ইসলাম: যুগ থেকে যুগান্তরে গ্রন্থকার ও গীতিকার বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মোঃ আকবর হোসেন এর সময়োপযোগী প্রাসঙ্গিক মেহনতি ও নান্দনিক প্রকাশনা: শুভকামনা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ এ বিশ্ব ভ্রম্মান্ডের স্রষ্টা- একক মালিক আমাদের রাব্বুল আল-আমিন মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলাম। ইসলামী আইনের প্রথম ও প্রধান উৎস কালামে পাক কালামুল্লাহ আল কোরআনে মহান আল্লাহ মানব জাতির প্রতি প্রথম যে বাণীটি জিবরাইল (আ.) মারফত রাসুলে খোদা হাবিব আল্লাহ মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর নিকট প্রেরণ করেছিলেন তা ছিল ‘ইকরা’ পড়। পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, “ইকরা বিছমি রাব্বুকাল্লাজি খালাক, খালাকালইনসানা মিন আলাক্ক”। ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস হাদিসে রাসুল (দ.) এও শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কোরআন হাদিসের ভাষা আরবি। বাংলাভাষী মুসলমানগণকে কোরআন হাদিস জানতে ও বুঝতে হলে মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে সঙ্গে আরবি ভাষা শেখা ও চর্চা করা, আরবি গ্রন্থসমূহের বঙ্গানুবাদ জনস্বার্থ ও ধর্মীয় প্রয়োজনেই প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। কথিত ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানে পঁচিশ বছর কোরআন হাদিস আরবী ভাষায় প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা, চর্চা ও প্রচলন ছিল না। পাকিস্তানে ইসলাম ও মুসলমানদের নামে রাজনৈতিক দল থাকলেও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ধর্ম শিক্ষা ও ধর্মালোচনার চাইতে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও ফায়দা লুটার পাঁয়তারাই প্রাধান্য পেত। পাকিস্তানী জাতির বর্ণিত পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু করার ঘোষণা দিয়ে শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তানের শৈশবকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে ও টালমাটাল করে তুলেছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাউত্তর কালে জাতীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামী ফাউন্ডেশন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থসমূহ সহজ সরল ও বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশ করে ধর্মীয় পুস্তক পাঠ, জ্ঞানার্জন ও পঠন-পাঠনের নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেন। এক সময় প্রচলিত রেওয়াজ ছিল আলেম-ওলামা, ধর্মগুরু ও ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণ ধর্মীয় পুস্তক প্রণয়ন করবেন। কবি ও শিক্ষাবিদ শ্রদ্ধেয় গোলাম মোস্তফা মহানবী ও মহামানব মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.) এর কর্ম ও জীবনদর্শন সংক্রান্ত বিশাল গবেষণা গ্রন্থ বিশ্বনবী প্রকাশ করে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ভুবনে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। মৌলানা নয়, কবি গোলাম মুস্তফার বিশ্বনবী দারুণ পাঠকপ্রিয়তা পায়। দর্শনীয় সাইজ, আকর্ষণীয় বোর্ড-বাঁধাই, ঝকঝকে ছাপা ও সাদা কাগজে মূল্যবান গ্রন্থখানি আমাদের নবী বিষয়ক একটি ক্লাসিক গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে।
