আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী: নীরব উত্থান, নীরব প্রস্থান
সায়েক আহমদ॥
যুদ্ধের উম্মত্ততায় কবির উত্থান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে কিংবা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাঙ্গালী মুসলিম কবিদের উত্থান খুব একটা বেশী লক্ষ করা যায় না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব ঘটেছিলো বাংলার বিস্ময়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের। যদিও তিনি বিদ্রোহী কবি হিসাবে সুপরিচিত, প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন বিপ্লবের এক অবিস্মরণীয় অগ্রপথিক। যত না ছিলেন তিনি বিদ্রোহী তার চেয়ে বেশী ছিলেন বিপ্লবী।
কাজী নজরুল ইসলামের সমান্তরালে লোকচক্ষুর অন্তরালে আরেক কবির নীরব উত্থান ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে। তবে প্রচারবিমুখ, অন্তরালবিলাসী এ কবি নীরবে-নিভৃতেই চলে গেছেন। তার আসা-যাওয়ার মধ্যে পড়েনি কোন সাড়া কিংবা হৈ-চৈ। এ যেন নীরব উত্থান, নীরব প্রস্থান।
কবি আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী। ১৯৮৪ সালের ১৬ই এপ্রিল চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর ৩৬ বৎসর পর অদম্য কৌতুহলে তাকে আলোকিত জগতে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা বিদগ্ধ পাঠকরাই নির্ধারণ করবেন।
আব্দুল ওয়াহেদ রেজভীর পিতা আব্দুল আজহার রেজভী ছিলেন এক প্রখ্যাত খানদানী পরিবারের বংশধর। পূর্বপুরুষ বসত পত্তন করেছিলেন রাজনগর থানার মেলাঘর মৌজায়। সেটা ১৮৪০ সালের পূর্বের ঘটনা। জায়গা বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন বৃটিশদের নিকট হতে। কিন্তু পূর্বপুরুষদের প্রতাপে জর্জরিত হয়েছিল সেই এলাকা। রেজভীর পিতামহের অকালমৃত্যুতে বিখ্যাত ক্রোড়ী বংশজ বিধবা দাদী পড়লেন মহাবিপাকে। অবশেষে তিনি রেজভীর পিতাকে নিয়ে চলে এলেন কমলগঞ্জ থানার মাধবপুর গ্রামে। এখানেই রেজভীর জন্ম হয়েছিল। দিনটি ছিল রবিবার। ১লা মাঘ, ১৩২৫ বাংলা (১৯১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি)। কিন্তু দূর্ভাগ্য তখনও পিছু ছাড়েনি। রেজভীর জন্মের বছর খানেক পরই পিতৃবিয়োগ হল। বড় ভাই তখন ৮ম শ্রেণির ছাত্র। তার উপরই পড়ল সংসারের ভার।
একমাত্র ফুফুর বাড়ি ছিল লংলার রাউৎগাঁও। সেখানে থেকে বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে রাউৎগাঁও মাদ্রাসা থেকে ১৯৩৪ সালে জুনিয়র মাদ্রাসা পাশ করলেন। তখন সবেমাত্র কমলগঞ্জ হাইস্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছে। স্কুলে গিয়ে সেক্রেটারী সাহেবকে অনুরোধ করতেই তিনি বিনা বেতনে রেজভীকে পড়ার সুযোগ করে দিলেন। ১৯৩৮ সালে এখান থেকেই কৃতিত্বের সাথে তিনি প্রবেশিকা পাশ করেছিলেন।
এবার শুরু হলে কর্মের সন্ধানে যাত্রা। চলে গেলেন সিলেট শহরে। ভাইয়ের বাসায় থেকে ইংরেজি টাইপ শিখে ফেললেন। কিন্তু সিলেটে কোন চাকুরী না পেয়ে চলে গেলেন আসাম। লক্ষীমপুর জেলার নাহার কাটিয়াতে বছর খানেক থাকলেন। কিন্তু সেখানে কিছুতেই মনটা বসছিল না। কাজেই সেখান থেকে ১৯৪০ সালে বাড়ি ফিরে এলেন।
কিছুদিন পরই আবার চাকুরী পেলেন। প্রধান শিক্ষকের চাকুরী। এবার যেতে হল ত্রিপুরার কৈলাশহরে। টিলাবাজার মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। বেতন মাসিক দশ টাকা। তবে থাকা-খাওয়া ফ্রি। এক বছর চাকুরী করলেন। কিন্তু আবার শুরু হল ‘হোম সিকনেস’। মাকে দেখার জন্যও মনটা ছটফট করছিল। ছুটি পাওয়া যাবে না। কাজেই চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে। এবার আর রেজভীর মা কিছুতেই রেজভীকে দূরে ছাড়তে রাজী নন। কী আর করা! তবে আকস্মিকভাবে চাকুরী জুটে গেল কাছেই। শ্রীনাথপুর গ্রামে।
