ইতিহাস নয় আরো আছে, হয়তো নতুন করে লিখতে হতে পারে বাংলা ভাষার ইতিহাস

March 25, 2023,

বিকুল চক্রবর্তী॥ বাংলাভাষার আদি ইতিহাসের কথা বলতে গেলেই উঠে আসে নেপালের সেই রাজকীয় গন্থাগার থেকে প্রাপ্ত পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিস্কৃত একটি পুঁথি যেখানে রয়েছে বাংলাভাষায় রচিত পঞ্চাশটি কবিতা।

যার সাথে ভাটেরা তাম্র শাসনের বেশ কিছু পংত্তি উপর গবেষনা করে বাংলা ভাষার আদি ইতিহাসের নতুন তথ্য তুলে এনেছেন সিলেট বিভাগের সর্বাধিক বই এর লেখক প্রফেসর নৃপেন্দ্র লাল দাশ। তাঁর গবেষনায় উঠে এসেছে চর্যাপদের পাশাপাশি বাংলাভাষার আরো আদি নিদর্শন রয়েছে।

চর্যাপদকে বলা হয় আদি বাংলার নিদর্শন। কিন্তু সস্প্রতি প্রফেসর নৃপেন্দ্র লাল দাশ এর গবেষনায় উঠে আসে এর আগে বা সমকালীণ সময়ে বাংলাভাষার কিছু নির্দশনের কথা। প্রফেসর নৃপেন্দ্র লাল দাশ জানান, মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় ভাটেরায় প্রাপ্ত ভাটেরা তা¤্রশাসন ১ -এ আদিবাংলা ভাষার নির্দশন পাওয়া গেছে। যা চর্যাপদের আগের বা সমকালীণ।

চর্যাপদের ইতিহাস হলো নেপালের রাজকীয় গন্থাগার থেকে পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একটি পুঁথি আবিস্কার করেন। এই পুঁথিতে পঁঞ্চাশটি কবিতা রয়েছে। এর মধ্যে একটি পাতা খন্ডিত ছিল। কাহ্নপা, সবরপাসহ পঞ্চাশজন কবির লেখা এতে সংকলিত ছিলো। এটিই বাংলাভাষার আদি নির্দশন হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।

এ বিষয়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও ইংরেজীতে একটি গবেষনা গ্রন্থ লিখেছেন “মিস্টিক বৌদ্ধিস্ট সাংস”। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর গবেষনা মতে এটি সপ্তম শতাব্দি থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে কোন এক সময় রচিত। কলকাতা বিশ^ বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুকুমার সেন তার গবেষনায় বলেছেন, দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে চর্যাবলী রচনা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান ভাটেরা তাম্র শাসনকে সমীক্ষায় আনা যায়। কেননা এটিতে সপ্তম শতাব্দীর রাজা নবর্গীবানদেব এর কথা উল্লেখ আছে।

মৌলভীবাজারের ভাটেরায় প্রাপ্ত তাম্র শাসনে রাজা নবর্গীবানদেবর উত্তরশুরী গোবিন্দকেশবদেব প্রদত্ত। এই তা¤্র শাসনের ২৯ থেকে ৫৩ পংক্তি স্থানীয় বাংলা ভাষায় রচিত। কোন কোন গবেষক বলেছেন এটা কুকি ভাষা। কেউ কেউ আবার অজ্ঞাতমুল ভাষা বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু প্রফেসার দাশ এতে ব্যাকরণগত, স্থানীয় নদী, ব্যাক্তি, স্থানীয় পরিবেশগত ও ভৌগলিক যে বর্ননা রয়েছে তাতে তিনি স্থির নিশ্চিত, এটা আদি বাংলারই রূপ।

যেমন- বাংলা ব্যাকরণে ষষ্ঠী বিভক্তিতে ‘র’ এর চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। সেখানেও তাই করা হয়েছে। জুড়ি নদীর নাম এই শাসনে আছে যা এখনও বর্তমান। এছাড়াও বর্তমান সিলেট বিভাগকে পুর্বে শ্রীহট্ট বলা হতো। ওই তাম্র শাসনে শ্রীহট্ট কথাটি উল্লেখ রয়েছে ঋকার দিয়ে শৃহট্ট।

 এই বিষয়ে তিনি যে গবেষনা প্রবন্ধ লিখেছেন সেখানে বিস্তারিতভাবে বিষয়গুলোকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে সংগতকারণেই সেইসব ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা করা গেলো না। জিজ্ঞাসু পাঠককে প্রফেসের নৃপেন্দ্র লাল দাশের লেখা “ভাটেরা তাম্র শাসনে আদি বাংলার নির্দশন” বইটি পড়তে অনুরোধ জানাই।

প্রফেসর দাশ জানান, এটি নিয়ে আরো ব্যাপক গবেষনা হলে বাংলাভাষার আদি ইতিহাস নিয়ে আরো চমকপদ তথ্য বের হয়ে আসবে। হয়তো নতুন করে লিখতে হতে পারে বাংলাভাষার ইতিহাস। এই বিষয়টি নিয়ে ভাষাবিশারদদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে। এই তাম্র শাসনটিকে নিয়ে প্রয়োজন আরো গবেষনার।

উল্লেখ্য ১৮৮২ খ্রিষ্ঠাব্দে মৌলভাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরায় তৎকালীণ দক্ষিন শ্রীহট্টের ভাটেরায় এটি পাওয়া যায়। যা বর্তমানে কলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। এই তা¤্রশাসনে তিনটি ভাষায় লিখা এক সংস্কৃত, বাংলা এবং অজ্ঞাতমূল।

এছাড়াও সিলেট বিভাগে আরো তিনটি তা¤্র শাসন আবিস্কৃত হয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে সবগুলোরই গবেষনার। একই সাথে ভাটেরায় আরো একটি তা¤্রশাসন পাওয়া যায় গোবিন্দকেশবদেব এর পুত্র ঈশানদেব প্রদত্ত তাম্র শাসন।

ভাটেরায় প্রাপ্ত এই তা¤্রশাসন প্রথম পাঠোদ্ধার করেন মহারাষ্টীয় পন্ডিত শ্রীনিবাস শাস্ত্রী, দ্বিতীয় পাঠোদ্ধার করেন রাজেন্দ্র লাল মিত্র। এছাড়াও সিলেটের ইতিবৃত্তের প্রণেতা অচ্যুতচরণ চৌধুরী ও কিশোরী মোহন দত্ত। সর্বশেষ ও সর্বজনগ্রাহ্য পাঠ নির্মান করেন এডভোকেট কমলাকান্ত গুপ্ত।

এ ব্যাপারে সাহিত্যজনদের দাবী বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজন গবেষনা কর্মের। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমীর সহকারী পরিচালক (গবেষনা) ড. তপন বাগচী বলেন, এখনো অনেক ইতিহাসই আমাদের অজানা। প্রপেসর নৃপেন্দ্র লাল দাশ একজন বিদগ্ধজন। উনার ব্যক্তিগত গবেষনা গন্থ  “ ভাটেরা তাম্র শাসনে আদি বাংলার নির্দশন” বইটি আমি সংগ্রহ করবো।

প্রপেসর দাশ জানান, আমি আমার জায়গা থেকে বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। এটি নিয়ে যদি সরকার বা সংশ্লিষ্টকেউ গবেষনা করতে চান তাহলে অবশ্যই আমি সহায়তা করবো।

এটি নিয়ে গবেষনা চালিয়ে যাওয়া প্রফেসর দাশ ১৯৪৯ সালে ৬ নভেম্বর শ্রীমঙ্গলের গন্ধর্বপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি এ পর্যন্ত ১১০ বই প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ সব গবেষনাকর্মও রয়েছে প্রফেসর দাশের।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com