আমার পিতা নিভৃতচারী কর্মবীর মোঃ বজলুর রহমান’
খালিদ সাইফুল্লাহ্॥ মহান আল্লাহ তায়ালার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিজগতে সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি মানুষ । আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেনঃ আমি জিন ও ইনসানকে (মানুষ) আমার ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছি । কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা সমাজের কল্যাণে নিজেকে উজাড় করে বিলিয়ে দেওয়ার মাঝেই প্রকৃত সুখ খুঁজে পায়, এটিকে তারা ইবাদত হিসেবে গণ্য করে, এমনই একজন আমার পিতা নিভৃতচারী কর্মবীর মোঃ বজলুর রহমান; যিনি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলাধীন কুমড়াকাপন এলাকার এক ধর্নাঢ্য মুসলিম পরিবারে ১৯৫৬ ইংরেজির ১ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দানবীর মরহুম মৌলভী মকবুল আলী, মাতা মরহুমা সৈয়দা আছিয়া খাতুন; যিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা আমাইশা (রহ.) এর সুযোগ্য বংশধর ও শিক্ষাবিদ মরহুম সৈয়দ আফতাব আলী মাষ্ঠার এর সুযোগ্য কন্যা। তাঁর বড়োচাচা উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনৈতিক ও দানশীল ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব কেরামত আলী (সাবেক এমএলএ ও এমএনএ) । তিনি ভাইদের মধ্যে সবার বড় ।
তিনি ছোটবেলায় স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক পর্যায় শেষ করে কমলগঞ্জ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পড়ালেখার পাশাপাশি পিতার বিশাল ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন । দেশ স্বাধীনের পর পটপরিবর্তন ঘটলে পিতা তৎকালীন মুসলিমলীগ নেতা মৌলভী মকবুল আলীর অবর্তমানে বিশাল মহালদারীর পুরো দায়িত্ব পালন করেন । কিন্তু তিনি তৎকালীন প্রতিকূল পরিস্থিতিকে শক্তভাবে মোকাবিলা করে একপর্যায়ে হাফিয়ে উঠেন। তারপর থেকে পড়ালেখায় অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তবে তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন অধ্যক্ষ মরহুম মাওলানা হরমুজুল্লাহ সায়দা’র সান্নিধ্যে দীর্ঘদিন একান্তে দ্বীনি শিক্ষা নেন, সেই সুবাদে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে সক্ষম হন।
সত্তরের দশকে মোঃ বজলুর রহমান একজন সফল মহালদার হিসেবে অল্পবয়সেই যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন । তাঁর ব্যবসায়িক সততা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে বন বিভাগের উচ্চপদস্থ-নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রবীণ মহালদারগণ তাঁকে অনেক স্নেহ করতেন এবং মূল্যায়ন করতেন । পরবর্তীতে তিনি ঠিকাদারী ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। কমলগঞ্জ উপজেলার পুরাতন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকগুলোই তাঁর তত্বাবধায়নে করা হয় । যে প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ কয়েকযুগ পরও টেকসইভাবে দাঁড়িয়ে তাঁর সততার প্রমাণ বহন করছে। তিনি খুব অল্পদিনের মধ্যেই নিজেকে একজন সৎ, কর্মনিষ্ঠ ও নির্লোভ প্রভাবশালী প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন । এছাড়াও তৎকালীন সময়ে তিনি বৈধভাবে পাঁচ ধরনের ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন ।
তিনি সাংসারিক জীবনে সৈয়দা খালেদা রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । তাঁদের চার ছেলে-মেয়ে যথাক্রমে মোছাঃ সুমাইয়া রহমান সায়মা, মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্ রহমান, মোছাঃ মেহজাবিন রহমান রাহনুমা ও মোছাঃ ফারজানা রহমান ফাহিমা।
