আবহমান বাংলার লোক-ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক এই শীতল পাটি
তোফায়েল পাপ্পু॥ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি মোগল শাসনামলে স¤্রাট আওরঙ্গজেব এবং ব্রিটিশ আমলে রানি ভিক্টোরিয়ার রাজদরবারে উপঢৌকন হিসেবে গিয়েছিল এবং রাজরাজারা যারপরনাই প্রীত হয়েছিলেন। জানা যায়, ১৯১৯ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমন্ত্রিত হয়ে সিলেটে সেখানকার বেত ও বাঁশের বানানো চেয়ার টেবিল, ব্যাগ ইত্যাদি দেখে অভিভূত হয়ে কয়েক ফর্দ কিনে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ব্যবহার করেছিলেন।
সেই সিলেটের ঐতিহ্যগত কুটির শিল্প শীতল পাটি এখন জাতিসংঘের ইউনেসকো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য। আজকাল এই পাটির দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ায় এখন আর গ্রামীণ মানুষের মাদুর বা চাদরের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় না। এখন এটা শহুরে সামর্থ্যবানদের আবাসঘর সাজসজ্জার অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সিলেটের একজন ইতিহাসবিদ ও বৈষ্ণব সাহিত্যের প-িত অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি (জন্ম: ১৮৬৫ খ্রি., মৃত্যু: ১৯৫৩ খ্রি.) কর্তৃক বিরচিত এবং ১৯২০-এর দশকে প্রকাশিত “শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত” নামীয় বিশালকার গ্রন্থের প্রথম খ-ের ৪র্থ অধ্যায়ে শীতল পাটি সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া। এই শিল্পের মধ্যে শীতল পাটি সর্বপ্রধান ও বিশেষ বিখ্যাত। মূর্ত্তা নামক এক জাতীয় গুল্মের বেত্র দ্বারা প্রস্তুত হয়। এটি শীতল, মসৃণ ও আরামজনক বলে সর্বত্র আদৃত। বঙ্গদেশের অন্য কোথায়ও এইরূপ উৎকৃষ্ট পাটি প্রস্তুত হইতে পারে না। ১৮৭৬-৭৭ খৃষ্টাব্দে শ্রীহট্ট হতে ৩৯২৭ টাকা মূল্যের পাটি রপ্তানি হয়েছিল।”
এখনকার দিনে স্বল্প পরিসরে মান বুঝে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা মূল্যের শীতল পাটি বাজারে পাওয়া যায়। এই সময়ের অর্থমূল্যের তুলনায় শতবর্ষ আগে এই পাটির দাম সোনার দামের চেয়েও বেশি ছিল তা অনুমান করাই যায়। এটি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া চানপুরন, শ্রীনাথপুর, আতাসন, গৌরীপুর, লোহামোড়া, খুজগীপুর, কোয়ারগাঁও, হরিশ্যাম, টেকামুদ্রা, কলমপুর, আলগাপুরসহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার লোক একসময় এই দামি শীতল পাটিশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। সিলেট অঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় শীতল পাটি তৈরি হলেও বালাগঞ্জের শীতল পাটির মান সবচেয়ে ভালো। ঔপনিবেশিক আমলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শীতল পাটি রপ্তানি হতো। ভিনদেশিরা বাংলাদেশে এলে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মসলিন কাপড়ের সঙ্গে শীতল পাটিও সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন। এ দেশের জমিদাররাও ভিনদেশি অতিথিদেরকে এসব ঐতিহ্য উপহার দিয়ে তুষ্ট করতেন।
দিন দিন বাংলাদেশের নানা ঐতিহ্য ও ইতিহাস এখন বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাচ্ছে। প্রতœনিদর্শন হিসেবে পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার ও বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার এই তালিকায় নাম উঠল সিলেটের শীতল পাটিরও।
২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু আইল্যান্ডে এর দ্বাদশ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইন্টারগবার্নমেন্টাল কমিটি অব ইউনেস্কো বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটিকে (Traditional art of Shital Pati weaving of Szlhet Bangladesh) ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ (আইসিএইচ) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। শিল্পপ্রেমীদের কাছে এটি একটি বিরাট মুহূর্ত। শীতল পাটির অন্তর্ভূক্তির ফলে তালিকায় বাংলাদেশের পণ্যসংখ্যা দাঁড়াল চারে। অন্যগুলো হলো জামদানি শাড়িতে ঐতিহ্যবাহী নক্সা (২০১৩) ও বাউল সঙ্গীত (২০০৮)।
