আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী: নীরব উত্থান, নীরব প্রস্থান-২
সায়েক আহমদ॥
আশি বছর আগের বিস্ময়কর কবিতা ঃ
কবি আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নীরবে নিভৃতে কাব্য রচনা করে যাচ্ছিলেন। তবে তাঁর সেই কাব্যসাধনা ছিল একান্ত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ। তিনি যে পরবর্তী জীবনে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন, কিংবা কবিতার বই প্রকাশ করবেন, এ ধরণের কোন মানসিকতা তাঁর ভেতরে কখনো জাগ্রত হয়নি। তবে তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ‘এক পলকের একটু দেখা’ দেয়া এক ষোড়শী। ছলিমবাড়ির ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর সেই ষোড়শী কন্যাটিই বারবার তরুণ রেজভীর মনটাকে ক্ষতবিক্ষত করছিল। বারবার রেজভীর মানসপটে গানের মত বাজছিল ষোড়শীর পিতার সেই অমোঘ বাণী ‘পাত্র রোজগারের উপযুক্ত হোক। তারপর দেখা যাবে!’ আসলে ষোড়শীর পিতার ছোট্ট ডায়লগটি রেজভীকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। জমিদারের উত্তরপুরুষ কথা বলেছেন জমিদারী ভঙ্গিতেই। রেজভীর বন্ধু মনিরুলকে কোন কটু কথা বলেননি। রেজভীকে কোন অপমান করেননি। তবে এমন কথা বলেছেন, রেজভীর মনটা হয়েছে বজ্রাহত। মনের ভেতরে চেপে গিয়েছিল ভয়ংকর জেদ। হিন্দী সিনেমার নায়কের মত গ্রহণ করেছিলেন চ্যালেঞ্জ। তার মনের মধ্যে দৃঢ় সংকল্প ছিল নিজেকে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলবেন। সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে নিজের ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলবেন।
প্রেয়সীকে একান্ত করে পাবার বাসনায় এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে রেজভীর এ দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। রেজভী তখন চলে গেছেন ভারতবর্ষ ছেড়ে অনেক দূরে, ইরাকের মরুভূমিতে। দেশ, মাটি ও মানুষ হতে তিন/চার হাজার মাইল দূরের একাকীত্ব জীবন রেজভীর মনকে আলোড়িত করছিল। স্বাভাবিক কারণেই প্রেয়সীর স্মৃতি তাকে উদ্বেলিত করেছিল। এ কারণেই তার মনের উপলব্ধিটুকু কবিতা হয়ে আত্মপ্রকাশ করছিল। কিন্তু রেজভীর সকল কবিতাই কিন্তু প্রেমবিষয়ক নয়। আজ থেকে ৮০ বছর পূর্বে, ১৯৪১ সালে রেজভীর কলম থেকে বেরিয়েছিল আধুনিক কবিতা। বাংলা কবিতা যখন রবীন্দ্রবলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখনকার সময়ে একজন মুসলিম তরুণ কবি আধুনিক কবিতা লিখবেন, তা ছিল তৎকালীন সময়ে একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। রেজভীর ‘অন্ধকার দিন’ কবিতাটি পাঠ করলে পাঠককে অবশ্যই ভিমড়ি খেতেই হবে।
‘অন্ধকার দিন’
তিমিরাচ্ছন্ন দিন এখন সঙ্গে আমার
রাস্তা সব অন্ধকার
এবং ফ্যাকাশে
আকাশে মেঘ এবং
বাতির ক্ষীণ আলো-
কিন্তু কেন চিন্তা করব আমি?
সব চিন্তা চলে যাবে
যতক্ষণ পর্যন্ত না
অন্তরের কালো দাগ থাকবে।
জ্বলতে থাক সেখানে
ছায়াবিহীন
দয়ার আলো
এবং বন্ধুত্ব!
উজ্জ্বল হয়ে আছে
চুলায় আগুণ জ্বলছে
ভালবাসার দানের
এই অন্ধকার দিনে!