তিনি ঐতিহ্যবাহী এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই জাসদের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন । তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের মাধ্যমে মেজর জলিলের হাতে গড়া জাসদকে কমলগঞ্জ উপজেলায় সুসংগঠিত হতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন । আশির দশক থেকে শুরু করে জাসদের কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক টানা ছয়বার নির্বাচিত হন । এক্ষেত্রে জাসদ কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি তিনবার এবং জাসদ কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তিনবার নির্বাচিত হন । তাছাড়া একাধিকবার জাসদ জেলা শাখার কার্যকরী কমিটির সদস্যও ছিলেন। সর্বশেষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র কমলগঞ্জ পৌরসভা শাখার অন্যতম সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে একজন বর্ষিয়ান রাজনীতিক হিসেবে উপস্থাপন করেন।
মোঃ বজলুর রহমান দানশীল পিতা ও বড়োচাচার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেকে একজন শিক্ষানুরাগী , সমাজসেবক ও গ্রাম্য সালিশ বিচারক হিসেবে সমাজে উপস্থাপন করেন । তিনি সিলেট বিভাগের মধ্যে প্রসিদ্ধ স্নাতক সমমান এর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী সফাত আলী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার (পিতামহের নামে নামকৃত) গভর্নিংবডির নির্বাচনে অভিভাবকদের ভোটে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন ও অত্র প্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডির পর পর তিনবার নিয়োগ বোর্ডের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং অত্র প্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডির পরপর দুইবার সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন । তিনি অত্র প্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে পর্যায়ক্রমে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মহোদয় । তিনি ঐতিহ্যবাহী কমলগঞ্জ মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এর গভর্নিংবডির শিক্ষানুরাগী সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। অরাজনৈতিক সামাজিক উন্নয়নমূলক সংগঠন হাজী মুজিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। উক্ত সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন ।
তিনি বড়োচাচা আলহাজ্ব কেরামত আলী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সফাত আলী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার গভর্নিংবডির সহ-সভাপতি ও নিয়োগ বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রায় অর্ধশত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগপ্রাপ্ত হয় । এক্ষেত্রে তিনি স্বজনপ্রীতি ও দলীয় মনোভাবের উর্ধে উঠে সৎ, মেধাবী ও গরীবদের নিয়োগপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন । তখন ঘুষের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেন, আর এভাবেই ঘুষের বিরুদ্ধে অনড় অবস্থানের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেনকারী প্রভাবশালী সিন্ডিকেট অনেকটাই ভেঙ্গে দিতে সচেষ্ট হন। তিনি বিভিন্ন সময়ে মাদরাসা ও স্কুলে শতাধিক গরীব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিনা বেতনে কিংবা আধাবেতনে পড়ালেখার সুযোগ করে দেন ।
হাজী মুজিব ফাউন্ডেশনের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের মধ্যে অন্যতম কমলগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদীর বাঁধ নির্মাণ । যে বাঁধটি বার বার ভেঙ্গে বন্যায় রূপ নিয়ে সমগ্র মৌলভীবাজার জেলার মানুষকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে । সরকারের অর্ধায়নে এই বাঁধ নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ছিল না। অত্র অঞ্চলের মানুষ যখন এই বন্যা থেকে মুক্তির আশা একেবারেই ছেড়ে দেয়। তখন হাজী মুজিব ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে কমলগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর এলাকায় মোঃ বজলুর রহমানের পরিকল্পনায় ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে ধলাই নদীর বাঁধ তৈরি করা হয় । এলাকার মানুষের দুর্ভোগের কথা ভেবে এই বাঁধটি তৈরীতে তাঁকে অনেক বেশি মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে হয় । এছাড়াও অত্র সংগঠনের অর্থায়নে কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁর পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ধলাই নদীর বেশ কয়েকটি