আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী : নীরব উত্থান, নীরব প্রস্থান-৩
সায়েক আহমদ॥
মরুর বুকে শীত ঋতুর বরষে :
ইরাকে শীতেও বৃষ্টি হয়। অবশ্য আমাদের দেশেও ইদানীং শীত ঋতুতে কোথাও কোথাও বৃষ্টির ছিঁটেফোটা লক্ষ করা যায়। কবি আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী একাকী এক বাঙালি, পড়ে আছেন ধূ ধূ মরুভূমির সামরিক ক্যাম্পে। তপ্ত মরু হাওয়ায় চারদিক ভষ্ম হওয়ার উপক্রম। এ সময়ে শীতকালে দিনে প্রচণ্ড গরম, রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। তার উপর আছে বৃষ্টির ছোঁয়া। রেজভীর কাব্যেও ফুটে উঠেছে সমসাময়িক দৃশ্যাবলী। ‘জীবন’ শিরোনামে এরকম একটি কবিতা লিখেছিলেন ১২ই এপ্রিল, ১৯৪৩ ইং বিকাল ৭-৫০ মিনিটে। ৭:৫০ মিনিটের সময়কে রেজভী বিকাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও প্রেমই কবিতাটির মূল উপজীব্য।
জীবন
জীবন মম আজি
তপ্ত মরু হাওয়াতে
ভস্ম হয়ে গেছে এই
তরুন জীবন প্রভাতে।
অরুন সম ভাবখানি আজ
কোমল প্রেমের পরশে
জ্বালিয়ে গেছে প্রাণখানি হায়
শীত ঋতুর এ বরষে।
আশা ছিল মোর উচ্চ শাখে
পর্বত সম নির্জনে
প্রাণের অধিক প্রিয়ার মুখ
দেখব কোমল নয়নে।
সংকীর্ণ মোর হৃদয়খানি
অনন্ত মোর পিপাসা
হে বিধি মোর হন্তা তুমি
করবে না তো নিরাশা?
প্রেম কেন সংসারে দেয়া?
প্রেমেই মরণ হয় গো হয়-
বিচ্ছেদে তুমি প্রেমিকে ঢাল
বিচ্ছেদেই কর লয়-প্রলয়!
মস্তকে পরে সোনার মুকুট
খলখলে ঐ হাসছে সে
কে জানে ঐ প্রেম কি দানব
যক্ষের মত হেলছে যে!
দূর হও তুমি কাছ থেকে আজ
দূর হও তুমি কায়াতে
মেরোনা নীরব প্রেমিককে তুমি
ভগ্ন নিঠুর মায়াতে।
উত্তপ্ত বালুকাময় মরুর তাবুতে বসে রেজভীর কাব্যসাধনা এগিয়ে যায় অন্য এক উচ্চতায়। বাঙালি কেউ থাকলে হয়তো রেজভী তার কবিতাগুলো শেয়ার করতে পারতেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র তো কাব্যসাধনার ক্ষেত্র নয়। রুক্ষ সে জীবনের একাকীত্ব দূর করার জন্য প্রকৃতিই যেন খুলে দিয়েছে রেজভীর মনের দুয়ার। তাই তো সে ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকল নীরব কাব্যসাধনায়।
আরো তিনমাস পর ‘জীবন’ শিরোনামেই আরেকটি কবিতা লিখেছিলেন তরুণ রেজভী। এ কবিতাটি কবি অবিনাশ আচার্য সম্পাদিত ‘এক ফর্মা ছড়াপত্র’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদক লিখেছিলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি এক তরুণ, ব্রিটিশ আর্মির সাথে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন ইরাক, ইরান, ইতালি, মিশর ইত্যাদি দেশ। কিন্তু মন পড়ে ছিল বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে ফেলে আসা শৈশবের কাছে, ‘এক পলকের একটু দেখা’ এক ষোড়শীর হৃদয়ে। সময় কাটানোর জন্য তার এ লিখাগুলো ছিল একান্তই নিজের। সময়ের আবর্তে এখন তা হয়েছে আমাদের সকলের। আমাদের ঐতিহ্যের বিস্তার ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের তাগিদ থেকে বর্তমান লেখাটি পত্রস্থ করা হল। রচনার সময়কাল ৪ জুলাই, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ, বিকাল ৬:৩০ মিনিট/ইরাক।’
সম্পাদক কবি অবিনাশ আচার্য অল্প কথায় তরুণ কবি রেজভীর কাব্যসাধনার মূলমন্ত্র তুলে ধরেছেন। এবার দেখা যাক এ কবিতাটিতে কবি রেজভীর উপলব্ধিটুকু কী ছিল?
জীবন
জানি না জীবন কেমন করে
চলছে কীসের ইঙ্গিতে,
সুখ-দুঃখ সব বইয়ে নিয়ে
তালপাতারই ডিঙিতে।
নিঙারিয়ে উঁচু-নীচু
কণ্টকময় সব বন্ধুর পথ,
সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা ছেড়ে
চলছে ধীরে জীবনরথ।
জীবন শুধু সুখের নয়
দুঃখেরও তো নয় গো সে,
বেভুলা মানব বুঝছে নারে
কেমনে কোথায় যাচ্ছে সে।
অশ্রুতে যার জীবন গড়া
অশ্রুতে কেন ‘লয়’ গো তার,
কেমনে বুঝি এ জীবন-মায়া
কেমনে করি তিরস্কার।
সমুদ্রের ঐ মধ্যজলে
জীবনতরী ভাসছে রে,
কুল নাই তার কিনারা নাই
কোথায় গিয়ে লাগবে রে।
আদম নুহ ইউসুফ নবীর
যাচ্ছিল দিন অশ্রুতে
এমনি করে যায় যদি দিন
যাক না কেন ভাবনাতে।
মহাজ্ঞানী মহাজনের
গমন যে পথে হয়েছে গো,
সেপথখানি সুপথ ধরে
চলতেই হবে চলব গো।
রেজভীর জীবনবোধের উপলব্ধিটুকু উঠে এসেছে ‘অশ্রুতে যার জীবন গড়া/অশ্রুতে কেন ‘লয়’ গো তার’- পঙক্তির মধ্যে সহজ সাবলীল উপস্থাপনায়। ‘মহাজ্ঞানী মহাজনের গমন যে পথে হয়েছে গো/সেপথখানি সুপথ ধরে চলতেই হবে চলব গো।’ এ পঙক্তিমালার মধ্যে রেজভীর সুস্পষ্ট ভাবনাগুলো বজ্রশপথের মতই উচ্চারিত হয়েছে। সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের ভয়াবহ রণক্ষেত্রে বিচরণ করে, মরুভূমির লু হাওয়ার মাঝে দাপিয়ে বেড়ানো তরুণ কবি রেজভীর এ উপলব্ধিটুকু আশি বছর পরে আজ বিস্ময়কর অনুভূতিই প্রকাশ করে!
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন