আব্দুল খালিক চৌধুরী: নৈতিকতায় আপোষহীন
সায়েক আহমদ: শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষকদেরকে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই নৈতিকতার গুণাবলী অর্জন করে নিজেদেরকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরাই সমাজ, দেশ ও জাতির অগ্রপথিক। এদের সঠিক দিক নির্দেশনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার উপলব্ধি পরিস্ফূটিত হয়। বিবেকবোধ জাগ্রত হয়। সৎ ও আদর্শ জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়। তবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আদর্শ শিক্ষকের সংখ্যাটা। কারণ যারাই শিক্ষকতাকে আদর্শ পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাদেরকেই প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদর্শ শিক্ষকরা জীবনযুদ্ধে পরাজিত হন, কিন্তু নৈতিকতার অটল অবস্থান থেকে চুল পরিমাণও সরে আসেন না। দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিষ্পেষিত আদর্শ শিক্ষকদের জীবন ইতিহাস তাই বারে বারে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় প্রস্ফূটিত হয়েছে। বিশ্বের বিখ্যাত লেখকদের কলমের আঁচড়ে ফুটে উঠেছে আদর্শ শিক্ষকদের জীবন চরিত।
মরহুম মোঃ আব্দুল খালিক চৌধুরীকে নির্দ্বিধায় নৈতিকতায় আপোষহীন শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা পেশাকে কলুষিত করেননি। বরং নৈতিকতার উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করে গেছেন। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবেও তিনি সর্বদা ন্যায়নীতির পথ অনুসরণ করতে সচেষ্ট থেকেছেন। নিয়মিত নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত নিজেও করেছেন, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরকেও উদ্বুদ্ধ করেছেন। শৃঙ্খলার সাথে জীবন যাপন করার কঠিন অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। অন্যদেরকেও ধর্মীয় আলোকে আদর্শ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে অনুপ্রাণিত করেছেন। কর্মজীবনে নীতি, আদর্শ, সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনৈতিকতার সাথে কখনও আপোষ করেননি। শিক্ষার্থীদের অন্তরে নৈতকিতা ও আর্দশ শিক্ষার বীজ বপন করতে আমৃত্যু তার চেষ্টা ছিল আন্তরিক।
১৯৪৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী পৈত্রিক বাড়ি নারায়নক্ষেত্র গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও শমশেরনগর চাতলাপুর সড়কস্থ বাসায় ছাত্রজীবন থেকেই বসবাস করছিলেন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাছিত সড়ক সড়কে ছোট্ট একটি বাসা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পিতা মরহুম মুসলিম চৌধুরী এবং মাতা সৈয়দা মস্তুরা বানুর ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ৫ম। ১৯৬১ সালে শমশেরনগর এএটিএম বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯৬৩ সালে মৌলভীবাজার কলেজ (বর্তমান সরকারি কলেজ) থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে এএটিএম বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়েই সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং চাকুরীজীবনের পাশাপাশি কঠোর অধ্যয়ন করে ১৯৬৬ সালে বিএ পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড সম্পন্ন করেন।
পরবর্তীতে দীর্ঘদিন সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন করার পর ১৯৯৬ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং ১৯৯৭ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকলেও তিনি ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে দক্ষতার সাথে নিয়মিত পাঠদান করতেন। এছাড়া স্কুলের স্কাউট শিক্ষক হিসেবে সিলেট এবং ঢাকায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নিয়মিত অংশগ্রহন করেছেন। স্কাউটের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা ছিল দেখার মত। কারণ তাঁর নীতি, আদর্শ, সততা আর নিষ্ঠার সাথে স্কাউটের বিভিন্ন কর্মকাÐের অপূর্ব সমন্বয় ছিল। তাঁর উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব তিনি সর্বদা নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। দায়িত্ব পালনে সফলতার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৯৮ সালে কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন।
দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের মাঝামাঝি সময়ে তিনি দু একবার শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবসা করারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নীতি ও আদর্শের ব্যাপারে আপোষহীন থাকায় সে ব্যবসাগুলোও বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। তাই সারাজীবন তাঁকে অর্থকষ্টেই পথ চলতে হয়েছে।
প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে স্কুলের ব্যাপক উন্নয়ন ও শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। একজন মিতব্যয়ী, স্বল্পভাষী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবেও তিনি নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল তিনি উচ্চপদে চাকুরীর সুযোগ থাকা সত্বেও মহান পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। স্বল্প বেতনের চাকুরীজীবনে অবর্ণনীয় কষ্ট করেছেন কিন্তু কখনো হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হননি। নিয়মিত ধর্ম পালনের পাশাপাশি শমশেরনগর লামাবাজার জামে মসজিদের সহসভাপতি হিসেবেও তিনি সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮০ সালের ৫ অক্টোবর তিনি সৈয়দা তৈয়বুন্নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
শেষ জীবনে তিনি ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে কষ্ট পাচ্ছিলেন। কিন্তু আজীবন স্বল্পভাষী আব্দুল খালিক চৌধুরী কখনো কারো কাছে তাঁর কষ্টের কথা প্রকাশ করতেন না। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি সকাল-বিকাল-রাত্রে অবিরাম হাঁটাহাটি করতেন। ২০০৫ সালের ২৮ মে আকস্মিকভাবে তিনি নিজ বাসভবনে ঘুমন্ত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সম্ভবত ডায়াবেটিস হঠাৎ করে অবনমিত হওয়ায় তাঁর আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুতে সারা জেলায় শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তও তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সংসার জীবনে তিনি ছিলেন তিন সন্তানের পিতা। ১ মেয়ে ও ২ ছেলে। জীবদ্দশায় একমাত্র মেয়ে মাছুমা খাতুন চৌধুরীকে প্রভাষক মোঃ মমদুদ হোসেনের নিকট বিয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্রাহ্মনবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। কিন্তু তিনি যখন মৃত্যুবরণ করেছিলেন তখন তাঁর দুটি ছেলেই ছিল ছোট। তবে জীবিত অবস্থায় দেখে যেতে না পারলেও তাঁর যোগ্য সন্তানেরা ঠিকই তাদের পিতার স্বপ্ন প‚রণ করেছে। বড় ছেলে রিয়াজুর রহমান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে এবং ছোট ছেলে মিজানুর রহমান চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত আছে।
মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরী ছিলেন আমার সম্মানিত শিক্ষাগুরু। পরবর্তীতে আমি যখন শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করি, তখন তিনি ছিলেন আমার সহকর্মী। কিন্তু আজীবন তিনি আমাকে ছাত্র হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। প্রথম দিনই তিনি আমাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, ‘শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। তুমি এ পেশায় এসেছো দেখে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। তোমার আব্বাও কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। তোমার আব্বা একজন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। কাজেই তোমাকে আদর্শ পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। তবেই তুমি প্রকৃত শিক্ষক হিসেবে নিজেকে গড়ে নিতে পারবে। তবে শিক্ষকতা জীবনে প্রচুর অর্থকষ্টে পড়তে হবে। এ কষ্টটা যদি সহ্য করতে পারো, তবেই তুমি নিজেকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।’
মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরীর কথাগুলো আমার মনে গেঁথে গিয়েছিলো। যখন ছাত্র ছিলাম তখনো তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসতেন। আমার আব্বার সাথে গল্পগুজব করতেন। তাঁদের বেশিরভাগ আলাপ আলোচনাই হত ধর্ম, নৈতিকতা ও আদর্শ নিয়ে। স্কুলজীবনে দেখেছি তিনি ছাত্রদেরকে কখনো উদ্বুদ্ধ করে, কখনো ধমক দিয়ে স্কুলসংলগ্ন মসজিদে জোহরের নামাজ পড়ার জন্য নিয়ে যেতেন। প্রায়দিনই আমাকে নামাজ পড়ার জন্য নিয়ে যেতেন। শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পরও তিনি একই কাজ করতেন।
মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরী ছিলেন একজন অত্যন্ত দক্ষ ইংরেজি শিক্ষক। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জ্যোতিষ রঞ্জন পালও ছিলেন আরেকজন দক্ষ ইংরেজি শিক্ষক। এ কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে বরাবরই ভাল করত। তৎকালীন সময়ে ক্ষুদ্র পরিসরে প্রাইভেট পড়ানোর সিস্টেমটা চালু ছিল। তাঁর বাসাটা স্কুলের ঠিক পেছনেই ছিল। অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদেরকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য তাঁর বাসায় নিয়ে গেলে তিনি কাউকে না করতেন না। তবে তিনি কখনো টাকা-পয়সার জন্য প্রাইভেট পড়াতেন না। প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী তাঁর কাছে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়েছে। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব উদাসীন। যে যা টাকা-পয়সা দিত, তিনি কোনদিনও তা গুণেও দেখেননি।
ইংরেজির শিক্ষক হলেও তিনি গণিত বিষয়েও বেশ দক্ষ ছিলেন। ক্লাসে সহজ পদ্ধতিতে পাঠদানের জন্য তিনি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতেন। এ কারণে তাঁর পাঠদান পদ্ধতি শিক্ষার্থীর বেশ পছন্দ করত।
মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আমাকে সব সময় অফিসিয়েল কাজে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করতেন। কারণ প্রয়াত প্রধান শিক্ষক জ্যোতিষ রঞ্জন পালকেও আমি দাপ্তরিক কাজে সহযোগিতা করতাম। এর আগে যখন শমশেরনগর হাজী মো. উস্তওয়ার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলাম তখন প্রয়াত প্রধান শিক্ষক মরহুম মো. বশিরউদ্দিন আহমদকেও আমি দাপ্তরিক কাজে সহযোগিতা করেছিলাম। আমার প্রথম কর্মজীবন শুরু হয়েছিল কানিহাটি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। সেখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি জাঁদরেল প্রধান শিক্ষক মো. খুরশেদউল্ল্যাহর নিকট থেকে এসব দাপ্তরিক কাজ রপ্ত করেছিলাম।
দেখা যেত, স্কুল ছুটি হওয়ার পরও অফিস সহকারী এবং ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী সহ আমরা বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন তালিকা তৈরি করছি। অনেক সময় কাজ করতে করতে সন্ধ্যা কিংবা রাতও হয়ে যেত। আমি কখনো কাজ করতে বিরক্তবোধ করতাম না। কারণ আমার প্রতি তাঁর যেন আলাদা একটা অধিকার বোধ অনুভব করতাম। বেশ ভালই লাগত। তবে এসব অফিসিয়েল কাজগুলো আমার পরবর্তী কর্মজীবনে বেশ কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। যখন রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলাম তখন নবীন প্রধান শিক্ষক হিসেবে এ কারণে আমার কোন সমস্যা হয়নি।
আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটল ২০০০ সালে। অনেকটা সখের বশে রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে ইন্টারভিউয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সৌভাগ্যবশত আমি ১ম স্থান অধিকার করায় যথাসময়ে নিয়োগপত্র পাই। যখন নিয়োগপত্রটি মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরীকে দেখালাম তিনি খুবই আনন্দিত হলেন। একই সাথে তাঁর মনটাও খারাপ হয়ে গেল। বললেন, ‘একটা উপজেলা সদরের স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করবে, এটা তো আমার জন্য একটা বিরাট পাওয়া। আমি বলতে পারব আমার ছাত্র রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তবে আমার মনটা একটু খারাপ হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম অবসরে যাবার সময় তোমাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যাব। কিন্তু সেটা বোধহয় আর হল না। তবে আমি দোয়া করি তুমি যেন সুনামের সাথে সেখানে দায়িত্ব পালন করতে পারো। তবে তোমার বয়স এখনো যথেষ্ট কম। যদি উপজেলা সদরের স্কুলটিতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চাপের মধ্যে পড়ো, তবে অবশ্যই আবার এখানে ফিরে আসতে দ্বিধাবোধ করবে না। মনে রাখবে এটা তোমার জন্মস্থানের স্কুল। শমশেরনগর এলাকাবাসী, ছাত্র-ছাত্রী এবং তোমার আব্বা-আম্মারও তোমার উপর একটা অধিকার রয়েছে। আবার এ স্কুলেই তুমি পড়াশোনা করেছো। শিক্ষকতা করেছো। কাজেই এটার প্রতি তোমার আলাদা একটা দায়িত্ববোধ রয়েছে।’
আমি ২০০০ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলাম। তার আগের দিন মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরীর বাসায় গেলে তিনি আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন। তবে নীতি ও আদর্শের সাথে চলার জন্য উপদেশ দিতেও তিনি ভুলে যাননি। এখনও তাঁর কথাবার্তা, চলাফেরা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। মাঝে মাঝে তাঁর বাসায় যাওয়ার জন্য আদেশের সুরেই অনুরোধ করতেন। বাসায় গেলে অত্যন্ত খুশি হতেন। যতবারই যেতাম তাঁর মুখ দিয়ে প্রতিবারই একটি বাক্য বের হত। তিনি তাঁর সহধর্মিনীকে ডেকে বলতেন, ‘এই, সায়েক এসেছে। তাড়াতাড়ি চা দাও। আর সাথে কিছু নাস্তা তৈরি করে দিও।’ উনার সহধর্মিনী সৈয়দা তৈয়বুন্নেছাও আমাকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। উনার ছেলে রিয়াজ ও মিজান এবং মেয়ে মাসুমা ছিল আমার খুব ভক্ত। আমি গেলেই তারাও খুব খুশি হত। উনার বাসার পাশেই ছিল মিন্টুদের বাসা। ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি অদ্ভুত সংস্কৃতিপ্রেমি পরিবার। তাদের বাসায়ও যেতে হত। মাঝে মাঝে মিন্টু, ফয়জুল, নূরুলরাও চলে আসত অথবা রিয়াজ ও মিজানকে নিয়ে মিন্টুদের বাসায় চলে যেতাম।
গত ২৮ মে ছিল মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরীর ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। দেখতে দেখতে নিমিষেই পনেরোটি বছর কেটে গেছে। ফেসবুকে নবধারা, শমশেরনগর এর ব্যানারে মিন্টু উনাকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা পোস্ট করেছিল। সাথে সাথেই অনেক কথা মনে পড়ে গেল। কালের প্রবাহে সবাই হারিয়ে যাচ্ছেন। একদিন আমাদেরকেও চলে যেতে হবে। আর বর্তমান করোনা মহামারীর যুগে কে যে কখন হারিয়ে যাবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই ভাবলাম পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এসব ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বদের পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার। মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরীর মৃত্যুর সময় যাদের জন্ম হয়েছে তাদেরও বয়স এখন পনেরো বছর। কেউ হয়ত এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছে, কেউ হয়তো ক্লাস টেনে পড়ছে। কাজেই এ প্রজন্মের কাছে এসব আদর্শ ব্যক্তিদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় এসেছে। নাহলে অতীতে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিত্বদের মত এরাও একদিন কালের প্রবাহে হারিয়ে যাবেন।
বর্তমান সময়ে শমশেরনগরকে দেখলে একটি জেলা শহর মনে হওয়াই স্বাভাবিক। নতুন প্রজন্মকে দেখি সামান্য জায়গা যেতেই রিক্সা কিংবা অটোরিক্সা ছাড়া যেতে পারছে না। অথচ মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরী শমশেরনগরের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে হেঁটেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। মাঝে মাঝে আমিও তাঁর সাথী হতাম। যতক্ষণ হাঁটতাম ততক্ষণই চলতো ন্যয়-নীতি, আদর্শ আর নৈতিকতার কথাবার্তা। উপদেশের পর উপদেশ। তবে প্রতিবারই একটি জিনিসের তাগিদ দিতে কখনো তিনি ভুলতেন না। আর তা হচ্ছে নামাজ পড়ার তাগিদ দেয়া।
মো. আব্দুল খালিক চৌধুরী ধর্মভীরু হলেও ধর্মান্ধ ছিলেন না। অন্য ধর্মের প্রতি কটাক্ষ করে কথা বলতে তাঁকে কখনো দেখিনি। উচ্চস্বরে কিংবা প্রচÐ রেগেও তিনি কথা বলতেন না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন তিনি এক নৈতিকতার অদৃশ্য জালে আবদ্ধ ছিলেন। কখনো তিনি এ জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার দুঃসাহস প্রদর্শন করেননি।
মরহুম মো. আব্দুল খালিক চৌধুরী ছিলেন একজন প্রচারবিমুখ আদর্শ শিক্ষক। তাইতো ১৯৯৮ সালে কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরও তাঁর মধ্যে অতিরিক্ত কোন উচ্ছ¡াস দেখিনি। হয়ত তিনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতার অধিকারী ছিলেন না, বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন না, কিন্তু নৈতিকতার মাপকাঠিতে তিনি ছিলেন একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। তিনি আদর্শের যে উজ্জ্বল প্রদীপ জ্বালিয়ে গেছেন, তা সহস্র শাখায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে চিরকাল আলোকিত করবে অনাগত প্রজন্মকে। আজীবন নৈতিকতায় আপোষহীন আব্দুল খালিক চৌধুরীকে তাঁর সৎ জীবনযাপনের মহিমায়, অবশ্যই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁকে খাস বান্দা হিসেবে গ্রহণ করবেন- এ প্রার্থনা করি।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন