আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গঁবীর জেনারেল মোহাম্মদ আতাউলগনী ওসমানী (অবঃ) জন্ম শত বার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিধান মোতাবেক আদমে (আঃ) আওলাদ এবং উম্মতে মোহাম্মদী (দঃ) এই মানবজাতি আশরাফুল মাকলুখাত-সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব হলেও মানুষ মরনশীল। প্রাণীকুলের মৃত্যো প্রসঙ্গেঁ স্বয়ং সর্ব্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালা আসমানী কিতাব আল কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষনা করেন- “কুল্লুন নাফসীন জ্যায়িকাতুল মউত”। জগতের সকল প্রানীকেই একদিন মৃত্যোর কোলে ঢলে পড়তে হবে-মৃত্যোর সঙ্গেঁ আলিঙ্গন করতে হবে-মৃত্যোর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। ইসলামি চিন্তাবিদ কবি ও দার্শনিক শেখ সাদী (র) জীবন প্রসঙ্গে বলেন-
জিন্দেগী এহিত হ্যায় এক মোসাফির খানা,
জানেহগা জরুর, কোয়ি আগে, কোয়ি পিছে-”।
জন্ম ও মৃত্যোর মধ্যবর্ত্তী কালীন সময়ের নাম জীবন। দেওয়ানী আইনের পরিভাষায় এই সময় কে এ্যডিনটারিম পিরিওড-অন্তবর্ত্তীকালীন সময় বলা যেতে পারে।
ইসলামী চিন্তাবিদ দার্শনিকগন মানবাত্বার ক্রম বিকাশের ধারাকে -ক. আলমে আরওয়া-রুহের জগত, খ. মাতৃগর্ভ, গ. মাটির পৃথিবী, ঘ. কবর, ঙ. হাসর, চ. জান্নাত, ছ. জাহান্নাম এই কয়ভাগে বিভক্ত করেছেন। পৃথিবী ক্ষনস্থায়ী হলেও এই ক্ষনকালে কিছু ক্ষনজন্মা-কৃতি পূরুষ তাদের শিক্ষা ও জ্ঞান, মেধা ও মনন, প্রজ্ঞ্যা ও পান্ডিত্য, কর্তব্য-পরায়নতা ও কর্তব্য নিষ্টা, সততা ও মহত্ব দ্বারা সমাজ, জাতি ও দেশ গঠনে এমন কিছু কাজ করে যান যাতে দেশও জাতি চীরকাল তাঁরেরকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরন করেন, বরন করেন ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বৃহত্তর সিলেটের গর্ব ও গৌরব বঙ্গঁবীর জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনী ওসমানী তেমনি একটি শ্রদ্ধেয় নাম, কৃতি ব্যক্তিও ব্যাক্তিত্ব। আঠারো সালের পহেলা সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল সেনানায়ক বঙ্গঁবীর জেনারেল আতাউল গনী ওসমানীর শুভ জন্মদিন-জন্মশত বার্ষিকী। ১৯১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বৃটিশ ভারতের সুনামগঞ্জ মহকুমায় খান বাহাদুর মফিজুর রহমান এর ঔরসে মানবশিশু আতাউল গনীর জন্ম। তাঁর পিতা তখন সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক হিসাবে কর্ম্মরত।
বঙ্গঁবীর জেনারেল ওসমানীর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর উজ্জল স্মৃতির প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি। পিতা মফিজুর রহমান এর পৈত্রিক নিবাস সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলাধীন দয়ামীর একটি শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী এলাকা। একটি ঐতিহ্যবাহী পীর বংশের গৌরবোজ্জল উত্তরাধিকার এই ওসমানী পরিবার। ওসমানী সাহেবের পিতা ভারতীয় সিভিল সার্ভিস এ যোগ দিয়ে কৃতিত্ব, সততা ও সুনামের সাথে সরকারি চাকরি ও জনসেবা করে তৎকালীন বৃটিশ সরকার কর্তৃক সম্মানসূচক খান বাহাদুর খেতাবে ভূষিত হন। অসম্ভব রকমের মেধাবী ছাত্র আতাউল গনী ওসমানী ভারতীয় সিভিল সার্ভিস এর প্রতিযোগিতা মূলক পরিক্ষা-আই.সি.এস. কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হলেও তিনি পিতার মত আই.সি.এস. অফিসার না হয়ে তিনি কঠোর ও কঠিন নিয়মানুবর্তিতার সৈনিক জীবনের প্রতি উৎসাহী হয়ে প্রতিযোগিতা মূলক পরিক্ষায় কৃতিত্বের সাথে সাফল্য অর্জন করে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। মাঝারি উচ্চতা এবং হালকা পাতলা গড়নের বাঙ্গাঁলি আর্মি অফিসার ওসমানী চাকরি জীবনে চমক দেখান- মাত্র বাইশ বৎসর বয়সে মেজর পদে উন্নীত হয়ে। অথছ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে রাজপুত, মারাঠা,পাঞ্জাব,পাঠান,বেলুচ সৈনিকদের দাপট ও প্রাধান্য ছিল। মিলিশিয়া নেশন হিসাবে বাঙ্গাঁলি জাতির খ্যাতি ও সুনাম ছিল না। অথছ ৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানী বাঙ্গাঁলী সেনা কর্ম্মকর্তাগন রনাঙ্গঁনে বীরত্ব প্রদর্শন করেন, একাত্তোরের মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙ্গাঁলি মুক্তিসেনার দল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সমুচিত-দাতভাঙ্গাঁ জবাব দিয়েছেন, লক্ষ সৈনিকের পাকিস্তানী সেনাপতি লেঃ জেনারেল এ.এ.কে নিয়াজীকে আত্ব সমর্থন করতে বাধ্য করিয়েছেন।
বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর চৌকশ সেনা কর্ম্মকর্তা The youngest major of british indian army major muhammed ataul goni osmani সাতচল্লিশ সালের ভারত বিভক্তি এবং এই উপমহাদেশ দ্বিখন্ডিত হয়ে পাকিস্তান-হিন্দুস্থান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলে ওসমানী সাহেব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে সংযুক্ত হন। পাকিস্তানী স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের বাঙ্গাঁলী সেনাকর্ম্মকর্তা গন প্রয়োজনীয় পদোন্নতি এবং ন্যায্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। পাকিস্তানী উচ্চাভিলাসী পাঞ্জাবী আমলাতন্ত্র এবং ক্ষমতা লিপ্সু সামরীক জান্টা বাংলা ও বাঙ্গালিকে কখনও সুনযরে দেখেনি। ফলতঃ
ওসমানী সাহেবের মত যোগ্যতা সম্পন্ন মেধাবী আর্মি অফিসারকে ষাটের দশকে মাত্র কর্নেল পদমর্য্যাদায় অবসর গ্রহন করতে হয়। তখন থেকে তিনি কর্নেল ওসমানী নামেই পরিচিত ও অভিহিত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় কোথাও কখনও কোন দিনই কর্নেল ওসমানী রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি। প্রয়োজনীয় পদোন্নতি না হওয়ার কারনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নি। ঐ দশকে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গাঁলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চুড়ান্ত আকার ধারন করলে কর্নেল ওসমানী বঙ্গঁবন্ধুর আহ্বানে আওয়ামীলীগে যোগদান করতঃ প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহন করেন। সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বৃহত্তর সিলেটের বৃহত্তম নির্ব্বাচনী এলাকা বালাগঞ্জ-বিশ^নাথ থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এর সদস্য -এম.এন.এ নির্বাচিত হন। সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে পাকিস্তানের উভয় পরিষদে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীগন বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, কাল ক্ষেপন অনীহা প্রকাশ করতে থাকেন পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট লেঃ জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ও তার সরকার। দ্বিপক্ষীয়-ত্রিপক্ষিয় আলোচনার নামে সময় কর্তন ও সৈন্য বৃদ্ধি করতঃ একাত্তোরের পচিশে মার্চ ÔOperation search light’ নামে বাংলা ও বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট, তার সরকার এবং পাকিস্তানের ক্ষমতা লিপ্সু দূর্নীতিবাজ সেনাবাহিনী।
দেশ ও জাতির এই মহাক্রান্তি কাল ও কঠিন সময়ে এগিয়ে এলেন কর্নেল ওসমানী এম.এন.এ। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত প্রবাসী মুজিব নগর সরকার ১৭ এপ্রিল শফথগ্রহন করে। বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন গঠিত প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী এম.এন.এ কে প্রধান সেনাপতি এবং কর্নেল এম.এ রবকে চীফ অব ষ্টাফ নিযুক্ত করেন। প্রবাসী সরকার কর্তৃক স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নির্বাচিত হয়ে কর্নেল ওসমানী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টারে বিভক্ত করে ১১ জন সেক্টার কমান্ডার নিযুক্ত করেন। এই সব সেক্টার কমান্ডারদের সঙ্গেঁ সাব সেক্টার কমান্ডারও ছিলেন। এই ১১ সেক্টারের ১১জন সেক্টার কমান্ডার ছাড়া বেঙ্গঁল লিবারেশন ফ্রন্ট-বি.এল.ফ এর সামরীক সংগঠন মুজিব বাহিনীর চারজন আঞ্চলিক অধিনায়ক ছিলেন। অধিনায়ক চতুষ্টয় হলেন সিরাজুল ইলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমদ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল এস.এস উভান মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষনের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া দেশের ভিতরে কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী গেরিলা পদ্ধতিতে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, বিশেষতঃ আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর বিপুল সংখ্যক অকুত ভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা টাইগার সিদ্দীকীর নেতৃত্বে ময়মন সিংহ-টাঙ্গাইল এলাকায় বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছেন। এই সব গেরিলা বাহিনী ও অধিনায়কদের প্রবাসী মুজিবনগর সরকার এর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি জনযুদ্ধ হলেও একটি পেশাদার রেজিমেন্টাল বাহিনীর কনভেনশনেল ওয়ার প্রথাগত যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন কর্নেল ওসমানী। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষ কোথাও কিঞ্চিত ভূল বুঝাবুজি এবং সমন্বয়হীনতা থাকলেও কঠোর ও কঠিন নিয়ম নীতির অনুসারি সি.ইন.সি কর্নেল ওসমানী সমন্বয় সাধন করে চলেছেন। তাঁর বলিষ্ট ও গতিশীল সামরীক নেতৃত্বে ন’মাসের মুক্তিযুদ্ধে শত অভাব অভিযোগ-দূঃখ কষ্ট ও বেদনার মাঝেও একটি চেইন অব কমান্ড ছিল, নিয়ম শৃঙ্খলা ছিল, বিশৃঙ্খলা ছিলনা। মুক্তি যোদ্ধাদের প্রশিক্ষনের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন খুবই আন্তরিক এবং কঠোর-কঠিন নিয়মনীতির অনুসারি। সিভিলিয়ানদের মধ্য থেকে একটি প্রশিক্ষিত এলিট ফোর্স গঠনের জন্য সি-ইন-সি স্পেশিয়াল ব্যাচ-এর ব্যবস্থা করা হয়। জন প্রতিনিধি, জননেতা, উচ্চ শিক্ষিত তরুন যুবকদের নিয়ে গঠিত আমাদের জেলা এলাকায় এম.পি.এ আজিজুর রহমান, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বিশিষ্ট ছাত্র নেতা আব্দুল আহাদ চৌধুরী (পরে অধ্যক্ষ। মুক্তিযোদ্ধা সাংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের দীর্ঘকালীন সফল চেয়ারম্যান), সৈয়দ মহসিন আলী (পরে পৌর চেয়ারম্যান। সাংসদ। মন্ত্রী। মরহুম) প্রমুখ সি-ইন-সি স্পেশাল ব্যাচ এর প্রশিক্ষিত যোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ন ভূমিকা ও বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কর্নেল ওসমানীর বলিষ্ট ও গতিশীল নেতৃত্বে মাত্র ন’মাসে পাকিস্তানী বাহিনী মাথা নত করে। পরজয় মেনে নেয়। প্রধান সেনাপতি ওসমানীর আজীবনের দূঃখ ষোলই ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্ব সমর্পনের সেই ঐতিহাসিক অনুষ্টানে উপস্থিত হতে না পারা। গ্রুপ কেপ্টেন এ.কে খন্দকার প্রবাসী মুজিবনগর সরকার এর প্রতিনিধিত্ব করছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে তাঁর মন্ত্রী সভায় তিনি নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পান। আমি তখন মাষ্টার্স শেষে পড়ার পাট চুকিয়ে সার্বক্ষনিক লেখালেখিতে লেগে যাই। শেখ ফজলুল হক মনি সম্পাদিত দৈনিক বাংলার বানিতে ষ্টাফ রিপোর্টার হিসাবে কাজ করছেন অনুজ প্রতিম মতিউর রহমান চৌধুরী। আমি যোগ দিয়েছি সৈয়দ আহমদ ফারুক সম্পাদিত সাপ্তাহিক বাংলাদেশের কার্য্য নির্ব্বাহী সম্পাদক হিসাবে। শেখ গোলাম মোস্তফা এবং ষ্টাফ রিপোর্টার মতিউর রহমান চৌধুরীর (বর্ত্তমানে মানবজমিনের প্রতিষ্টাতা প্রধান সম্পাদক। বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব) প্রেরনা ও সহযোগীতায় দৈনিক বাংলার বানীতে ফিচার লেখা শুরু করি। প্রিয় শহর ঢাকা তখন ছিল ছিমছাম। জনসংখ্যা ও যানবাহনের চাপে এখনকার মত জান প্রান যায় যায় অবস্থা ছিলনা। আমার ফিচার সমূহ পাঠক প্রিয়তা পেলে একদিন জেনারেল ওসমানীর মিন্টু রোডস্থ সরকারি বাসগৃহে হানা দেই। প্রসঙ্গঁত উল্লেখ্য স্বাধীনতা উত্তর কালে বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে সম্মান সূচক জেনারেল পদে উন্নীত করেন। তখন মোবাইল সিস্টেম ছিলনা, কোন যোগাযোগ ছাড়া বাসায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায় নি। মাননীয় মন্ত্রী ওসমানী সাহেবকে সরকারি বাসায় না পেলেও বেশ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এলাম। তার দপ্তর ড্রয়িং রুম, বৈঠক খানায় কোন বাহারি সাজগোজ নেই। অতি সাধারন আসবাবপত্র। প্রধান ফটকে দারোয়ানের দৌরাত্ব নেই-অবারিত দ্বার। কোন দালাল-টাউট-মতলব বাজ-ধান্দাবাজ দের কেউই নেই, আছেন শুধুমাত্র একদল দরিদ্র বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধার দল। মন্ত্রী ওসমানীর সঙ্গেঁ আমার স্বাক্ষাত না হওয়া এবং স্বাভাবিক ভাবেই স্বাক্ষাতকার নিতে না পারায় দূঃখের মাঝে বাড়তি পাওনা হল বঞ্চিত-দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাত ও তাদের আহাজারি। মাননীয় মন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব বেশিদিন পালন করেননি নৌ মন্ত্রী জেনারেল ওসমানী। সেসময় মন্ত্রনালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি, (বর্ত্তমানে অবঃ সচিব। কবি ও কলামিষ্ট) এ.এইচ মোফাজ্জুল করিম এর একটি হৃদয়গ্রাহী রচনা-“ও জেনারেল মাই জেনারেল”- এ কর্ম্মবীর ওসমানীর কর্মচাঞ্চল্য ও পান্ডিত্যের প্রমান পাওয়া যায়। উদার গনতন্ত্রী জেনারেল ওসমানী একদলীয় শাসন ব্যবস্থা-বাকশাল-প্রসঙ্গেঁ তথা সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে দ্বিমত পোষন করে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দেশীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখার আশায় গঠন করেছিলেন জাতীয় জনতা পার্টি। শুরুতে কেন্দ্র থেকে নিজ জেলা সিলেট পর্য্যন্ত গন্যমান্য নেতৃবৃন্দের সমাবেশ ঘটেছিল জাতীয় জনতা পার্টিতে। আমাদের অঞ্চলে নবাব আলী ছরোয়ার খানের মত গন্যমান্য সাবেক সাংসদ, মোহাম্মদ ফিরোজ এর মত প্রবীণ আইনজীবী, শফকতুল ওয়াহেদের মত প্রবীন সাংবাদিক এডভোকেট সৈয়দ জয়নাল আবেদীন এর মত বিশিষ্ট লেখক-গবেষক এবং ডাঃ আব্দুল আলীর মত বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং সুবোধ চক্রবত্তীর মত বিশিষ্ট ধর্মগুরু যোগদান করলেও রাজনীতির মাঠে-ময়দানে কোন ফল দেয়নি। দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গনতান্ত্রিক ঐক্যজোট-তথা সর্বদলীয় প্রার্থী হলেও তিনি শোচনীয় ভাবেই পরাজয় বরন করেছিলেন। ভোটের রাজনীতিতে জেনারেল ওসমানী কোন গুনগত মৌলিক পরিবর্তন আনতে না পারলেও সততা ও নিয়মানুবর্তিতার ক্ষেত্রে তিনি যে উজ্জল উদাহরন রেখে গেছেন তা দেশ ও জাতির জন্য অনুসরনীয় বটে।
কৃতজ্ঞ জাতি বঙ্গঁবীরের সম্মান ও স্মরনে ঢাকাস্থ ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন, সিলেট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তারই নামে নামাকরন করেছেন। এমতবস্থায় তাঁর জন্মশত বার্ষিকী সামনে রেখে গত সাতই আগষ্ট দৈনিক সমকাল একটি সচিত্র সংবাদ প্রকাশ করেনঃ -“নবছরেও চালু হয়নি ওসমানী গ্রন্থাগার ও স্মৃতি যাদুঘর-”। অযতেœ অবহেলায় পড়ে আছে ভবন ও আসবাবপত্র।”
বিগত তত্বাবধায়ক সরকারামলে ২০০৮ সালের ২২ শে ডিসেম্বর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ. আহমদ বঙ্গঁবীরের দেশের বাড়ীতে ওসমানী স্মৃতি যাদুঘর ও পাঠাগার এর ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেছিলেন। ৮২ লক্ষ টাকা ব্যায় -এ- সিলেট জেলা পরিষদ এর অর্থায়নে মহতি প্রকল্পটি নয় সালে নির্মান কাজ শেষ হলে দামী আসবাবপত্রও আসে। বাগানও তৈরী হয়, কিন্তু লোকবল এবং রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে যাদুঘরটি অরক্ষিত, পাঠাগার তালাবদ্ধ। পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ বঙ্গঁবীর ওসমানী স্মৃতি সংসদ সিলেট এর সভাপতি সৈয়দ আহমদ বহলুল বলেন, ইতিপূর্বে নামকাওয়াস্তে উদ্ভোধন হলেও এর পূর্নাঙ্গঁ কার্যক্রম চালু হয়নি। রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে দামী আসবাবপত্র গুলি বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, দেখার কেউ নেই। সিলেট জেলা পরিষদ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল আহাদ বলেন লোক বলের জন্য লেখা হয়েছে-”। এটা অত্যন্ত দুঃখ দুর্ভাগ্য ও বেদনাদায়ক ব্যাপার এই যে, খোদ বঙ্গঁবীরের পিতৃভূমি এবং নিজ জেলায়ই শুধু মাত্র আন্তরিক উদ্যোগ এবং লোকবলের অভাবে একটি মহতি প্রকল্প সু-সমাপ্তি এবং শুভ উদ্ভোধনের পরও কার্য্যক্রম বন্ধ। জেলা পরিষদ একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্টান। জেলা পরিষদের বর্ত্তমান নির্ব্বাচিত চেয়ারম্যান এডভোকেট মোঃ লুৎফুর রহমান একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। সিনিয়র আইনজীবী এবং একজন স্বজ্জন ব্যাক্তি। তিনি নিজেও মহান মুক্তিযোদ্ধের একজন সংঘটক। মুক্তিযুদ্ধা সমাজ আশা ও দাবী করেন তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে উদ্যোগ নিয়ে বঙ্গঁবীরের জন্মশত বার্ষিকীর মাসেই প্রকল্পটির কার্য্যক্রম পরিপূর্ন ভাবে চালুর মর্মে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। নেয়াবেন।
বৃহত্তর সিলেটের একটি অভিজাত খান্দানী পরিবারের সুসন্তান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গঁবীর জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনী ওসমানী মেজাজি ছিলেন – বদমেজাজি ছিলেন না, আত্বমর্য্যাদা সম্পন্ন ছিলেন, অহংকারী ছিলেন না, তাঁর কোন অহংকার কিংবা তকব্বরি ছিল না, বরং তিনি ছিলেন নিরহংকারী -নির্লোভ মহৎ মানুষ, সৎ মানুষ, সহজ সরল সাদামনের মানুষ। তাঁর দেশপ্রেম, সততা, নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যপরায়নতা ও কর্তব্যনিষ্টা অবক্ষয় ও ভ্রষ্টাচারের জোয়ারের মাঝে শিক্ষনীয়। তাঁর বিশাল গোঁপের আড়ালে লুকায়িত ছিল তাঁর মানব প্রেম কোমলমন ও মহৎ মানষিকতা। স্পষ্টবাদি-সত্যবাদি হলেও তিনি হৃদয়হীন পাষান ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন বন্ধু বৎসল, কর্মি বৎসল, সহজ সরল সাদা মনের মানুষ। তিনি গড ফাদার ছিলেন না, ছিলেন লাইক এ রিয়েল ফাদার। অকৃতদার হলেও সেনাবাহিনীও দেশের জনগনই ছিলের তাঁর পরিবারের মত। বেঙ্গঁল রেজিমেন্ট-বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই ছিল তার প্রাণ ধ্যান।
আমাদের মৌলভীবাজারে ষাটের দশকে এসডি ও অফিসে চাকরী করতেন মৌলভী মোঃ মসদ্দর আলী। কোর্ট এলাকায়ই তার বাসা। উজ্জল ফর্সা চেহারার মরহুম আলীর সকল সন্তানগনও ফর্সা চেহারার অধিকারী। তারপুত্র আব্দুল মুকিত স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদাত বরন করেছেন। মরহুম মসদ্দর আলী ওসমানী সাহেবের বাল্য বন্ধু ও সহপাঠি ছিলেন। ফর্সা হিসাবে ওসমানী সাহেব মরহুম আলীকে ধলা মসদ্দর বলেই ডাকতেন, কারন তাদের ক্লাশে আরেকজন কালিয়ানা মসদ্দর আছেন। জেনারেল ওসমানী আজীবন তার বাল্যবন্ধুর সঙ্গেঁ সম্পর্ক রাখতেন চিঠিপত্র দিতেন বলে মরহুম মসদ্দর আলী সাহেবের একজন পুত্র আমাকে জানালেন। জেনারেল ওসমানী লিখিত মাইডিয়ার ধলা মসদ্দর পত্র এখনও তাদের পারিবারিক হেফাজতে আছে বলে জানালেন মরহুম মসদ্দর আলীর এই সু-পুত্র। জেনারেল ওসমানী কেমন বন্ধু বৎসল ছিলেন একটি ঘটনাই তার প্রকৃষ্ট প্রমান।
কর্ম্মি বৎসল ওসমানীর স্বাক্ষি স্বয়ং আমি নিজে। জাতীয় জনতা পার্টি প্রতিষ্টার পর তার কতেক কর্মি বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মি হিসাবে জেলাবারে যোগদানের পর থেকেই পেশাগত ভাবে ব্যস্ত হই, দুবার জেলা বারের সম্পাদক নির্বাচিত হই। রাজনৈতিক মামলা হিসাবে জাতীয় জনতা পার্টির মামলাটি আমার কাছে আসে। তখন মোবাইল সিস্টেম ছিলনা, ল্যেন্ড ফোন এর ব্যবহার ছিল সীমিত ও সীমাবদ্ধ। একদিন সন্ধ্যায় আমার বাসগৃহস্থ চেম্বারের ল্যেন্ড ফোনটি ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল। তখন আমার ভরা যৌবন কাল। কথাবলি উচ্চ কন্ঠে, হাসি ছাদ ফাটিয়ে। রিসিভার হাতে নিয়ে কায়দা করে বল্লাম-হ্যেলো স্লামালিকুম। মুজিব বলছি, কে বলছেন, কাকে চাই-” কথা শেষ করার আগে ওপর প্রান্ত থেকে ভারি কন্ঠে উচ্চারিত হল- General Osmani here, can I speak with advocate Mujib” তাঁর জলদ গম্ভীর কন্ঠে আমার হাত থেকে রিসিভার ফসকে গেল। লাফ দিয়ে তড়িত গতিতে দাড়িয়ে উঠে হাত দিয়ে স্যেলুট করে ইয়েস স্যার বলে এ্যটেনশন হয়ে দাড়ালাম। জাতীয় জনতা পার্টির প্রতিষ্টাতা প্রধান হিসাবে জেনারেল ওসমানী তার কর্ম্মি বাহিনীর জন্য আপত্য ¯েœহ নিয়ে আমাকে আন্তরিকভাবে মামলা চালাতে অনুরোধ করলেন, তাঁর কর্মি বাহিনী দলীয় কারনে মামলার আসামী হওয়াতে দূঃখ প্রকাশ করলেন। একজন চেনা আইনজীবী হিসাবে আমরা বিভিন্ন সময় অনুরোধ পাই, তদবির এর সম্মুখীন হই। আমার পেশাগত জীবনের চরম সৌভাগ্য ও পাওয়া এই যে, একটি মামলা পরিচালনার জন্য জেনারেল ওসমানীর মত কঠিন মানুষ আমাকে অনুরোধ করেছেন। তাঁর কর্ম্মি বাহিনীর প্রতি মায়া-মমতায়ও আমি বিমুগ্ধ হয়েছি। এই একটি ঘটনা থেকেই বলাচলে বঙ্গঁবীর জেনারেল ওসমানী একজন জনদরদি জননেতা এবং কর্ম্মি বৎসল রাজনীতিবিদ ছিলেন।
আতাউল গনী ওসমানীর খন্ডিত মানব জীবন ছিল ১৯১৮ সাল থেকে ১৯৮৪ সলের ১৬ ফেব্রুয়ারী পর্য্যন্ত। লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মহান মৃত্যেকে আলিঙ্গঁন করেন। পীরানে পীর হযরত শাহজালাল ইয়েমেনীর (রঃ) দরগা শরীফ গোরস্থানে তাঁকে চীর শয়ানে শায়িত করা হয়। ওসমানীর পূর্ব পূরুষ হযরত শাহজালালের সফর সঙ্গীঁ তিনশত ষাট আউলিয়ার অন্যতম ছিলেন। তাঁর পূর্ব পূরুষের পীরের পাশেই তিনি চীর শয়ানে শায়িত। জাতীয় ও সরকারি ভাবে না হলেও স্থানীয় বেসরকারি ভাবে বঙ্গঁবীরের জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন চলছে। পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ সাবেক সেনাপ্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা লেঃ জেনারেল হারুনুর রশীর বি.পি.কে প্রধান করে বঙ্গঁবীরের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রকৃতি প্রেম ও বৃক্ষরোপনে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সিলেটের বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিষ্ট বন্ধুবর আফতাব চৌধুরীও এই সু সংবাদ জানিয়ে লেখা পাঠাবার অনুরোধ করলেন।
কর্ম্মবীর-বঙ্গবীর-জেনারেল ওসমানীর বর্নীল-বর্নাঢ্য-কর্ম্ম ও জীবন দর্শনের উপর রচনা লেখা কিংবা তাঁকে নিয়ে স্মৃতি কথা লেখার দূঃসাহস ক্ষমতা ও যোগ্যতা আমার নেই। তাঁর জন্মশত বার্ষিকীতে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সরকারের কাছে জোর দাবী স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গঁবীর জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর জন্ম ও মৃত্যো বার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হউক। তাঁর প্রাপ্য সম্মান তাঁকে প্রদান করা হউক-কেনানা কথায় আছে, যে জাতি বীরের মর্য্যাদা দেয়না সেদেশে বীরের জন্ম হয়না।
বঙ্গঁবীর ওসমানী চীরকুমার-নিঃসন্তান হলেও লক্ষ লক্ষ মুক্তি সেনা তাঁর সন্তান তুল্য। বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্যই এসেছে, ইনশাল্লা রোজ কিয়ামত পর্য্যন্তই বাংলাদেশ টিকে থাকবে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গঁবীর জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর নাম উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়-মায়ায় মমতায়।
পহেলা সেপ্টেম্বর আঠারো সাল বঙ্গঁবীরের জন্মশত বার্ষিকীতে তাঁর উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছিঃ মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করছি।
[লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট হাই কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। কবি ও কলামিষ্ট]
মন্তব্য করুন