আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যা ও বুয়েট শিক্ষার্থীদের দশ দফা

October 15, 2019,

মোহাম্মদ আবু তাহের॥ ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ারের একটি মহামূল্যবান উক্তি দিয়েই লেখাটি শুরু করছি। তিনি বলেছিলেন আমি তোমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে পারি। সুমহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানে জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলেন। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। (আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে) ৬ অক্টোবর ২০১৯ রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্র নামধারী জানোয়ারের দল। এ ঘটনায় দেশের সর্বস্তরের মানুষ উদ্বিগ্ন, হতবাক। আবরার ফাহাদ কোন অন্যায় বা অপরাধ করেছেন এমন খবর জানা যায়নি। আবরার শুধু দেশের একজন নাগরিক হিসেবে মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে চেয়েছিলেন। স্বাধীন দেশে এমন হত্যাকান্ড কাম্য নয়। এটি সভ্যতা সংবিধান ও স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত। এ রকম ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। ইংরেজীতে একটি কথা আছে টুথ ইজ সামটাইমস্ স্টেঞ্জার দ্যান দ্যা ফিকশন  অর্থ্যাৎ সত্য কখনও কখনও কল্পকাহিনীর চেয়েও  অদ্ভুত হয়। আমাদের দেশে কিছু কিছু নৃশংসতা কল্পনাকেও হার মানায়। সমাজ কোথায় যাচ্ছে ? এ ধরনের অমানবিক ঘটনা প্রমাণ বহন করে একদিকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অন্যদিকে সমাজমানসেও বড় ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। একটা চূড়ান্ত অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে চলছি আমরা। সামাজিক মূল্যবোধগুলো যেন এক এক করে ক্ষয়ে যাচ্ছে। ক্ষয়িঞ্চু এই সামাজিক অবস্থা থেকে উত্তরনের পথ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি যেন দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই অকল্পনীয় নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে চলছে। সমাজ যেন প্রতিদিন পিছনের দিকে যাচ্ছে। স্বাধীন একটি জাতি হিসেবে যেখানে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা সেখানে যেন আমরা পশ্চাতগামী হচ্ছি। আলোর দিকে না গিয়ে সমাজ যেন যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। আবরারের নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপটিই যেন প্রকাশ করে। আসলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা থেকেই সামাজিক নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে নির্মম নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটছে এবং নারী, শিশু ও গৃহকর্মী নির্যাতন বাড়ছে তা দেখে মনে হয় সমাজ যেন প্রতিদিনই অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এসব অপরাধ বন্ধ করতে না পারলে আমাদের সমাজব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়বে। এজন্য জাগাতে হবে আমাদের মানবিকতাকে। এজন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ হওয়াও দরকার। অপরাধী যখন দেখে অপরাধ করার পরও শাস্তি হয়না হলেও অনেক দেরীতে হয় তখন তার মধ্যে একটা তৃপ্তি কাজ করে। পাশাপাশি অন্য অপরাধীরাও অপরাধ করতে সাহস পায়, বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আইনের প্রয়োগ যত কঠোর হবে শাস্তির মাত্রা যত দৃষ্টান্তমূলক হবে মানুষ আইনের প্রতি ততই শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হবে। এজন্য রাষ্ট্রকে মানুষের নিরাপত্তার জন্য আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। যাতে অপরাধী মনে করতে না পারে আইন ভঙ্গ করা কোন বিষয়ই নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের মুল চেতনা ছিল সমতা, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। দেশের খেটে খাওয়া মানুষ নিজেদের শ্রম, ঘাম, মেধা ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশের উন্নয়নের চাকা সচল রেখেছেন। নানারকম প্রতিবন্ধকতা সত্বেও দেশের কৃষক, শ্রমিক, প্রবাসী এবং গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত বিপুল সংখ্যক নারীরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশকে সমানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দারিদ্র দূরীকরণে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যু, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, যক্ষèা ও এইডস সহ অন্যান্য রোগ দূর করা, সামাজিক খাত সহ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু মানুষের নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে এই উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে। এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। মনে রাখতে হবে মানবাধিকারই যে কোন সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার অন্যতম নিরিখ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আবরার হত্যায় জড়িতদের বিচারের নিশ্চয়তা দিয়েছেন।  সচেতন দেশবাসী আবরার হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার দেখতে চায়। কেননা ’ জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড’, বিলম্বে বিচার পাওয়া বিচার না পাওয়ারই নামান্তর। আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন।  প্রতিবাদী ছাত্ররা হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধসহ দশ দফা দাবী দিয়েছেন। খুনের মামলার চার্জশীট না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকার ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। বুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবী গুলো হলো :-

আবরা ফাহাদের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, শনাক্তকৃত খুনীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিস্কার, দায়েরকৃত মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিস্পত্তি, বুয়েট ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে উপাচার্যের জবাবদিহি, আহসান উল্লাহ ও সোহরাওয়ার্দী হলের আগের ঘটনাগুলোয় জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল ও শেরে বাংলা হলের প্রভোষ্ঠকে প্রত্যাহার, আবাসিক হলগুলোয় র‌্যাগিংয়ের নামে ও ভিন্নমতালম্বীদের ওপর সকল প্রকার শারীরীক ও মানসিক নির্যাতনে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল, মামলা চলাকালে যাবতীয় খরচ প্রদান ও আবরারের পরিবারের সব ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসন কতৃর্ক বহন ইত্যাদি। ১১  অক্টোবর বিকেলে ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে বুয়েটে ছাত্র শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং একই সাথে শিক্ষার্থীদের ১০ দফা মেনে নিয়েছেন উপাচার্য। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন আমার কিছুটা ভুল হয়েছে আমার ভুল আমি স্বীকার করছি আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। ভিসি আরো বলেন আবরার আমার সন্তানের মতো ছিল। তোমাদের যেমন কষ্ঠ লাগছে আমার আরও অনেক খারাপ লাগছে। আমরা সবাই মর্মাহত। দেরীতে হলেও উপাচার্যের এই বক্তব্য তাঁর মহানুভবতার পরিচয় বহন করে বলে আমি মনে করি। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ডাক না দিলে পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে না। এ বিষয়ে বুয়েট প্রশাসন আরেকটু সতর্ক থাকলে হয়তো আবরার হত্যাকান্ড ঘটতোনা। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন ভবিষ্যতে প্রশাসন ছাত্রদের প্রতি আরও নজর দেবে ও দায়িত্ববান হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের নৃশংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি বলে মনে করি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সদর দফতরে আয়োজিত “প্রথম পদক্ষেপ হোক বৈশ্বিক শিক্ষা” শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেন হাসিনা ও মালালা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন আর কোন অস্ত্রের খেলা নয় এবার আসুন শিক্ষার খেলা খেলি। শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ না করতে পারলে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র থাকলে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। শিক্ষার্থীদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারলে অভিভাবকরা উচ্চশিক্ষার প্রতি বিমুখ হয়ে যাবেন। সত্যিকারের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলবে। এ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক, অভিভাবক ,শিক্ষার্থী, সরকার সকলকে ভাবতে হবে। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ব্যাপারে দেশের মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন রয়েছে বলে মনে হয়। তাছাড়া ছাত্র সংগঠনের সাথে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা এখন সময়ের দাবি। বুয়েট শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি হল র‌্যাগিং বন্ধ করা। র‌্যাগিংয়ের নামে অমানবিক নিষ্ঠুরতা সভ্য সমাজে চলতে পারে না। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে নবীন জুনিয়র ছাত্রদের ওপর সিনিয়র ছাত্রদের যে ভয়াবহ নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় তা কোনো ভাবেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। অশ্লীল কথাবার্তা বলা, কান ধরে ওঠবস করানো, মুরগি হয়ে বসিয়ে রাখা, নবীন শিক্ষার্থীদের জোর পূবর্ক সব রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের পরিচয় মুখস্থ রাখা, ব্যাঙ দৌড় ও বুকডন দিতে বাধ্য করা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করতে বাধ্য করা, সবার সামনে চরম অশ্লীল বই পড়তে বাধ্য করা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মাপ নেওয়া, অপরিচিত মেয়ে অথবা ছেলেকে প্রকাশ্যে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বাধ্য করা, রাতে মশার কামড় খাওয়ানোর জন্য বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা সহ বিভিন্ন কায়াদায় অমানবিক নির্যাতন করা হয়। এ ধরনের নির্যাতন মানবাধিকার ও সংবিধান পরিপন্থি। এ জাতীয় আচরণ ব্যক্তির মানবসত্বা নিয়ে বেঁচে থাকার পরিপন্থি। র‌্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে ভাবতে হবে। পবিত্র সংবিধানের ৩৫  অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রনা দেওয়া যাইবেনা কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্চনাকর দন্ড দেওয়া যাইবেনা। কিংবা  কাহারওি সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবেনা। র‌্যাগিং এর নামে যে সমস্ত আচরণ করা হয় (উপরোল্লিখিত) তা সংবিধানের ৩৫ ধারার সুস্পষ্ট লংঘন। আইনের শাসনের পরিপন্থি। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজে স্থিতিশীলতা, শৃঙ্খলা, শান্তি এবং আর্থসামাজিক প্রগতি ও উন্নতি আসে না। শেষ করার আগে পবিত্র কুরআনের সুরা মায়িদাহর ৩২ নং আয়াতের সরল অনুবাদ পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি “ যে ব্যক্তি পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো মানুষকে খুন করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কোনো মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবতাকে রক্ষা করল। আবরার ফাহাদকে আল্লাহ তায়ালা যেন জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন এবং তার মা-বাবা, পরিবার, সহপাঠী ও শুভাকাংখীদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: ব্যাংকার, কলামিস্ট ও গবেষক।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com