ছলিমউল্লাহ নামের এক প্রখ্যাত জমিদার ভাদেশ্বর থেকে শ্রীনাথপুর গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কালক্রমে সেই জমিদার বাড়িটি ছলিমবাড়ী নামে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করে। বিশাল বাড়ি। জমিদার বংশের অনেকগুলো পরিবার সেখানে বসবাস করে। খানদানী প্রথা অনুসারে তারা খানদানী পরিবার কিংবা নিজেদের বংশ ছাড়া অন্য কারো সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হত না। এখনও তাদের বাড়িতে ভেতরে অন্দরমহল এবং সামনে বহির্বাটিতে বাংলো টাইপের বাড়ি বিদ্যমান। মেহমান কিংবা আত্মীয়স্বজন এলে বহির্বাটিতে থাকার বন্দোবস্ত হয়। রেজভীরও থাকার ব্যবস্থা হল সেখানেই। চাকুরীটি প্রাইভেট শিক্ষকের। বেতন মাসিক পাঁচ টাকা। তারা প্রধান শিক্ষক হিসেবে রেজভীর চাকুরীর খবর পেয়েছিল। তাই অনেকটা জোর করেই তাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। বেতন যদিও একটু কম, তবে বাড়ির কাছাকাছি থাকায় রেজভীও সানন্দে রাজী হয়েছিলেন।
একদিন ছলিমবাড়ির বহির্বাটির বারান্দায় দাঁড়িয়েই হঠাৎ রেজভীর দুচোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এ কি দেখছেন! উম্মুক্তকেশী উদ্ধত যৌবনা এক ষোড়শী! কী অপূর্ব রূপ! মনে হল স্রষ্টা তার আপন হাতে গড়েছেন এ বেহেশতী হুরকে। তার রূপের ঝলকে আলোকিত হয়ে গেছে চারপাশ। রেজভীকে দেখে সেই ষোড়শী সচকিত হয়ে উঠলেন। চঞ্চলা হরিণীর মত ছুটে পালালেন। তবে যাবার আগে তার মুচকী হাসি দিয়ে রেজভীর হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে গেলেন। কারণ, সে মুহূর্ত হতেই রেজভীর হৃদয়জুড়ে বাঁধভাঙ্গা হাহাকার শুরু হল। মন বসে না কোন কাজে। সবকিছু হয়ে গেল বিস্বাদ। দিন নেই, রাত নেই, চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই মুচকী হাসি। খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। চাতক পাখির মত প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকেন একই জায়গায়। কিন্তু সেই পলাতক হরিণীর আর দেখা মেলে না।
সবাই রেজভীকে জিজ্ঞেস করেন অসুখ হয়েছে কি না। কিন্তু রেজভী তো মনের অসুখের কথা কাউকে জানাতে পারেন না। তারপরও জেনে গেল একজন। বাল্যবন্ধু মনিরুল। সে আবার সম্পর্কে ষোড়শীর চাচাতো ভাই। তাকে খুলে বলতেই হল সবকিছু। রেজভীর মনের অবস্থা দেখে মনিরুল তাকে শান্তনা দিলেন। বললেন, ‘চিন্তা করিস না, একটা না একটা ব্যবস্থা করব।’
কয়েকটা দিন অতিবাহিত হল। কিছুই হল না। ওদিকে রেজভীর অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। বন্দী পাখির মত ছটফট করছিল মনটা। বারবার ষোড়শীর মুখটা দেখার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করেন। কিন্তু ষোড়শী তো জমিদার বংশের সন্তান। যদিও এখন তাদের আগের মত সে অবস্থা নাই, তারপরও কঠিন প্রতিবন্ধকতা। অন্দরমহলের কারো সাথে দেখা করা এক কথায় অসম্ভব। নিতান্ত ভাগ্য ছাড়া কারো চেহারা দেখাটাই অসম্ভব। বাধ্য হয়ে রেজভী বারবার মনিরুলকে বিরক্ত করতে শুরু করলেন। কিন্তু মনিরুলও কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
প্রেমে পড়লে মনটা সাহসী হয়ে উঠে। উপায়ান্তর না দেখে রেজভীও সাহসী হয়ে উঠলেন। অবশেষে কোন এক অজানা মুহূর্তে বন্ধু মনিরুলকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে বসলেন। ষোড়শীর পিতার নিকট থেকে উত্তর এল, ‘পাত্র রোজগারের উপযুক্ত হোক। তারপর দেখা যাবে!’