চল্লিশের দশকের শুরুতেই এরকম একটি আধুনিক কবিতা বাংলা সাহিত্যে কল্পনা করাও ছিল অসম্ভব ব্যাপার! কিন্তু রেজভীর একাকী মনের গহীন থেকেই তার সেই উপলব্ধিটুকু কবিতার আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
রেজভীর বড় বোন থাকতেন ‘রাউৎগাঁও’ নামের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। তিনিও চিঠির মাধ্যমে জেনে গিয়েছিলেন ছোট ভাইয়ের কাব্যচর্চার কথা। তাই ছোটভাইয়ের কাছে একটি আবদার করে বসলেন। চিঠির মাধ্যমে জানালেন বড়বোনের নিকট একটি কবিতা লিখে পাঠাবার জন্য। কারণ ১৯৪১ সালে কোন মুসলিম পরিবারের কেউ কবিতা লিখছে, তাই ছিল একটি বিস্ময়কর ঘটনা। রেজভী তখন কবিতার রাজ্যে তুঙ্গে অবস্থান করছেন। তাই বোনকে কবিতা পাঠানোর চিন্তা থেকে একটি অদ্ভুত চিঠি লিখে ফেললেন। তরুণ কবি রেজভীর সেই অদ্ভুত চিঠিটিই হয়ে গেল এক অবাক কবিতা। সে কবিতায় উঠে এল তরুণ রেজভীর বাল্যকালের ইতিহাস। বড়বোন, বড়ভাইসহ যারাই সেই চিঠিটি পড়লেন, তাদের দুচোখ বেয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু নেমে এসেছিল। কি ছিল সেই চিঠি। ‘বোনের নিকট পত্র’ নামের সেই কবিতাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখা যেতে পারে।
‘বোনের নিকট পত্র’
আমি তখন ছোট্ট ছিলাম বলতে নাহি পারি
আব্বা মোদের স্বর্গে গেলেন তিনটি রতন ছাড়ি।
ঐখানেতে দাদীর কবর পুকুর পাড়ের ধারে
উনিও তখন চলে গেলেন আটটি বছর পরে।
পড়তে গেলাম পাঠশালাতে শৈশবেরই কালে
দুষ্টামী যে করছি কত ধূলো-বালি-জলে।
বোন গো তুমি বড় ছিলে, হয়ে গেল যে বিয়ে
চলে গেলে স্বামীর ঘরে মোদের ছেড়ে দিয়ে।
মারপিট খেয়ে করেছি সবে পাঠশালা তো পাশ
ফুফুর বাড়ি চলে গেলাম, ছেড়ে গৃহবাস।
বারো বছর বয়স ছিলো খেলতে গিয়ে কপাটি
ডান পা খানি ভেঙ্গে গিয়ে হয়ে গেল দু‘পাটি।
আরোগ্য যে লাভ করেছি বড় ভাই এর দয়াতে
ভুলবো নাকো কভু যে তা, অমর থাকবে জগতে।
ছাত্রজীবন শেষ করে দুটি বছর পরে
চাকুরী খুঁজে ঘুরেছি কত শহরে বন্দরে।
ভাই এর কাছে মানুষ হয়েছি বলতে নাহি লাজ
কর্মক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি ভাই এর দয়ায় আজ।
সংসারেতে কর্ম মোর, কর্মই হোক সাধনা
কর্মকেই আজ নিয়েছি করে জীবনেরই খেলনা।
ভাই-বোন-মার মুখ দেখে প্রাণ ছিল বিপাকে
পণ ছিল মোর, তাইতো আজ পড়ে আছি ইরাকে।
চিন্তা না করো বোন গো, চিন্তা কেন মোর লাগি
কাটাতে দাও কর্মেই মোরে, কাটাতে দাও জিন্দেগি।
ভাই হয়ে জন্মেছি গো, ভাই এর মত থাকতে দাও
কর্মক্ষেত্রে জীবন খানি চলছে যেমন চলতে দাও।
ছাড়ছি যখন গৃহ বোনগো কঠিন করে হিয়া
কেমনে রাখবো কোমল প্রাণগো হাসিয়া খেলিয়া।
হৃদয় আজ কঠিন মম পাষাণ মম প্রাণ
পাষাণ হৃদয় বলে তাই উপাধি করেছো দান।
বড় আদুরে ছিলাম আমি আদর এখন নাইকো আর
মুছে গেছে কালের গতি দোষ এতে নাহি কার।
স্বপনে কভু ভাবিনিগো আসব আমি আরবে
বিশ্বপ্রভুর মান ইচ্ছা করছি পালন নীরবে।
ভাগ্য যে ভাল, দর্শনে মোর শেরে খোদা আলী বীর
ওলিদের শিরোমনি গওছে আজম দস্তেগীর।
আদম, নূহ, ইউনুছ নবী, হোসেন, বীর কাসেম
শুয়ে আছেন সমাধিতে আব্বাছ আর মুসলিম।
দীনের ইমাম আবু হানিফা মজহবেরই মূল
শহীদ আজগরের নিয়েছিগো চরণ ধূল।
পাপের তবু হয়নি ক্ষয় চিন্তা করি রাত্র দিন
আরো আছে বলব যদি দেখা পাইগো কোনদিন।
পোড়া অদৃষ্টে কি লিখা আছে কইতে নাহি পারি
যে দিকেতে চাইগো যেতে শুধু অন্ধকার নেহারী।
পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের ধাঁচটি কিছুটা ফুটে উঠেছে তরুণ রেজভীর এ কবিতাটিতে। ঐসময়ে জসীমউদ্দিন তাঁর কাব্যসাধনার মধ্যগগণে ছিলেন। তরুণ কবি রেজভী জসীমউদ্দিনের সেই কাব্যসাধনার সাথে পরিচিত ছিলেন কি না তা অবশ্য জানা যায় না। রেজভীর বেড়ে ওঠা ছিল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। তৎকালীন সময়ে সেখানে পত্র-পত্রিকা পাওয়া যেত কি না, কিংবা রেজভী কি সেসব পড়তেন, তাও জানা যায় না। যদি রেজভী সেসব পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন, তবে তাকে তৎকালীন সময়ের আধুনিক চিন্তা চেতনার অধিকারী বলে স্বীকার করে নিতে হবে। আর যদি তিনি সেসব পাঠের সুযোগ না পেয়ে থাকেন, তবে তার ‘বোনের নিকট পত্র’ কবিতাটিকে অবশ্যই তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি বিস্ময়কর কবিতা হিসেবে মেনে নিতেই হবে।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন