ইতেকাফের তাৎপর্য ও বিধিবিধান
এহসান বিন মুজাহির॥ রমজানের রহমত, বরকত ও নাজাত লাভের আশায় মাহে রমজানের মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ রজনী পবিত্র লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির সুনিশ্চিত প্রত্যাশায় সর্বোপরি মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ রাসুলুল্লাহর (সা.) গুর”ত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত আমল। ফরজ ইবাদত ব্যতিত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যেসব ইবাদত করা হয় তার মধ্যে ইতেকাফ একটি অন্যতম ইবাদত। বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার জামে মসজিদে কোনো রোজাদার মুসলিম ইতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে এ ধরণের সুন্নত আদায় হবে। তাই এলাকাবাসীর কেউ যদি ইতেকাফ না করে তাহলে সুন্নত ছেড়ে দেয়ার কারণে সবার সুন্নাত তরফের গোনাহ হবে। ইতেকাফ আরবি ‘আকফ’ মূল ধাতু থেকে গঠিত একটি শব্দ। আকফ শব্দের অর্থ হলো অবস্থান করা। ইতেকাফ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা, অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায় নির্ধারিত সময়ে সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে পার্থিব ও জাগতিক সব ধরনের সংস্পর্শ ত্যাগ করে মসজিদে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। কুরআন কারীমে এরশাদ হয়েছে-‘ওয়ানতুম আকিফুনা ফিল মাসজিদ। আর তোমরা সালাতের নির্দিষ্ট স্থানগুলোয় অবস্থানরত। (সূরা বাকারা : ১৮৭)।
বিশ রমজান সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে উনত্রিশ অথবা ত্রিশ রমজান অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার পূর্ব পর্যন্ত পুরুষদের জন্য মসজিদে এবং নারীদের জন্য নিজ গৃহে নামাজের নির্ধারিত স্থানে নিয়মিত একাধারে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। শরিয়তের পরিভাষায় যেই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতসহকারে নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদে মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়তসহকারে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। ইতেকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ। মহানবী (সা:) স্বয়ং ইতেকাফ করেছেন এবং ইতেকাফ করার জন্য সাহাবাদেরকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মসজিদ মুত্তাকিদের ঘর। যে ব্যক্তি ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করবে আল্লাহ তার প্রতি শান্তি ও রহমত নাজিল করবেন এবং পুলসিরাত পার-পূর্বক বেহেশতে পৌঁছানোর জিম্মাদার হবেন। বিশ রমজান সূর্যাস্তের প্রাক্কাল থেকে মসজিদে ইতেকাফ শুর” করবেন এবং উনত্রিশ বা ত্রিশ রমজান চাঁদ দেখার পরে ইতেকাফকারীগণ মসজিদ থেকে বের হবেন। রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করলে সাতাশ রমজান যদি শবে কদর না-ও হয়, তবু এ দশ দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট শবে কদরের ইবাদত ইতেকাফে আদায় হয়ে যায় এবং এর ফলে কদরের রাতের ফজিলতও লাভ করা যায়।
হজরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত হযরত মুহাম্মদ (স.) রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতেন। (বুখারি)। হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করবে সে দুটি ওমরাহ ও দুটি হজ আদায় করার সওয়াব পাবে’। (বুখারি)। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে ইতেকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। (বায়হাকি)। হজরত আয়েশা (রা.) আরো বলেন, ‘নবী করিম (সা.) রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ পালন করতেন। তার ওফাতের আগ পর্যন্ত তিনি ইতেকাফ পালন করে গেছেন। তারপর তার পতœীরাও তা পালন করেছেন’। (তিরমিজি)। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ইতেকাফকারী নিজেকে পাপথেকে মুক্ত রাখে এবং তার জন্য পুণ্যসমূহ জারি রাখা হয়। (মিশকাত)।
হজরত আলী বিন হোসাইন (রা:) নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেন, মহানবী সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে ১০ দিন ইতেকাফ করে, তা দুই হজ্ব ও দুই ওমরার সমান’ (বায়হাকি)। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা:) বলেছেন, ‘ইতেকাফকারী গোনাহ থেকে বিরত থাকে। তাকে সব নেক কাজের কর্মী বিবেচনা করে বহু সওয়াব দেয়া হবে। (ইবনে মাজাহ)।
ইতেকাফের শর্ত : শর্তগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো। ১. নিয়ত করা। ২. জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে এতেকাফ হতে হবে। ৩. ইতেকাফকারী রোজাদার হবে। ৪. জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান স্ত্রী-পুর”ষের জানাবাত ও মহিলারা হায়েজ-নেফাস হতে পাক হওয়া। ৬. পুর”ষ লোক জামে মসজিদে ইতেকাফ করবে। ৭. সর্বদা হদসে আকবর থেকে পাক-পবিত্র থাকতে হবে।
ইতেকাফ ৩ প্রকার। সুন্নাত ইতিকাফ : রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগ মুহুর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে ইতেকাফ করা। এ ধরনের ইতিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয়। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। ওয়াজিব ইতেকাফ: নজর বা মানতের ইতেকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এত দিন ইতেকাফ করবো অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি এত দিন অবশ্যই ইতেকাফ করবো। যত দিন শর্ত করা হবে ততদিন ইতেকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। সুন্নাত ইতেকাফ ভঙ্গ করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। নফল ইতেকাফ: সাধারণভাবে যেকোনো সময় ইতেকাফ করা নফল। এর কোনো দিন কিংবা সময়ের পরিমাপ নেই। অল্প সময়ের জন্যও ইতেকাফ করা যেতে পারে। এ জন্য মসজিদে প্রবেশের আগে ইতেকাফের নিয়ত করে প্রবেশ করা ভালো।
ওয়াজিব ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। জাহের রেওয়ায়েত মতে, নফল ইতেকাফকারীর জন্য রোজা শর্ত নয়। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, নফল ইতেকাফকারীর জন্যও রোজা রাখা শর্ত। যদি কেউ রোজা ব্যতিত এক মাস ইতেকাফ মান্নত করে, তার প্রতি রোজা ব্যতিত এক মাস এতেকাফ ওয়াজিব হবে। যদি কেউ রমজান মাসে এতেকাফের মান্নত করে তাহলে ভিন্নভাবে রোজা রাখার প্রয়োজন নেই। কিন্তু রমজান মাসে মান্নত আদায় না করলে পরবর্তী সময়ে রোজার সঙ্গে ঐ ইতেকাফ আদায় করতে হবে। স্ত্রী অথবা ক্রীতদাস-দাসী এতেকাফের মান্নত করলে স্বামী অথবা মনিব তা নিষেধ করার ক্ষমতা রাখেন। রমজানের শেষ দশ দিনের এই ইতেকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। অর্থাৎ কোনো বস্তি বা মহল্লার একজনকে হলেও এই ইতেকাফ অবশ্যই করতে হবে। যদি অন্তত কোনো এক ব্যক্তি এই ইতেকাফ করে নেন, তাহলে সারা মহল্লবাসীর পক্ষ থেকে ইতেকাফ আদায় হবে; কিন্তু মহল্লাবাসীর মধ্যে থেকে কেউ যদি ইতেকাফ আদায় না করেন, তবে এই দায়িত্বের প্রতি অবহেলার কারণে মহল্লাবাসী গোনাহগার হবেন। এ স্মরণ রাখতে হবে, উজরত অর্থাৎ বিনিময় বা পারিশ্রমিক দিয়ে কাউকে ইতেকাফে বসানো জায়েজ নয়। কেননা ইবাদতের উজরত দেয়া ও নেয়া উভয়ই শরিয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ। (ফাতওয়ায়ে শামী)।
নারীরা ঘরের যে স্থান ইতেকাফের জন্য নির্দিষ্ট করবেন, সে স্থানটি ইতেকাফকালীন তার জন্য মসজিদের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে। ইসলামী শরিয়তের কোনো প্রয়োজন ছাড়া সেখান থেকে সরে যাওয়া জায়েজ হবে না। সে স্থানটির নির্দিষ্ট সীমার বাইরে, ঘরের অন্য অংশেও যেতে পারবেন না। নির্দিষ্ট সীমার বাইরে চলে গেলে ইতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। ইতেকাফে নবী করিম (সা.)-এর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি প্রতি বছর রমজান মাসের ইতেকাফের প্রতি অত্যন্ত গুর”ত্বারোপ করতেন। তিনি কখনও পুরো রমজান মাস ইতেকাফ করেছেন। দশ দিনের ইতেকাফ তো তিনি প্রতি বছর অবশ্যই করতেন। একবার বিশেষ কারণে রমজান শরীফে ইতেকাফ করতে পারেননি, তাই শাওয়াল মাসে দশ দিন রোজা রেখে তিনি ইতেকাফ করেছেন (বুখারি)।
ইতেকাফকালীন অবস্থায় বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করার পাশাপাশি নফল নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার, দোয়া-দরূদ, দান-সদকা ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত। ইতেকাফকারীদের জন্য এগুলো করণীয় কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ ও অনর্থক গল্প-গুজব বা বেহুদা কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। দুনিয়াবী কোনো লেনদেন না করার পাশপাশি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া অনুচিত। ইতেকাফকারীদের জন্য এগুলো বর্জনীয়।
মন্তব্য করুন