বাঁধ পুণঃনির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে উক্ত সংগঠনের অনেক সদস্য তাঁকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। দীর্ঘ একযুগ পরও ধলাই নদীর বাঁধটি টেকশইভাবে টিকে আছে । উক্ত ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে এলাকায় গরীব মানুষদের টিউবওয়েল ও ঘরের টিন দানসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা রাখেন । তাছাড়া জনপ্রতিনিধি না হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক কমলগঞ্জ পাঁচ নং ইউপি ও কমলগঞ্জ পৌরসভার দারিদ্র্যপীড়িত মানুষদের জন্য সরকারী অনুদান আসলে অনেক গরীব মানুষদের অনুদান লাভের সুযোগ করে দেন ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং আশির দশকে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর কমলগঞ্জের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জান, মাল ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
অবাক করার বিষয় হল যে, মোঃ বজলুর রহমান সফাত আলী মাদ্রাসার গভর্নিং বডি ও হাজী মুজিব ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনের দায়িত্বশীল থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক ও শিক্ষামূলক কর্মকান্ডে নিঃস্বার্থভাবে সংশ্লিষ্ট থাকেন ,সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেননি । মোদ্দাকথা, প্রভাবশালী ও সম্মানিত পরিবারের সন্তান হিসেবে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থেকে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষকে সাধ্য অনুযায়ী সহযোগীতা করেন ।
এছাড়াও দানশীল পিতা মরহুম মৌলভী মকবুল আলী কর্তৃক দানকৃত প্রায় সাড়ে আটবিঘা জমিতে কমলগঞ্জ হাই স্কুল, কমলগঞ্জ এর উন্নয়ন ও খেলার মাঠ প্রতিষ্ঠা , প্রায় ষোল বিঘা জমিতে কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমলগঞ্জ, সর্বপ্রথম দানকৃত জমিতে কমলগঞ্জ উপজেলা কমপ্লেক্স,কমলগঞ্জ, পঁচিশ শতাংশ জমিতে কমলগঞ্জ পৌরসভা ভবন,কমলগঞ্জ ও বেশকিছু জমিতে কমলগঞ্জ পৌরসভার অন্তর্গত ‘মকবুল আলী সড়ক’ প্রতিষ্ঠাকালে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হন।
তিনি ছোটবেলায় বড়োচাচা উপমহাদেশের প্রখ্যাত দানশীল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দানবীর মৌলভী আলহাজ্ব কেরামত আলী, প্রাক্তন গর্ভনর মোনায়েম খান, উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম অধ্যক্ষ মাওলানা হরমুজুল্লাহ্ সায়দা (রহ.), ঢাকার প্রাক্তন মেয়র নবাব খাজা খাইর উদ্দিন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু, নবাব আলী আমজদ’র পৌত্র নবাব আলী সফাদার খান রাজা, নবাব আলী খান চুন্নু ও স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলক আসম রবসহ অনেক মহান ব্যক্তিদের স্নেহধন্য হন এবং অনেকের সান্নিধ্য লাভের দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেন । এছাড়াও জ্যোষ্ঠভ্রাতা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য দানবীর মরহুম মুহিবুর রহমান প্রাক্তন সংসদ সদ, ভাষাসৈনিক মরহুম এম. ইলিয়াস, প্রাক্তন মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসীন আলী ও সিলেটের প্রখ্যাত আলেম মরহুম মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলি (রহ.) সহ বিশিষ্টজনদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সচেষ্ট হন।
নিভৃতচারী কর্মবীর মোঃ বজলুর রহমান ২০২০ ইংরেজির ১৭ মে ইন্তেকাল করেন; যিনি জীবনে আপোস করতে শিখেননি । শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের সোনালী দিনগুলো স্ব-আদর্শে অবিচল থেকে অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে প্রৌঢ়কাল অতিবাহিত করেন। নীতি-নৈতিকতা ও স্পষ্টবাদীতার ক্ষেত্রে আপোষহীন ভূমিকার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের রোষানলে পড়তে হয় এবং বারবার মামলায় জর্জরিত হতে হয়। তবুও তিনি স্ব-আদর্শের পক্ষে অটুট ছিলেন । আল্লাহ এই নিভৃতচারী পরোপকারী মানুষটিকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমীন ।
লেখকঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্
মন্তব্য করুন