গ্রন্থকার মো. আকবর হোসেন সত্তর দশকের লেখক, সংগঠক, কবি ও গীতিকার। ইসলাম ধর্ম, মক্কা-মদীনা ও মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফা (স.) বিষয়ক এটি তাঁর প্রথম গ্রন্থ। এমন কঠিন ও জটিল বিষয়ে লেখালেখি ও পুস্তক প্রকাশ সম্ভব হয়েছে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, নবীর প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা, তাঁর পিতা-মাতার দোয়া ও দায়িত্বের প্রতি সচেতনতা এবং কর্তব্যনিষ্ঠার কারণে। নিজ ধর্ম ইসলামের প্রতি তাঁর অনুরাগ, ধর্ম-কর্ম এবাদত বন্দেগি এবং সর্বোপরি সামাজিক ও পারিবারিক পরিবেশ তাকে এমন ছওয়াবী মহৎ কর্ম সম্পাদনে সহায়তা দিয়েছে। নিজে এবং পারিবারিক ভাবে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত আকবর হোসেন সমাজসেবক, সাংস্কৃতিক সংগঠক মুক্ত মনের মুক্ত মানুষ উদার মানুষ হলেও তথাকথিত প্রগতিশীলদের মত প্রকৃতিবাদী নহেন, একজন একেশ্বরবাদী বটে। অভিবক্ত ব্রিটিশ ভারতে তাঁর মরহুম পিতা মৌলভী আব্দুর রহমান আসামের ডিগবয়ে ব্রিটিশ কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে আসাম বাংলার আলেমে দ্বীনদের সংস্পর্শ ও সাহচর্য লাভ করেন। বৃহত্তর সিলেটের দুইজন মরহুম আলেমে দ্বীন মৌলানা আব্দুল লতিফ ফুলতলি এবং মৌলানা লুৎফুর রহমান বরুনীর সাথে গ্রন্থকারের পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে ধর্মীয় বিষয়ে অল্প বয়সেই অধিকতর উৎসাহিত অনুপ্রাণিত উপকৃত হয়েছেন প্রভাবিত হয়েছেন। এই দুই আলেমে দ্বীন আজীবন ইসলাম প্রচারে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন।
জাজিয়াতুল আরব একটি প্রাচীন জনপদ। আবহাওয়া ও জলবায়ুজনিত কারণে এখানকার মানবজীবন খুবই কঠিন জটিল সংঘাতময়। অত্যধিক তাপমাত্রা, দানাপানির অভাব, চাষাবাদযোগ্য প্রয়োজনীয় ভূমি না থাকায় আরবীয়গণ জন্ম ও দর্শনগতভাবে যাযাবর বেদুঈন। ঘরমুখী নিরীহ বাঙালির উপর কিঞ্চিত ক্ষোভ ও উপমা প্রকাশ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরব বেদুঈনদের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করে লিখেছিলেন,
“ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।”
জাজিরাতুল আরব প্রি-ইসলামকি এ্যারাবিয়াকে আরবের ইতিহাসে ‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’ ডার্ক এইজ অন্ধকারের যুগ হিসেবে আখ্যায়িত। আরবের সেই ঘোর অন্ধকারের যুগে আলোর দিশারী মানবতার মুক্তিদূত হিসেবে মরু ভাস্কর হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.) এর এই ধরাধামে তশরিফ আনয়ন। আল্লাহ মনোনীত ধর্ম ইসলাম। তাঁর কালামে পাক আল কুরআন এবং আল্লাহ প্রেরিত রাসুল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.) আরবের অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে ইসলামী হিকমত কুরানিক কানুন কায়েম করেন। পবিত্র আল কোরআনে সুরা আল আহযাব এর আয়াত চল্লিশে আল্লাহ বলেন, “হে মানুষ তোমরা মনে রেখো মুহাম্মদ (দ.) তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন বরং তিনি হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত রসুল (স.) এবং নবীদের সিলমোহর (শেষ নবী)। আল্লাহ তায়ালা সর্ব বিষয়ে অবগত আছেন।”
আলিম উলামা পণ্ডিত দার্শনিক ইসলামী চিন্তাবিদ ছাড়া এমন বিষয়ের উপর গ্রন্থ প্রকাশ সহজ ব্যাপার নয়। এমন দৈন্যতা আমাদের জাতীয় জীবনেই প্রতিফলিত। বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প বইমেলাকেন্দ্রিক। একুশের বইমেলাই জাতির প্রাণের মেলা মিলনমেলা হিসেবে খ্যাত স্বীকৃত। গেল বছর একুশের বইমেলায় মোট চার হাজার আট শত চৌত্রিশখানা বই বেরুলেও মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র এগারোশত একান্নখানি। সবচাইতে দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার গেল মেলায় ধর্মীয় বই বেরিয়েছে মাত্র পঁচিশখানি অথচ ষোলো কোটি মানুষের এই দেশে ইসলাম ধর্মলম্বী মানুষের সংখ্যা শতকরা নব্বই শতাংশের উপরে। এ দেশের রাষ্ট্রধর্মও ইসলাম। এ দেশে ঘোষিত নাস্তিকের সংখ্যা শতকরা একজনও নয়। বিশ্বায়ন ও ডিজিটালাইজেশনের এ যুগে মেলায় প্রকাশিত কম্পিউটার বিষয়ক গ্রন্থ ছিল মাত্র পাঁচখানি। অনুবাদ আটত্রিশ এবং অভিধান ছিল মাত্র দু খানি।
জাতীয় পর্যায়েই প্রকাশনা শিল্পের দৈন্যদশার মাঝে বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা ও মফস্বল থেকে ইসলাম ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ দুঃসাহসিকতার পরিচায়কই বটে। সুশিক্ষিত, সুবেশি, সাফ-গোরিয়ানা উজ্জ্বল ফরসা চেহারার গ্রন্থকার আকবর হোসেন একজন আধুনিক চিন্তা চেতনার মানুষ। ইতোপূর্বে তাঁর একখানি গ্রন্থ ‘অনুভবে’ ভুমিকা ও লেখক পরিচিতি লেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেখানে সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং গীতিকার আকবর হোসেন ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক চিন্তাচেতনার অত্যাধুনিক লেখক। ষাটের কোঠা পেরুতে না পেরুতেই তাঁর চিন্তা চেতনা পোশাক-আসাকে এসেছে আমূল পরিবর্তন। সাফ গোরিয়ানা চেহারায় সফেদ সাদা একমুখ চাপ দাড়িই তো তাঁকে মানিয়েছে দারুণ। বাল্য কৈশোর কাল থেকে ধর্মকর্মের প্রতি অনুরাগী ছিলেন শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ধর্মপ্রাণ আকবর হোসেন। পিতা-মাতা আলেম ওলামার দোয়া এবং মক্কা মদিনার মাটি আলো হাওয়া তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে এমন ছওয়াবি কাজে আনজাম দিতে।
গ্রন্থকার আকবর হোসেন আল্লাহ্ ও রাসুল বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থ ‘ইসলাম: যুগ থেকে যুগান্তরে’ আমার বাসায় নিয়ে এলো, গ্রন্থকার উপহার পাঠালেন তাঁর প্রিয় পুত্র আমিনুর রহমান সোহাগকে দিয়ে। গ্রন্থকার আকবর হোসেন নিজ বাড়ি বাহারমর্দানে সেলফ্ কোয়ারিন্টিনে আছেন। শহরে না এলেও মোবাইল মারফত আমার খুঁজ খবর নেন।