এবার কল্পনা ছেড়ে বাস্তব জগতে পদার্পন ঘটল তরুণ রেজভীর। কি করবেন তা চিন্তা করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। তখন সারাবিশ্বে যুদ্ধের ডংকা বাজছিল। তৎকালীন সময়ে ভাল চাকরীর চিন্তার করাটাই ছিল বোকামী। তবে ব্রিটিশ আর্মিতে যোগদান করতে পারলে মন্দ হত না। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেটাই ছিল সবচেয়ে সম্মানজনক এবং মূল্যবান চাকুরী।
বড় ভাইকে সিদ্ধান্তটা জানালেন রেজভী। কিন্তু তিনি সোজাসুজি বলে বসলেন, ‘কি দরকার তোমার যুদ্ধে যাবার? এত টাকা খাবে কে!’ কিন্তু রেজভীর তো তখন বাঁধভাঙ্গা মন। সেই মনের মধ্যে চলছে আরেক যুদ্ধ। সে যুদ্ধ মানুষ হবার। সে যুদ্ধ উপযুক্ত হবার। বেকার থাকতে মন চাইছে না। ঘুরেফিরে একই চিন্তা, ‘উপযুক্ত হতে না পারলে বেঁচে থেকে লাভ কী?’ অবশেষে রেজভীর পীড়াপীড়িতে বড়ভাই খুবই বিরক্ত হলেন। যখন দেখলেন, রেজভীকে আর আটকে রাখা যাবে না তখন বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি দেখছি।’
বড়ভাই যা করলেন তা দেখে রেজভী হয়ে গেলেন হতভম্ব! কারণ বড়ভাই যে অল্প সময়ের মধ্যে মারাত্মক কিছু করে ফেলবেন তা ছিল রেজভীর কল্পনারও বাইরে। তিনি চলে গিয়েছিলেন সিলেটের এক বড় অফিসারের কাছে। সেখান থেকে সুপারিশপত্র নিয়ে এলেন, যাতে মিলিটারীতে সিভিলিয়ান ক্লার্ক হিসেবে ভর্তি হওয়া যায়। মাসিক বেতন ৬০টাকা। রেজভী তো স্তম্ভিত! কারণ সরাসরি আর্মিতে সৈনিক হিসেবে যোগদান করলে বেতন পাওয়া যেত মাসিক ২৫টাকা। আর এখন পাওয়া যাবে ৬০টাকা! মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন বড় ভাইকে।
ফলে আর দ্বিধাদ্ব›েদ্ধ না ভূগে ১৯৪২ সালের ৪ মার্চ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় অংশে যোগদান করলেন রেজভী। বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। ওদিকে ভারতীয়দের মনে তখন স্বাধীন ভারতের চেতনা কাজ করছিল। ব্রিটিশ ভারতের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নিজ নিজ পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত। বৃটিশরাজ ভারতীয়দেরকে যুদ্ধে রিক্রুট করতে লিপ্ত। গান্ধীজীর উপদেশ ছিল, বৃটিশদের পক্ষে যুদ্ধে সাড়া না দেয়া। আবার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন দল চাইছিল সরাসরি ব্রিটিশদের বিপক্ষে অবস্থান করে যুদ্ধের সুযোগে ব্রিটিশদেরকে বিতাড়ন করা। অপরদিকে জিন্নাহ সাহেব দেখলেন মুসলমানরা পিছিয়ে আছে। এমতাবস্থায় বৃটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে হলে মুসলমানদের যুদ্ধে যোগদান করা নিতান্ত প্রয়োজন। তাঁর উপদেশ ছিল যুদ্ধে যোগদান করা।