বাংলাদেশের কোনো কোনো স্থানে শীতল পাটি তৈরির কথা জানা গেলেও মূলত শীতল পাটি হলো মেঝেতে পাতা একধরনের আসন। এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প। মুর্তা বা পাটি, বেত বা মোস্তাক নামের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল থেকে এ পাটি তৈরি হয়। হস্তশিল্প হিসেবেও এ পাটির যথেষ্ট কদর রয়েছে। শহরে শো-পিস এবং গ্রামে এটি মাদুর বা চাদরের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ব্যবহত হয়। সাজসজ্জা দ্বারা সজ্জিত মাদুরকে আবার নকশি পাটিও বলা হয়। শীতল পাটি বোনা হয় বেত-জাতীয় গাছের আঁশ থেকে। এই গাছটি মোস্তাক, পাটিপাতা, পাটিবেত ও পৈতারা। এই গাছটি সিলেট, সুনামগঞ্জ, বরিশাল, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনি, চট্টগ্রামে জন্মায়। শীতল পাটি সত্যিকার অর্থেই একটি বিরাট শিল্পকর্ম। এই কাজে নারীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই শিল্পের সাথে জড়িতরা তাদের অঞ্চলের নকশা ও মটিফকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে শুকনা মওসুমে মুর্তা থেকে বেত তৈরি হয়। বর্ষা মওসুমে দীর্ঘ সময় নিয়ে যতœসহকারে বোনা হয় শীতল পাটি। শীতল পাটিতে কারিগররা দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন গান, কবিতা, জীবজন্তুসহ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি। নকশা করা শীতল পাটি শৌখিন অনেকে গৃহসজ্জার কাজেও ব্যবহার করেন। আর বর-কনেকে শীতল পাটিতে বসিয়ে আপ্যায়নের রীতিও পুরনো।
শীতলপাটির চাহিদা বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। মুর্তা গাছের চাষ কমে যাওয়ায় এবং প্লাস্টিকের মাদুর সহজলভ্য হওয়ায় শীতলপাটি বোনা ও বিক্রি কমে গেছে। মানুষ সচরাচর সস্তার দিকে ঝুকতে চায়। বসা এবং শোয়ার জন্য আধুনিক নানা উপায় ও উপকরণ উদ্ভাবনের কারনে সাধারনের ভেতর আগের মতো শীতলপাটির ব্যবহার নেই। দীর্ঘ সময় নিয়ে ধৈর্য্য ও যতœ সহকারে শীতলপাটি তৈরির ব্যয়ভার তুলে আনতেই পাটিয়ালের কষ্ট হয়ে যায়। লোভনীয় লাভজনক না হওয়ায় এই পেশার লোকজন অন্য পেশার দিকে ঝুকছে।
গরমে আরাম আর ঘরের শোভা বর্ধনে এই পাটির জুড়ি নেই। খালি পাটির উপর শুয়ে থাকলেও প্রশান্তির ঘুম নেমে আসে চোখে। এক সময় ঘরে ঘরে শোভা পেতো শীতলপাটি। বিক্রির উদ্দেশ্য ছাড়াও বোনা হতো বাড়ি বাড়ি। অবসর সময়ে যে কেউ শখের বশে বুনে চলতো শীতলপাটি। বিক্রির জন্য অথবা নিজের ব্যবহারের জন্য অনেকেই নিরিবিলি পরিবেশে সূক্ষ্ম হাতে বানাতে থাকতো দৃষ্টিনন্দন-শোভাবর্ধক ও আরামদায়ক বিছানা।
বাজার অর্থনীতির জটিল হিসেবে না গিয়ে অন্তত এটুকু বলা যায় যে, শীতলপাটি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষত বাঙালি সংস্কৃতির শত বছরের ঐতিহ্য। সস্তা আবেগের বিষয় নয় এটি। বরং দারুনভাবে উপযোগী এক সাংস্কৃতিক উপাদান। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে উপযোগী উপকরণ। শীতলপাটির ব্যবহার আমাদের স্বাস্থ্য-সচেতনতারও প্রতীক। অন্তত প¬াস্টিকের পাটির চেয়ে শীতলপাটি অনেক বেশি আরামদায়ক এবং স্বচ্ছন্দে ব্যবহারযোগ্য। পরিবেশবান্ধব তো বটেই। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে শীতলপাটি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে মহিমান্বিত করেছে। আমরা যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বেত গাছের চাষ সম্প্রসারণ করতে পারি, পাটিয়ালদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে পারি তবে বিশ্ব ঐতিহ্যের আবেগি পরশ আমাদের নতুন প্রজন্মকেও নিশ্চয় দিতে পারি। সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আবার ফিরুক শীতল পাটির অনুপম শিল্প। ঐতিহ্যের আতিশয্যে কাটুক বাঙালি জীবন। লেখক- তোফায়েল পাপ্পু
মন্তব্য করুন