পিতা-মাতার মত উজ্জ্বল ফরসা চেহারার এই সেদিনের ছোট্ট সোহাগ বেশ লম্বা হয়েছে পিতার মতো। এই সেদিনও আমি তাকে কাঁখে না নিলেও নিয়মিত কোলে তুলেছিÑ চকলেট উপহার দিয়েছি। সম্পর্কে সে আমার মামাতো ভাই। আমি তার বড় ভাই। একজন কলম সৈনিক ও গ্রন্থকার ছাড়াও আমি একজন পরশ্রিমী পাঠক। হাল আমলে আমার উপর আরেকটি দায়িত্ব বর্তিয়েছে বুক রিভিউ। এতে একটি স্বতন্ত্র স্বাদ ও মজা আছে। কারণ রিভিউর উছিলায় সংশ্লিষ্ট গ্রন্থখানিকে প্রাণপণে আদ্যোপান্ত পাঠ করতে হয়। আত্মস্থ ও হজম করতে হয়। গ্রন্থকারের জীবনদর্শন গ্রন্থের মূল মেসেজ-বাণী বুঝতে হয়। গ্রন্থকার আকবর হোসেন এর ‘ইসলাম: যুগ থেকে যুগান্তরে’ আল্লাহ রসুল এবং আল কোরআন বিষয়ক গ্রন্থ বিধায় আমি হালকা মেজাজে হালকা ভাবে নিতে পারলাম না এবং না পারাটাই স্বাভাবিক কারণ বিষয়টি ধর্মীয় গ্রন্থখানি ধর্মবিষয়ক। এ ব্যাপারে অভিমত শিরোনামে গ্রন্থখানির ভুমিকা লিখে প্রাসঙ্গিক ও মূলবান অভিমত দিয়েছেন স্থানীয় টাউন কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল জেলা জামে মসজিদের খতিব মৌলানা শামসুল ইসলাম মুফতি সাহেব। ইসলামী চিন্তাবিদ এবং জাতীয় পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পুরস্কৃত শ্রেষ্ঠ ইমাম এই অধ্যক্ষ মহোদয় যথার্থই বলেছেন তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধের শিরোনামে একএকটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করা যায় কিন্তু লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিশাল আলোচনাকে স্বল্প পরিসরে উত্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই গ্রন্থে ‘জাজিরাতুল আরব’ থেকে ‘মাযহাব ও ইমামগণ’ শিরোনামে তোরোটি মূল্যবান প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। সবশেষে গ্রন্থের শেষ পর্যায়ে রয়েছে ইসলামের ইতিহাসের জানা-অজানা অনেক কথা ও কাহিনী। গ্রন্থের প্রথম প্রকাশ গেল মাস জুলাই/২০২০ খ্রিষ্টাব্দ। অংকন প্রকাশনী থেকে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন মহিদুর রহমান। তাঁর নিবেদনেও তিনি কিছু প্রাসঙ্গিক কথা উল্লেখ করেছেন। মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক আস্থিরতা ও অশান্তি, রূচির নিদারুণ দুর্ভিক্ষ এবং বৈশ্বিক মরণব্যাধি করোনা মহামারির মাঝেও বাণিজ্যিক মনোভাব এবং প্রাপ্তিযোগের প্রত্যাশা না করে এই দুঃসময়ে একখানা ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশ করার জন্য সহৃদয় প্রকাশক মহোদয় আন্তরিক ধন্যবাদ মোবারকবাদ পাবার হকদার। আমি সবিনয়ে তা-ই জানাই। গ্রন্থখানির সার্বিক সহযোগিতায় আছেন আব্দুল হাই, আব্দুল হান্নান এবং আলহাজ্ব ছাবিরিন আনোয়ারা। অলঙ্করণ আফজাল হোসেন। প্রচ্ছদে তাহেরা বিনতে আকবর লিনা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ধর্মগ্রন্থের প্রচ্ছদ ও রঙ এর ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, কারণ গ্রন্থখানি ধর্ম বিষয়ক। মসজিদে নববির গুম্বুজের রঙ সবুজ বাংলার শ্যামল প্রান্তরের রঙ সবুজ এবং বাংলাদেশের পতাকার রঙ লাল সবুজ। সবুজের আলোকে সবুজাভ প্রচ্ছদ বোর্ড বাঁধাই গ্রন্থখানিকে আকর্ষণীয় ও রুচিশীল করে তুলেছে। বাপকা বেটি বিনতে আকবর অবশ্যই ধন্যবাদ মোবারকবাদ পাবার হকদার। সাদা অফসেট কাগজের একশত চার পৃষ্ঠার গ্রন্থখানি উৎসর্গ করা হয়েছে গ্রন্থকারের অকালপ্রয়াত অগ্রজ কবি কলামিস্ট ও সাংবাদিক আমার প্রিয় বন্ধু আহমেদুর রহমানকে। ষাটের দশকের শুরুতে আমরা এমসি কলেজে