ইফতার-সাহরির দোয়া ও রোজার জরুরি কিছু মাসায়িল

May 2, 2020,

এহসান বিন মুজাহির॥ পবিত্র মাহে রমজানের প্রথম দশক রহমতের অষ্টম দিন আজ। দেশের ধর্মপ্রাাণ মুসলমানগণ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে রোজা আদায় করছেন। কিন্তু কি কারণে রোজার পবিত্রতা নষ্ট হয়, কি কারণে রোজা ভঙ্গ হয় এবং কি কারণে ভঙ্গ হয় না, তা অনেকের কাছে অজানা। এ নিবন্ধে ইফতার, সাহরির দোয়াসহ রোজা সংশ্লিষ্ট জরুরি কিছু মাসায়ালা নিয়ে আলোকপাত করা হলো।

রোজার সংজ্ঞা : সুবহে ছাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইবাদতের নিয়তে যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী সহবাস হতে বিরত থাকার নামই রোজা। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক, জ্ঞান সম্পন্ন মুসলমান নর-নারীর উপর রমজানের রোজা ফরজ। মহিলাদের ঋতুস্রাব (মাসিক) ও নেফাস গ্রস্থ থাকাকালীন সময়ে মহিলাদের জন্য রোজা রাখা ফরজ নয়। তবে পরবর্তী সময়ে রোজার কাযা আদায় করতে হবে।

রমজানের রোজার জন্য পৃথকভাবে নিয়ত করা জরুরি। সাহরি খাওয়ার পর রোজা নিয়ত করা জরুরি। নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়। কেবল মনের ইচ্ছা তথা রোজা রাখার সংকল্প করাকেই নিয়ত বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ অন্তরে নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে। তবে মুখে নিয়ত করা উত্তম।

রোজার নিয়ত :  নাওয়াইতু আন আছুম্মা গাদাম মিন শাহরি রমাজানাল মুবারাকি ফারদাল্লাকা, ইয়া আল্লাহু ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আনতাস সামিউল আলিম। অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ (নিয়ত) করলাম। অতএব, তুমি আমার পক্ষ থেকে (আমার রোজা তথা পানাহার থেকে বিরত থাকাকে) কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।

ইফতার : সূর্য অস্তমিত হয়ে যাওয়ার পর ইফতার করা উত্তম। অনেকে ইফতারের সময় হওয়ার পরেও ইফতার করতে বিলম্ব করে। সময় হওয়ার পর বিলম্ব করে ইফতার করা মাকরুহ। আবার অনেকেই ইফতার না করে আগে নামাজ পড়ে তার পর ইফতার করেন এটাও মাকরুহ্, বরং আগে ইফতার তার পরে নামাজ পড়া উত্তম। সম্ভব হলে খেজুর বা মিষ্টি জজাতীয় দ্রব্য দ্বারা ইফতার করা।

ইফতারের দোয়া : আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন। অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিজিকের মাধ্যমে ইফতার করছি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন : ‘জাহাবাজ জামাউ; ওয়াবতালাতিল উ’রুকু; ওয়া ছাবাতাল আঝরূ ইনশাআল্লাহ। অর্থ :(ইফতারের মাধ্যমে) পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপসিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান সাওয়াবও স্থির হলো।

সাহরি : সাহরি খাওয়া সুন্নাত। হজরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমাদের রোজা এবং আহলে কিতাব তথা ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। (অর্থাৎ মুসলিমরা সাহরি খায় আর ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানরা সাহরি খায় না)। অনেকেই অলসতা করে সাহরি না খেযে রোজা রেখে ফেলে, এটা ঠিক নয়। সাহরি খাওয়ার মধ্যে অনেক বরকত ও সওয়াব রয়েছে। রাতের শেষ ভাগে সাহরি খাওয়া উত্তম, তবে এর আগে খেয়ে নিলে কোন অসুবিধা নেই।

সাহরির দোয়া : নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিন শাহরি রামাদানাল মুবারাকি, ফারদ্বাল্লাকা ইয়া আল্লাহ ফাতাকাব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলিম।

তারাবি : রমজান মাসে তারাবির নামাজ বিশ রাকাত পড়া প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নতে মুআক্কাদা। অনেকে রোজা রাখেন ঠিক কিন্তু তারাবির নামাজ পড়তে অলসতা করেন। পুরষদের জন্য মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে তারাবির নামাজ পড় ওয়াজিব। কিন্তু এই রমজানে করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় আলেমসমাজ এবং সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘরেই আদায় করুন। সম্ভব হলে পরিবারের সবাইকে সাথে নিয়ে ঘরেই জামাতে নামাজ আদায় করুন।

যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয়না : ১। শিঙ্গা লাগান ২। বমি হওয়া ৩। স্বপ্নদোষ হওয়া। ৪। চোখ বা কানের ড্রপ দেয়া। ৫। ইনহেলার বা অক্সিজেন গ্রহণ। ৬। মিসওয়াক, টুথব্রাশ বা পেস্ট ব্যবহার অথবা দাঁত ফিলিং করা। তবে এক্ষেত্রে কোনো কিছু গিলে ফেলা পরিহার করতে হবে।

