ইসলামে মাতৃভাষার মর্যাদা ও অমর একুশে
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা শব্দগুলো সব মানুষের কাছে অত্যন্ত আবেগের ও সম্মাণের। মানুষকে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন ও কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন। মাতৃভাষা যে কোন মানুষের আবেগ প্রকাশের মাধ্যম। পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ হাজার ভাষা রয়েছে। সুরা আর রহমানের এক থেকে চার নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন। পরম করুণাময় আল্লাহ ্ তা’আলা মানুষকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, (ভাব প্রকাশের জন্য) তিনি তাকে (কথা) শিখিয়েছেন।
সুরা ইব্রাহিমের চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে আমি কোনো নবীই এমন পাঠাইনি, যে নবী তার জাতির মাতৃভাষায় আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছায়নি।
পবিত্র কোরআনের সুরা রোম এ মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন আকাশমন্ডল ও যমীনের সৃষ্টি, তোমাদের পারস্পরিক ভাষা ও বর্ণ বৈচিত্র্য(নি:সন্দেহে) তাঁর (কুদরতের) নিদর্শনের অন্তর্ভূক্ত (এক একটি বড় নিদর্শন) অবশ্যই জ্ঞানবান মানুষদের জন্যে এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে।
পবিত্র কোরআনের সুরা দু’খানের ৫৮ নম্বর হায়াতে হযরত মুহাম্মদ(স:) কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা’আলা বলেন আমি কোরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে নাযিল করেছি যাতে তারা সহজে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। পবিত্র কোরআনের সুরা আশু-শুরার ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি যাতে আপনি মক্কা ও আশেপাশের লোকদের হাশরের দিন সম্পর্কে সতর্ক করেন। পবিত্র কোরআনে ভাষা সম্পর্কে আরও অনেক আয়াত রয়েছে। মাতৃভাষার এত গুরুত্ব থাকার পরও বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দিতে হয়েছে অনেক মানুষের। এখনও বাংলাদেশে মাতৃভাষার সঠিক ব্যবহারে আমরা যতœবান নই। এ ব্যাপারে আমাদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। মাতৃভাষার সম্মাণ রক্ষার জন্য আত্মত্যাগের মহিমা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এই আত্মত্যাগের কারনেই একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
ইংরেজীর দাপটে অনেক বিদ্যালয়ে বাংলা অসহায় হয়ে পড়েছে। ইংরেজী ও অন্যান্য ভাষা অবশ্যই শিখতে হবে বরং যত বেশি শিখা যাবে ততই বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় হবে। তাই বলে মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। দেশের ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল ও কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দেশের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ভালভাবে শিক্ষা দিতে হবে। ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলার কথা বলে না, বলে সবার মাতৃভাষার কথা। আমাদের দেশে উচ্চ আদালতের রায় বা আদেশ বাংলা ভাষায় দেয়া হয় না। সে কারনে সাধারণ বিচার প্রার্থীরা রায় বা আদেশ সহজে বুঝতে পারেন না। উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলন করতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। বিচার প্রার্থী জনগণ নিজের ভাষায় রায় বা আদেশ পাওয়া তাদের অধিকার। “একুশ মানে মাথানত না করা” একুশ আমাদের অন্যায়-অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখায়।
আমরা ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাষার আবেগে উদ্বেলিত হয়ে পড়ি। মাসব্যাপি চলে বাংলা ভাষা নিয়ে অনেক আয়োজন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষা নিয়ে যে কাজ করা দরকার সত্যিকারভাবে তা বাস্তবায়ন হয় না। একুশের প্রধান দাবীই ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সর্বস্তরে বাংলা চালু চাই। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া চাই। একুশ শুধুমাত্র সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের চেতনাই নয়, একটি মানবিক সমাজ গঠনের চেতনাও একুশে ফেব্রুয়ারি। পৃথিবীর হাজার হাজার ভাষার মধ্যে আমাদের বাংলা ভাষার স্থান ষষ্ঠ। বিশ্বের সকল জাতিসত্ত্বার ভাষার মধ্যে বাংলাদেশী হিসেবে আমরা অনন্য গৌরবের অধিকারী। এই গৌরব ও সম্মান একদিনে অর্জিত হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রাম রয়েছে এর পেছনে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে নাগরিক সংবর্ধনা সমাবেশে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঘোষণা দেন ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এ বক্তব্যই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আন্দোলনকারীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলে। এরপর ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। ২৭ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় পল্টনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বলেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে ঊর্দু। তার এ বক্তব্যই রক্তঝরা বায়ান্নর সূত্রপাত। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার মান রাখতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছিল বাঙালী জাতি। বুকের রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা। সেই থেকে বাংলা ভাষার জন্য আমাদের অন্য রকম একটি আবেগ কাজ করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে যখন বাঙালী জাতি পথে নামে তখন তৎকালীন শাসকগোষ্ঠি এ বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবি নিয়ে যারা পথে নেমেছিল তাদের উপর গুলি বর্ষণ করেছিল। শহীদ হয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ অনেক নাম না জানা মানুষ। বুকের রক্ত দিয়ে জাতি ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাই ভাষা নিয়ে বাঙালীর আবেগ বরাবরই অন্যরকম। ফেব্রুয়ারি আমাদের সাংস্কৃতি চেতনার মাস। ফেব্রুয়ারি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যুগিয়েছে। ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা যোগানোর মাস। একুশ আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করতে শেখায়। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এখনো জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলার প্রচলন নিশ্চিত হয়নি। একুশ শুধুমাত্র একটি দিন নয়। একুশ আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মাইল ফলক হয়ে থাকবে চিরকাল। ভাষার মাস আমাদের চেতনায় অমূল্য সম্পদ। এভাবে পৃথিবীর কোনো দেশে একটি মাস বা দিন চিহ্নিত নেই। প্রকৃতপক্ষে একুশের শিক্ষা হচ্ছে আধুনিকতার শিক্ষা। আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, কবিতা একুশের মধ্য দিয়েই আধুনিক হয়ে ওঠে। একুশ আমাদের গৌরবের ইতিহাস। অমর একুশে উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বই মেলা আয়োজিত হয়ে থাকে এ মাসে। বই পড়া ছাড়া শিক্ষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চার অন্য কোন উপায় নেই। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে ভাল বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। একটা চূড়ান্ত অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে চলছি আমরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বই মেলা ও বই পড়া বাড়াতে হবে। একুশের বই মেলা আমাদের সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠুক। ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। মহান আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের মাতৃভাষার চর্চাসহ বিভিন্ন ভাষার প্রতি মর্যাদা ও শিক্ষার তৌফিক দান করুন।
মন্তব্য করুন