আলেমসমাজ দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযোদ্ধা
অধ্যক্ষ এহসান বিন মুজাহির॥ সবুজ-শ্যামলে ঘেরা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের এই দেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি থেকে মুক্ত হয় এবং বাংলার হৃৎপিণ্ডে-টকটকে লাল স্বাধীনতার সূর্য উদ্ভাসিত হয়। সবুজ-শ্যামল স্বাধীন দেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেয়েছে হিজল তমাল, তরুলতা আর সবুজ শ্যামলতায় ঘেরা রূপসী বাংলাদেশ। বিশ্বের দরবারে আমাদের আত্মপরিচয় ঘটেছে স্বাধীন জাতি হিসেবে। স্বাধীনতা প্রতিটি জাতির গৌরব ও অহঙ্কারের বিষয়। ছাব্বিশ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় একটি দিবস। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ‘জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের’। পাকিস্তানিরা ছিল জালিম আর এদেশের নিরীহ মানুষ ছিল মজলুম। বিবেকবান কোনো মানুষ কখনও জালিমের পক্ষাবলম্বন করতে পারে না। মজলুমকে সাহায্য করা, তাদের পক্ষে কথা বলা ঈমানি দায়িত্ব। আর সে ঈমানী দায়িত্ব পালনার্থেই আলেমসমাজ এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষকে পাকিস্তানি জালিম শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। দেশের মজলুম জনগণের স্বার্থে স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশপ্রেমিক অনেক আলেম-উলামা, পর মাশায়েখরা জান-মালসহ সর্বশক্তি দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন স্বাধীনতা আন্দোলনে আলেমসমাজের কোনো অবদান নেই। এমনটি মনে করার কোনো অবকাশ নেই। আজাদী আন্দোলন, সিপাহী বিপ্লব, ইংরেজ খেদাও আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ দেশ-জনগণ এবং ইসলামের স্বার্থ সকল প্রকার আন্দোলনে এদেশের আলেমসমাজ রাজপথে সংগ্রাম করেছেন। কাজ করেছেন দেশপ্রেমিক হয়ে। বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেমসমাজের অবদান অনস্বীকার্য।
মাওলানা শাকির হোসেন শিবলি লিখিত ‘একাত্তরের চেপে রাখা ইতিহাস : আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় এদেশের আলেমসমাজ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এবং মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করণে অনেক আলেম কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে আল্লামা হাফেজ্জি হুজুর (রাহ.), আল্লামা লুৎফুর রহমান বরুণী (রাহ.), চরমোনাইর পীর ইসহাক (রাহ), আল্লামা মুফতি নুরুল্লাহ (রাহ.), আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রাহ., আল্লামা এমদাদুল আড়াইহাজারী (রাহ.) শায়খুল হাদিস তজম্মুল আলী (রাহ.), আব্দুল মতিন চৌধুরী শায়খে ফুলবাড়ি (রহ.), মাওলানা হাবিব উল্লাহ (রাহ.), মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী (রাহ.), মাওলানা মোস্তফা আজাদ, শায়খুল হাদিস আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী প্রমুখ।
স্বাধীনতা আন্দোলনে আলেমসমাজ ছিলেন মুক্তিকামী মানুষের সিপাহসালার। বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ও বুজুর্গ মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রাহ.) সে সময় স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন-‘এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা হলো জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা জালেম, এদেশের বাঙালিরা মজলুম। তাই সামর্থ্যের আলোকে সকলকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং এটাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতে হবে’। এ দেশে শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ, ফেদায়ে মিল্লাত আল্লামা হজরত হোসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.) এর বিশিষ্ট খলিফা, আধ্যাত্মিক রাহবার আল্লামা লুৎফর রহমান বর্ণভী ছিলেন একজন দূরদর্শী সিপাহসালার। তিনি তখন পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বিপদগ্রস্ত বাঙালি মানুষদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে একবার তিনি আল্লামা আশরাফ আলী ধরমপুরী (রাহ.) কে বলেছিলেন-‘আমি সূর্যের মতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, কয়েক দিনের মধ্যেই এদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে এবং পাকিস্তানি হানাদারের জুলুমের কবল থেকে এ দেশের জনগণ মুক্তি লাভ করবে’।