সহপাঠি, সতীর্থ বন্ধু ছিলাম। আমৃত্যু সে সুসম্পর্ক বহাল ছিল। সে সময় সুদর্শন ইংরেজি বিষয়ের অধ্যাপক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি এএইচ মোফাজ্জল করিম [পরে সিএসপি, সচিব ও হাই-কমিশনার] এর অনুপ্রেরণা এবং সৈয়দ মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে পূণ্যভূমি সিলেটে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ও মুক্ত বুদ্ধির আন্দোলন চলছিল। হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা ‘সারথী’ এর অন্যতম সারথী ছিল আমার কবি বন্ধু ও সতীর্থ আহমেদুর রহমান। তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা ‘প্রকৃতির মাঝে তুমি’ আলোড়ন সৃষ্টি করলে আমি তাকে ডাকতাম আমাদের ওয়ার্ডসওয়ার্থ। আমাদের প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক কবি অন্তপ্রাণ সাহিত্যিক বন্ধুবর আহমেদুর রহমানকে গ্রন্থখানি উৎসর্গ করে গ্রন্থকার আকবর হোসেন অগ্রজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে যে শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা প্রমংসনীয়, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। আজকাল শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ভাই ভাইকে জমি-জমা টাকা-পয়সা নিয়ে ভ্রাতৃঘাতি বিরোধ দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে। সেখানে হৃদয়বান আকবর হোসেন আবেগাপ্লুত হয়েছেন ভ্রাতৃবিয়োগের বেদনায়। বেদনাবিদুর হয়ে বলেছেন,
‘তুমি রবে নীরবে’ চোখের জলের প্রার্থনায়
তুমি রবে যতনেআল্লাহর সমাদরে জান্নাতে
এই কামনায়
কবি ও গীতিকার আকবর হোসেন এই গ্রন্থের সমাপ্তি টেনেছেন আবেগময় একটি কবিতা দিয়ে। যেখানে ‘ক্ষমার আশায়’ শিরোনামে গ্রন্থকার বলেন,
তুমি স্রষ্টা আমি সৃষ্টি
ভুল সেতো আমি করবোই,
আমি জানি তোমার কাছে
মার্জনা আমি পাবোই।
তুমি সীমাহীন আমি সীমিত
তুমি দয়ালু আমি পীড়িত
ক্ষমার আশায় দোয়ারে তোমার
মাথা কুটে আমি মরবোই।
তোমার দয়ার আশা ছাড়িনি
যদিও তোমার পথে চলতে পারিনি
তব দ্বারে ক্ষমার আশায়
আমি বার বার ফিরে আসবোই।
আকর্ষণীয় বোর্ড বাঁধাই সাদা অফসেট কাগজের মোটমোটি নির্ভুল ছাপার মূল্যবান এই গ্রন্থখানির মূল্য মাত্র দুইশত টাকা বিদেশে মাত্র পাঁচ পাউন্ড। ধর্ম বিষয়ক জটিল বই হলেও গ্রন্থখানি সুখপাঠ্য। লেখকের ভাষায় সহজ সরল ও ঝরঝরে। ধর্মীয় কঠিন বিষয়সমূহকে লেখক সহজ ও সরল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। কবি ও গীতিকার আকবর হোসেন গদ্য শিল্পী হিসেবেও বিগত গ্রন্থগুলোর মতো সফল। এই গ্রন্থেও তিনি পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। একজন ইমানদার সাচ্চা ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে আওলাদে আদম এবং উম্মতে মোহাম্মদি হিসেবে তিনি ইমানি দায়িত্ব পালন করেছেন। আজকাল অনেক গণ্ডমুখর্, বকধার্মীক, বদতমিজ ও বেলেহাজ উম্মতে মোহাম্মদি (স.) কথিত কতেক আলেম ও কতেক ওলামা আখেরী নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স.) তাঁর সুনাহ-সম্মান-ইজ্জত ও জীবনদর্শন নিয়ে অযৌক্তিক চটকদারি হালকা মেজাজি ওয়াজ নসিহত এর নামে লম্পঝম্প আসুরিক চিৎকার গর্জন করে ওয়াজ মাহফিল সমূহের পবিত্রতা ও গাম্বীর্য বিনষ্ট করছেন মহানবীকে অসম্মান করছেন। অথচ স্বীকৃত সত্য মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফা (স.) এর নাম মহান আল্লাহ পাকের নামের সাথে সংযুক্ত সম্পৃক্ত। লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মাহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি এই পাক কালিমা পূর্ণ পাঠ না করলে পূর্ণ ইমানদার হবে না। মহানবী (স.) এর মেরাজ শরীফও ছিল শারীরিক, স্বাপ্নিক নয়। ইসলাম ধর্মের বিধান মোতাবেক মোহাম্মদ (স.) ই শেষ নবী, শ্রেষ্ঠ নবী, নবীদের সর্দার। তিনিই খাতিমুন্নবিয়ীন, তিনিই সাইয়্যেদুল মুরছালীন। আল্লাহর হাবীব হিসেবে তিনিই প্রথম মর্যাদা পাবেন। তিনি আমাদেরকে শাফায়েত করবেন। তার নামেই দোয়া ও জিকির হয় মোহাম্মদীয়া রাসুল আল্লাহ শাফায়তে দিও লিল্লাহ। মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফা (স.) এর শান সম্মান ও স্মরণে আল্লাহর পাক কালাম আলকুরআনে সূরা আয়াত আছে। সূরা আল আহযাব এ আল্লাহ বলেন, “হে মানুষ তোমরা মনে রেখো মোহাম্মদ (স.) তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত রাসুল এবং শেষ নবী’’।
মুসলমান মাত্রই জানেন নবী মুসা (আ.) আল্লাহকে দেখার জন্য আকুল হয়ে পড়লে আল্লাহ পাক মুসা নবীকে তুর পাহাড়ে আহ্বান করলে মহান আল্লাহর রুশনীতে পাহাড় পুড়ে ছাই হল সুরমা হলো কিন্তু মুসা নবীর আল্লাহ পাকের দীদার লাভ সম্ভব হয়নি। ইসলামী সঙ্গীত শিল্পী তাই মনের সুখে যথার্থই গেয়ে উঠেন “পাহাড় পুড়ে সুরমা হইল তবু মুসা জ্বলে না দরদি..”। অথচ মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফা (স.) কে আল্লাহ পাক আমন্ত্রণ করে আসমানী বাহন বোরাক মারফত সাত আসমান পেরিয়ে আল্লাহর আরশে আজিমে হাজির হন, পাদুকা পায়ে আসন গ্রহণে ইতস্ত করলে আল্লাহ বলেন আরশ আজ ধন্য হল হাবীবে আল্লাহ আপনি আসন গ্রহণ করুন। অথচ কিছু অতিবুঝদার, ঘরে বসে স্বঘোষিত গবেষক গণ্ড মুর্খের মতো মিলাদুননবী ছিরাতুন্নবী মহানবীর মান মর্যাদা শান শওকত নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে বেহুদা বাহবা কুড়াতে চান, গন্ধ যুক্ত বগল বাজান। এমতাঅবস্থায় গ্রন্থকার আকবর হোসেনের আল্লাহ, রাসূল, ইসলাম ধর্ম ও জাজিরাতুল আরব প্রসঙ্গে গ্রন্থখানি খুবই প্রসাঙ্গিক।
গ্রন্থকার আকবর হোসেন ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও একজন সফল মানুষ। প্রিয় জীবনসঙ্গনী সুকন্যা তাসলিমা হাবিবকে নিয়ে ঐতিহ্যবাহী বাহারমর্দানে তাঁর সুখের সংসার। তাঁর সন্তানগণও পিতামাতার মতো নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, পরোপকারী ও সমাজসেবী। গ্রন্থকারের সুস্বাস্থ্য ও পারিবারিক কল্যাণ কামনা করছি।
এই গ্রন্থ হজ্বযাত্রী ও সৌদিআরব ভ্রমণকারীদের গাইড বুক হিসেবেও কাজে লাগবে বিধায় হ্যাব, ট্রেভেল এজেন্ট এবং পর্যটকগণ সংগ্রহে রাখতে পারেন।
‘ইসলাম: যুগ থেকে যুগান্তরে’ মূল্যবান গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করছি। মহান মালিক গ্রন্থকারের এই মেহনত কবুল করুন এই মোনাজাত করছি।
পরিচিতি: ষাটের দশকের সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র এডভোকেট, হাই কোর্ট
মন্তব্য করুন