৭। দেহের কোনো অংশে ক্যাথেটার কিংবা ক্যামেরা প্রবেশ করানো যদিওবা তা মুখ দিয়েও হয়। কেননা তা পানাহার কিংবা এর বিকল্প কিছু নয়। ৮। ক্রিম, তেল, মেকআপ, লিপস্টিক, ঠোঁট আর্দ্রকারী দ্রব্য, সুগন্ধি ব্যবহার। ৯। মুখের লালা কিংবা সর্দি গিলে ফেলা। ১০। কিছু হৃদরোগের ওষুধ/স্প্রে আছে যা জিহবার নিচে রাখা হয়, এ ধরনের ওষুধের কোনো অংশ গিলে না ফেললে তা মুখে রাখা সাওম ভঙ্গকারী নয়। ১১। রক্ত পরীক্ষা করা। ১২। অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হওয়া।

যেসব কারণে রোজা ভেঙ্গে যাবে : ১) রোজা রেখে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাস করা। ২) কোন ধরনের খাবার গ্রহন করা। ৩) উত্তেজনার সাথে বীর্যপাত করা।  ৪) খাদ্যের অন্তর্ভূক্ত এমন কিছু গ্রহন করা। যেমন সেলাইন ইত্যাদি। ৫) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা। ৬) শিঙ্গা লাগিয়ে রক্ত বের করা। ৭) হায়েজ বা নেফাছের রক্ত প্রবাহিত হওয়া। ৮) ইচ্ছকৃত মুখ ভরে ভমি করা। ৯) সহবাস ছাড়া অন্য কোন পন্থায় বির্যপাত ঘটানো। ১০) ধুমপান করা রাত আছে মনে করে সুবহে ছাদিকের পর পানাহার করা। ১১) ভুলবশত পানাহার করে রোজা ভেঙ্গে গেছে মনে করে ইচ্ছা করে পানাহার করা।

যে সকল কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না : মিসওয়াক করা। চোখে সুরমা লাগানো।  স্বপ্নদোষ হওয়া। দাত হতে রক্ত বাহির হওয়া। জুনবী তথা নাপাক অবস্থায় সাহরি খাওযা। চোখে ওষুধ লাগানো। ভুলবশত পানাহার করা। অনিচ্ছাকৃতভারেব অল্প ভমি হওয়া।

যেসব  কারণে রোজা মাকরুহ হয় : মুখে থুথু জমা করে গিলে ফেলা। টুথপেস্ট দিযে দাত ব্রাশ করা। কয়লা মাজন দ্রব্য দিয়ে দাত মাজা। নাপাক অবস্থায় গোসল ছাড়া সারাদিন থাকা। স্ত্রীর সাথে হাসি টাট্টা করা যাতে সহবাস বা বির্যনির্গত হওয়ার আশঙ্কা হয়। রোজা রাখা অবস্থায় গোনাহের কাজ করা। অযথা কোন জিনিস চিবানো। গিবত করা। চুগলখোরী করা। অশ্লীল কথাবার্তা বলা। সিঙ্গা লাগানো।

যেসব কারণে কাযা ও কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব : রোজা রাখা স্মরণ অবস্থায় কোন পানাহার বা স্ত্রী সাথে সহবাস করা। তা হলে এমতাবস্থায় কাযা ও কাফফারা উভয়টি ওয়জিব।

কোন ব্যক্তি সফরে থাকলে (মুসাফির) পরবর্তী সময় রোজা কাজা করে দিবেন। সফরকালীন সময় রোজা রাখা তার জন্য বাধ্যতামুলক নয়। (বাকার:১৮৫) ।

দিনের বেলায় কোন কাফের যদি ইসলাম গ্রহণ করেন কোন বালক-বালিকা যদি প্রাপ্ত বয়স্ক হন এবং কোন পাগল যদি ভালো হয়ে যায় তাহালে তারা রোজার হুকুমের আওতায় এসে যাবেন এবং সুর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে পূবের রোজাগুলোর কাজা করা তাদের জন্য বাধ্যতামুলক নয়। যেহেতু আগেরগুলোতে তাদের উপর রোজা ওয়াজিব ছিল না।

এতেকাফ : রমজানের শেষ দশকে মহল্লার জামে মসজিদে এতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। যে ব্যক্তি এখলাছের সাথে এতেকাফ করবে তার পরছনের সমস্ত গোনাহ আল্লাহ মাফ করে দিবেন। এতেকাফরত অবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। প্রয়োজনে প্রশ্রাব পায়খানা, জানাবতের গোসল ও জরুরত পরিমাণ বের হতে পারবেন।

তথ্য সুত্র : (দুররে মুখতার ৩য় খণ্ড- ৩৯৪ পৃষ্ঠা,  ফাতওয়ায়ে আলমগিরী ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২০৩, কানযুল উম্মাল, ৮ম খন্ড, পুষ্ঠা ২৩০, ফতোয়ায়ে শামি : তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা. ৩৪৫),  তিরমিজি ২য় খণ্ড। পৃষ্ঠা ১৭৩।

মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিকভাবে রোজা রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক :  মুহতামিম, সাইটুলা ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদরাসা, সাইটুলা, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com