আড়াইহাজার থানার কমান্ডার মরহুম শামসুল হকের অধীনে আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রাহ.) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-১৯৭১ সালে যখন আমি লালবাগ মাদরাসার ছাত্র তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধ শুরু হলে আমার মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি হাফেজি হুজুর (রাহ.) কে প্রশ্ন করলাম; হুজুর এ যুদ্ধে আমাদের ভূমিকা বা কর্তব্য কি? তখন হুজুর আমাকে বললেন পাকিস্তানি জালিম হানাদার বাহিনীর জুলুম থেকে এ দেশের মানুষকে রক্ষা করা অবশ্যই তোমার আমার সকলের কর্তব্য। তাই বসে থাকার আর সময় নেই, জালিমদের কবল থেকে মজলুমদের বাঁচানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করো। এ দেশের নিরীহ জনগণকে সহযোগিতা করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। আর সেই সময় হাফেজি হুজুর (রাহ.) বলেছিলেন, ‘হুব্বুল ওয়াতান মিনাল ঈমান’ অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানেরে অঙ্গ। তাঁর এ কথা শুনে আমি বেশ অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন রাজধানীর মালিবাগ জামিয়া শরইয়্যাহ মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রাহ.)। আরজাবাদ মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মোস্তফা আজাদও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর। স্থানীয় যুবক, ছাত্রদের নিয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করতে গ্রামের মাঠে ট্রেনিং দিয়েছেন তিনি। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানাধীন ধলগ্রাম ইউনিয়নের সাধুহাটি গ্রামের মাঠে ট্রেনং সেন্টার খুলেছিলেনমোস্তফা আজাদের পিতা। মুক্তিযুদ্ধে তার যুদ্ধের এলাকা ছিল মেজর অব. জলিলের নেতৃত্বাধীন ৯ নং সেক্টর (বৃহত্তর খুলনা ও বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল)। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে কাজ করেছেন মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদি ও তার ছোট ভাই মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী। সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধ না করলেও স্বাধীনতার স্বপক্ষে অগ্রগণ্য ছিলেন শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব শায়খুল হাদিস আল্লমাা ফরিদ উদ্দিন মাসঊদ। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিসাংবাদিত মুসলিম নেতা বিশ্বের প্রখ্যাত আলেম আওলাদে রাসুল সাইয়্যেদ আসআাদ আল মাদানী (রহ)-এর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। যখন পাকিস্তাানি বাহিনী এ দেশের নিরীহ মানুষের ওপর বর্বোরোচিত হামলা চালালো তাৎক্ষণিক তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানালেন এবং নিরীহ বাঙালিদের পে জোরালো বক্তব্য রাখলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে আলেমসমাজের অবদান দেখে মুক্তিযুদ্ধেও সেক্টর কমান্ডার মেজর আবদুল জলিল হজরত হাফেজ্জি হুজুর (রাহ.) এর হাতে বাইয়াত তথা মুরিদ হয়ে গেলেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা তারেক ওয়াহিদ বাট তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতি মাহমুদ সাহেবের বক্তব্য সব সময় বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ছিল। এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকার মাওলানা আব্দুস সালামের কথায়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি করাচি ইউসুফ বিন্নুরী মাদ্রাসার ছাত্র। একদিন মুফতি মাহমুদ সাহেব মাদ্রাসায় এলে তাঁকে একনেতা শেখ মুজিব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, ‘গাদ্দারকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁকে কি এখনো হত্যা করা হয়নি?’ এ কথা শুনে মুফতী মাহমুদ সাহেব অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘কাকে গাদ্দার বলছো? মুজিব গাদ্দার নয়, তিনি একজন সুন্নী মুসলমান। প্রত্যেক মুসলমানের জানমালের হেফাজত করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। মুফতি মাহমুদ ১৩ মার্চ তাঁর এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহইয়া-ভুট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহবান জানানো প্রেসিডেন্টের অবশ্যই কর্তব্য। পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগঠক হিসেবে এবং এদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহ ও সহযোগিতায় আলেম সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসারী কওমি অনেক আলেমরা মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক
ahsanbinmujahir@gmail.com
মন্তব্য করুন