সবার মত স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত রেজভী অধিকাংশ ভারতীয়দের মত ব্রিটিশ আর্মিতে যোগদান করলেন। উপযুক্ত হবার মানসে তিনি যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন, এটা যেমন সত্য, তেমনি তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও অগ্রসর চিন্তার অধিকারী ছিলেন। তার তৎকালীন সময়ের চিন্তাধারা তিনি লিখে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই বুঝা যায় তিনিও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য কতটা উদগ্রীব ছিলেন। তবে তিনি চাইতেন ১৯৪০ সালে শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই যেন ভারতবর্ষ এ, বি ও সি জোনে বিভক্ত হোক। রেজভী তার রচিত ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পাঁচ বছর’ গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি নিজ হাতেই তৈরি করেছিলেন। সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হবার পর তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রেজভী লিখেছিলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক অবস্থা তখন ছিল খুবই জটিল। বৃটিশ সরকার নিজ ওয়াদামত দেশকে স্বাধীনতা দিতে তৎপর। কেবিনেট মিশনকে স্বাধীনতার কাজে এগিয়ে নেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ স্বাধীনতার ধারা নিয়ে এক হতে পারছিলেন না। দুটি দলের মধ্যে থমথমে অবস্থা বিরাজমান। কখন কি হয় বলা যায় না। কেবিনেট মিশন ভারতবর্ষকে এ, বি ও সি জোনে বিভক্ত করে একটি ফেডারেশন করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। এ জোনে রাখা হয়েছিল সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। বি জোনে ছিল মধ্য ভারত। আর সি জোনে অবিভক্ত বাংলা ও আসাম। মুসলিম লীগ এ পরিকল্পনা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস তা না মানার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ এ ও সি জোনে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। লর্ড ওয়াভেল ছিলেন তখনকার ভাইসরয়।’
যুদ্ধে যোগদান করার ব্যাপারে রেজভীর উপলব্ধিটা জানা হল। এবার আসা যাক রেজভী কিভাবে কবি হিসেব আত্মপ্রকাশ করলেন সে প্রেক্ষাপটে। আসলে রেজভী নিজেও উপলব্ধি করেননি যে তার ভেতরে একটি কবিসত্ত্বা জন্মগ্রহণ করছিল। যুদ্ধে তিনি ব্রিটিশ আর্মির সাথে বিভিন্ন ফ্রন্টে ভয়াবহ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ইরাক, ইরান, ইটালী, মিশর প্রভৃতি দেশে ছুটে চলে তাঁর বাহিনী। তাদের সাথে ছুটে চলতে হয় রেজভীকে। কখনো মরুর বুকে, কখনো বা ইউরোপের বিধ্বস্ত প্রান্তরে, কখনো বা বরফে আচ্ছাদিত ইটালীর রাস্তায়- দিক বিদিক ছুটে চলার ভয়াবহ সে দিনগুলো কাটছিল ঝড়ের গতিতে।
রেজভী তখন অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছেন ইরাকের একটি সামরিক হাসপাতালে। সারাক্ষণই মৃত্যুচিন্তা মাথায় এসে ভর করছিল। শুয়ে থাকেন, আর ভাবেন কোনদিন কারো সঙ্গে কি আর দেখা হবে? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ভাব এসে গেল। কোনদিনই কবিতা লিখেননি। হঠাৎই মাথায় কয়েকটি পংক্তি গিজগিজ করতে থাকল। না লিখে শান্তি পাচ্ছিলেন না। নার্সকে বলতেই কাগজ-কলমের ব্যবস্থা করে দিল। মনের দুঃখেই বোধহয় কয়েক লাইন পদ্য লিখে ফেললেন-
আজি আমি যাই আনমনে
মরণের পথ গণে গণে
ধরিতে পারি না মরণে
হে যম তুমি অচকিতে
টপ করে নিয়ে যেতে
আগমন তোমার ধরাতে!
