গ্রাহকবৃন্দের চোখ কপালে উঠে যাওয়ার কথা। রাজধানীর কলাবাগানে থাকেন আরিফুর রহমান। প্রতি মাসে তার দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা বিল আসে। সে হিসেবে ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এপ্রিল এই তিন মাসে মাসে তার সর্বোচ্চ বিল আসার কথা ৬ হাজার টাকা। কিন্তু এবার তার বিল এসেছে এক লাখ টাকা। রাজধানীর পল্টনে থাকেন মো. মুনিরুজ্জামান। মাসে তিনি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বিদ্যুতের বিল দেন। সে হিসেবে তিন মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা বিল আসার কথা। তার এবার তিন মাসের গড় বিল এসেছে ৫০ হাজার টাকা। চুয়াডাঙ্গা সদরের নূরনগরের আসলামউদ্দিনের মাসে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা বিল আসে। এবার তাকে ২৫০০ টাকা বিল ধরিয়ে দিয়েছে। তবে তিনি কোনো ঝামেলার মধ্যে যাননি। গ্রামের মানুষ, বিল জমা দেওয়ার শেষ সময় যাওয়ার আগেই তিনি বিল পরিশোধ করেছেন।

চুয়াডাঙ্গার আসলামউদ্দিনের মতই সারাদেশের গ্রাহকবৃন্দ কোন ঝামেলায় জড়াতে চান না। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার আশংকায় তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বিদ্যুৎবিল পরিশোধ করে থাকেন। কিন্তু কলাবাগানের আরিফুর রহমানের মত ৬ হাজার টাকার জায়গায় যদি এক লাখ টাকা বিল আসে তখন গ্রাহকবৃন্দ কী করবেন? এরকম অত্যাচার তো পরাধীন দেশেও কল্পনা করা যায় না। যদিও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, তিনি অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্স করে সবগুলো বিতরণ সংস্থার প্রধানকে বলে দিয়েছেন গ্রাহককে বাড়তি বিল যেন দিতে না হয়। বিদ্যুৎ বিল নিয়ে গ্রাহক অসন্তোষ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। গ্রাহকের অধিকার রয়েছে জানার কেন এমন বিল দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে কীভাবে তা সমন্বয় করা হবে সেটিও বলতে হবে। এর ব্যত্যয় যারা ঘটাবে তারা শাস্তি পাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের হুমকিধামকিকেও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তারা বোধহয় কেয়ারই করেন না।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এভাবে বিল করার ক্ষমতা বিতরণ সংস্থাগুলোর নেই। বিইআরসির বেধে দেওয়া নিয়মের বাইরে এ ধরণের বিল করা হলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জনগনের ওপর এমন অত্যাচার বিতরণ সংস্থাগুলো কোনভাবেই চাপিয়ে দিতে পারে না, এটি অন্যায়। কিন্তু চোরা তো ধর্মের কাহিনী শোনে না।

বর্তমান সময়ে দেশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নজিরবিহীন অরাজকতা চলছে। দূর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে, দূর্নীতিবাজরা হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। কেউ যদি প্রতিবাদ করে তবে তার মৃত্যু নিশ্চিত। কোন কোন ক্ষেত্রে যদি মৃত্যু নিশ্চিত নাও হয়, তবে এমনভাবে হয়রানি করা হয়, যা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর। কাজেই এখন সময় এসেছে শমশেরনগর স্টাইলে আন্দোলন গড়ে তোলার। এখনই যদি দেশবাসী অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে না উঠে, তবে সে দিনটি আসবে কবে?

বিশ্বের ইতিহাসে এমন নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না যে, খোদ বিদ্যুৎসচিবের নেতৃত্বেই ৩ কোটি ৭৪ লাখ গ্রাহক, যাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১৫ কোটিরও বেশি, তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। যে ১০% গ্রাহক এখনো বিদ্যুৎ সুবিধা পায়নি, তারা অবশ্য বেঁচে গেছেন এ ভয়াবহ অত্যাচারের হাত থেকে। দেশের ৯০% জনগণকে যে সংস্থা পরিকল্পিতভাবে প্রতারিত করে তার বিচার কে করবে? খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী গ্রাহকবৃন্দকে হয়রানি না করার জন্য বলার পরও যারা এ ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? যদি সর্বক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে দেশ চলবে কী করে? বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস নেওয়ার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও তো দেখা যায় না। সারাবিশ্বে দূর্নীতিবাজ সরকারের অভাব নেই। কিন্তু দেশের ৯০% জনগণকে জিম্মী করে এভাবে ভূতুড়ে বিল তৈরি করে হয়রানি কিংবা অত্যাচার করার দৃষ্টান্ত তো সারাবিশ্বেও নেই।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সারা দেশের আপামর জনগণকেই তাই সোচ্চার হতে হবে। শমশেরনগরের জনগণ যদি ১০ মাস বিদ্যুৎ বিল দেয়া বন্ধ করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে দেশবাসী পারবে না কেন? ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সারাদেশের মধ্যে প্রথমেই গর্জে উঠেছিল শমশেরনগরের মুক্তিপাগল জনতা। তারা প্রকাশ্যে আক্রমণ করে পাক-বাহিনীর একটি প্লাটুনকে ধ্বংস করে দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। সেই সূত্র ধরে মুক্তিবাহিনী প্রথমে শ্রীমঙ্গল প্রবেশ করে ক্রমান্বয়ে মৌলভীবাজার হয়ে শেরপুর গিয়ে পাক বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তারপর সে যুদ্ধে জয়লাভ করে পাক বাহিনীকে সিলেটের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। তাহলে কেন মৌলভীবাজার জেলাবাসী এসব হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে না? কেন দেশের জনগণ অন্যায়-দূর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে না? ভারতের প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী নরেন্দ্র মোদীর দলকে যদি আম আদমী দলের কেজরিওয়াল হঠিয়ে দিতে পারেন, তবে বাংলাদেশের বীর জনতা কেন পারবে না এসব দূর্নীতি সমূলে উৎপাটন করতে? যারা দেশের ৯০% জনগণকে জিম্মী করতে পারে, তাদেরকে এখনই হটিয়ে না দিলে তারা দিনে দিনে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠবে।

অসংখ্য প্রতিকুলতার মধ্যেও কিছু সুসংবাদ আছে। পতনঊষারের জনগণ পল্লী বিদ্যুতের দূর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কয়েকদিন আগে সফল মানববন্ধন করেছেন। ইতোমধ্যে আবারো সোচ্চার হয়ে উঠছেন শমশেরনগরের বীর জনতা। আগামী বুধবার শমশেরনগরেও পল্লী বিদ্যুতের দূর্নীতির বিরুদ্ধে মানববন্ধন হবে। কাজেই এখনই সময়। জেলার সর্বত্র এখনই গড়ে তুলতে হবে তীব্র আন্দোলন। তারপর ছড়িয়ে দিতে হবে দেশব্যাপী। তাহলেই কেবল রক্ষা পাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ। নাহলে পরাধীন দেশের চেয়েও ভয়াবহ দূর্নীতিবাজদের হাতে সারাজীবন জিম্মী হয়ে থাকতে হবে। জনগণ কি তাই চান?

[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com