জীবনের প্রথম পদ্য। কাজেই কি লিখেছেন তা নিজেই জানেন না। কবিতা হয়েছে কি না তাতেও তার সন্দেহ! তারপরও লিখেই যেন শান্তি পেলেন। মরুর বুকে জন্ম হল এক তরুণ কবির। দুর্দান্ত বয়স। বাইশ বছরের টগবগে যুবক। তারুণ্যের উদ্দামতা হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়েছিল হাসপাতালের বিছানায়। আর হাসপাতালের সেই আইসোলেশনের একাকীত্বে মনের উপলব্ধিটুকু বেরিয়ে এল কবিতার ছন্দে!
তবে যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝেও রেজভীর মনটাকে ছিন্নভিন্ন করছিল আরেক বিষের তীর। আর সেই বিষাক্ত তীর অনবরত রেজভীর বুকে নিক্ষেপ করছিল তাঁর সেই ‘এক পলকের একটু দেখা’র ষোড়শীটি। প্রায়ই ষোড়শীর চিন্তায় অস্থির হয়ে যেতেন রেজভী। একদিন যুদ্ধের ক্যাম্পে রাত তিনটায় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তবে যুদ্ধের কারণে নয়, ঘুম ভেঙেছে প্রেয়সীকে স্বপ্নে দেখেছেন, সে আনন্দে। সাথে সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মন থেকে বেরিয়ে এল রেজভীর জীবনের দ্বিতীয় কবিতা। আনমনে লিখে ফেললেন তিনি সেই কবিতাটি।
নিদ্রাদেবী কোথা হতে
কল্পনার হার হাতে
ভীষণ গরজে আক্রমিল
প্রাণ মম চুরমার
স্বপন সাগরে ডুব দিল।
নীল রঙ চেলিখানি
মস্তকে ধরিয়ে টানি
মুখ আধ ঢাকা ঘোমটায়।
হেরিনু স্ব লাজ ভরে
ধীর ধীর ধীরে ধীরে
স্বপ্নদেবী এনেছে হেথায়।
নূপুর দিয়ে সে পায়
চমকে চমকে হায়
রুনু রুনু ঝুনু ঝুনু বাজে
ছুঁইয়ে হৃদয় মোর
ধরিয়ে যুগল কর
কহিতে লাগিল ধীর লাজে।
‘কি করিছো বন্ধুবর
চলে এসে সাথে মোর
দেখ এসে সন্দেশ তোমার
সঁপেছো হৃদয় যাকে
হের আজি এসে তাকে
প্রণে তব খেলিবে বাহার।’
দেখিনু চন্দ্রিকা দেবী
জানি না কি যেন ভাবি
নিরিবিলি লতাকুঞ্জ মাঝে
হাসি হাসি মুখখানি
অন্তরে নাহিকো গ্লানি
যৌবন খেলিছে হিয়া মাঝে।
শাখে হাত দিয়ে পরে
প্রাণখানি চেপে ধরে
গান এক ধরিলাম সুরে
তারপর নাহি জানি
ভেঙ্গে গিয়ে প্রাণখানি
চলে গেল প্রিয়ে ছাড়ি মোরে।
কবিতাটি লিখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন রেজভী। চিন্তা করেও পেলেন না এত বড় পদ্য কীভাবে লিখে ফেললেন। তিনি চিন্তা করছিলেন কাব্যবিচারে এটাকে কবিতা বলা যাবে কিনা। তবে এটি ছিল কবি রেজভীর নিখাঁদ মনের উপলব্ধির লিখিত রূপ।
এভাবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটল রেজভীর কবিস্বত্ত্বার। তিনি একের পর এক কবিতা লিখতেই থাকলেন। যুদ্ধের ভয়াবহ দিনরাত্রির মাঝেই কবি রেজভীর কবিতা লেখার প্রসব বেদনা দেখা দিত, আর একঘেয়ে ও বিরক্তিকর জীবনে জন্ম হত এক একটি অদ্ভুত কবিতার। তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন দেশের চিত্রও ফুটে উঠে তার সেই কবিতাগুলোতে।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন