ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য ও জরুরি মাসায়িল
এহসান বিন মুজাহির :
পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জন্য রয়েছে একটি আনন্দ উৎসবের দিন। তারা সে দিন বিভিন্ন আনন্দ-উল্লাস, আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠে। তেমনি মুসলমানদের জন্য রয়েছে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দুটি আনন্দ উৎসবের দিন। একটি হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর, আরেকটি হচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতর হলো আরবি শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে এবং ঈদুল আজহা হলো জিলহজ মাসের দশম তারিখ। ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় একটি বৃহত্তম উৎসব। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে রোজাদারদের জন্য বিশেষ পুরস্কারও। আজকের কলামে ঈদুল ফিতর নিয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস করা হলো।
ঈদুল ফিতর পরিচিতি: ঈদ আরবী শব্দ। শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, আনন্দ-খুশি, প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা। আর ফিতর শব্দটি এসেছে, ‘ফিতরা’ ধাতু থেকে। ফিতর শব্দের অর্থ হচ্ছে, ভেঙ্গে ফেলা, সাদকা, ফিতরা। ঈদুল ফিতরের সমষ্টিগত অর্থ হচ্ছে, রোজা ভঙ্গের ঈদ। যেহেতু এক মাস সিয়াম সাধনা করার পর আমরা রোজা ভেঙ্গে ফেলি এবং ঈদ তথা আনন্দ করি সে জন্যই ঈদুল ফিতরকে, ঈদুল ফিতর নামে নাম করণ করা হয়েছে। আবার ঈদুল ফিতর এ জন্য বলা হয় যে, যেহেতু রোজাদাররা এক মাস রোজা রাখার পরে রোজা ভঙ্গ করে তাদের সম্পত্তি থেকে গরীব-মিসকীনদের মাঝে সম্পদ সাদকা তথা ফিতরা প্রদান করে। ঈদ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ফিরে আসা, যেহেতু প্রতি বছর ঈদ মুমিনদের মাঝে আনন্দ-খুশির বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয় সে জন্য ঈদকে ঈদ বলা হয়।
ঈদের সূচনা: হিজরতের পূর্বে ঈদ প্রথার প্রচলন ছিল না, বরং ঐ সময় মদিনার আনসারগণ বসন্ত ও পূর্ণিমার রাত্রে, ‘মিহিরজান’ ও ‘নওরোজ’ নামে দু’টি উৎসব পালন করতেন। হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- এক দিন নবী করিম (সা) হিজরত করে মদিনায় তাশরিফ নিয়ে দেখতে ফেলেন মদিনাবাসীরা, ‘নববর্ষ ও মেহেরজানের’ দু’টি উৎসব পালন করছে, তখন মহানবী (সা) তাদেরকে জিজ্ঞাস করলেন তোমরা এ দু’দিনে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠ কেন? মদিনার আনসার এবং নওমুসলিমগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল আমরা জাহেলী যুগে এ দু’দিনে আনন্দ উৎসব করতাম, যা আজ পর্যন্তও প্রচলিত। তখন রাসুল (সা) তাদেরকে বললেন আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদেরকে সেই দু’টি উৎসবের পরিবর্তে দু’টি উৎসব তোমাদেরকে দান করেছেন। সে দু’টি উৎসব হচ্ছে, ১. ঈদুল ফিতর। ২. ঈদুল আজহা। (আবু দাউদ )
ঈদের তাৎপর্য অপরিসীম। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এরশাদ করেন, ‘ঈদুল ফিতরের দিন যখন আসে তখন আল্লাহ তায়ালা রোজাদারদের পক্ষে গর্ব করে ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ তোমরাই বল রোজাদারদেরকে রোজার বিনিময়ে আজকের এই দিন কি প্রতিদান দেওয়া যেতে পারে? সেই সমস্ত রোজাদার যারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরী আদায় করেছে, তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেন, হে দয়াময় আল্লাহ উপযুক্ত উত্তম প্রতিদান তাদেরকে দান করুন। কারণ তারা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করেছেন, প্রাপ্য পারিশ্রমিক তাদেরকে দান করুন। তখন আল্লাহ তায়ালা রোজাদারকে বলতে থাকেন, ‘হে আমার বান্দা তোমরা যারা যথাযথ ভাবে রোজা পালন করেছ, তারাহবীর নামায পড়েছ, তোমরা তাড়াতাড়ি ঈদগাহের মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাও এবং তোমরা তোমাদের প্রতিদান গ্রহণ কর। ঈদের নামাজের শেষে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে বলতে থাকেন, হে আমার প্রিয় বান্দারা আমি আজকের এ দিনে তোমাদের সকল পাপ গুলোকে পুণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দিলাম। অতএব তোমরা নিষ্পাপ হয়ে বাড়ীতে ফিরে যাও’(বায়হাকি ও মিশকাত )
মহানবী (সা) ইরশাদ করেন-‘ঈদের আনন্দ শুধু তাদের জন্য যারা রমজানের রোজা, তারাবীসহ যাবতীয় আল্লাহর বিধি-বিধান গুরুত্ব সহকারে আদায় করেছে। আর যাহারা রমজানের রোযা ও তারাবীহ আদায় করেনি তাদের জন্য ঈদের আনন্দ নেই, বরং তাদের জন্য ঈদ তথা আনন্দ অগ্নিশিখা সমতুল্য। (বুখারি)
মহানবী (সা) হাদিসের মধ্যে আরো ইরশাদ করেন যে, ‘যারা রমজানে রোযা রাখেনি তারা ঈদের নামাজে সু-সংবাদ প্রাপ্ত মানুষের কাতারে শামিল হবে না। তাদের জন্য কোন আনন্দ নেই। আর যারা রোজা পালন করেছে, গরীবদেরকে নিজের মাল থেকে ফিতরা দিয়েছে শুধুমাত্র ঈদ তাদের জন্যই। তবে যাদের রোযা রাখার বয়স হয়নি অথবা বিশেষ কোন কারণে রোযা রাখতে পারেনি তারাও ঈদের এই আনন্দে শরীক হতে পারবে। কিন্তু যারা বিনা কারণে এবং অলসতা করে রোযা রাখেনি তাদের জন্য এ ঈদে আনন্দ নেই। এ ঈদ তাদের জন্য আনন্দ স্বরূপ নয়, বরং তিরষ্কার স্বরূপ’। (মুসলিম)
মহানবী (সা) আরো ইরশাদ করেন যে, ‘যে ব্যক্তি দু’ঈদের রাত্রে পূণ্যের প্রত্যাশায় ইবাদত-বন্দেগী করে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকদের অন্তর মরে যাবে, কিন্তু কেবল সেই ব্যক্তির অন্তর জীবিত থাকবে, সেদিনও মরবে না’।-(আতরাগিব)
রাসুলুল্লাহ (সা) এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি পূণ্যময় ৫টি রাতে ইবাদত-বন্দেগী করে সেই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ রয়েছে, আর সেই সুসংবাদটি হচ্ছে ‘জান্নাত’।পূণ্যময় ৫টি রাত হলো: ১. ঈদুল ফিতর। ২. ঈদুল আজহা। ৩. শবে বরাত। ৪. জিলহজ্জের রাত। ৫. আরাফাতের রাত। (বায়হাকি)
ঈদের সুন্নাতসমূহ:
ঈদের দিনে অনেক সুন্নাত রয়েছে, নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে ঈদের দিনের সুন্নাত সমূহ আলোকপাত করা হলো: ঈদের দিনে শরীয়তের সীমা রেখার ভিতর থেকে যথাসাধ্য সাজ-সজ্জা করা এবং খুশি করা । গোসল করা। সাধ্য অনুযায়ী উত্তম পোষাক পরিধান করা। মিসওয়াক করা। খুব প্রত্যুষে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। ফজরের নামায পড়েই খুব সকালে ঈদগাহে যাওয়া। ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খোরমা বা অন্য কোন মিষ্টি দ্রব্য ভক্ষণ করা, সম্ভব হলে সেমাই, মিষ্টি জাতীয় পিঠা খাওয়া । ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সাদকায়ে ফিতর আদায় করা । ঈদের নামায ঈদগাহে গিয়ে পড়া । ওজর ব্যতিত মসজিদে ঈদের নামায না পড়া । ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরা। তাকবীরে তাশরীক, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাললাহু আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ পাঠ করে করে ঈদগাহে যাওয়া। (ফাতওয়াযে শামী)
ঈদের নামাজ: ঈদের নামাজঅন্যান্য নামাজের মতো হলেও এর আদায়ের পদ্ধতি কিছুটা ব্যতিক্রম। যেমন: অন্যান্য নামায জামাতে আদায় করতে হলে আযান এবং ইকামতের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ঈদের নামায পড়তে আযান ইকামতের প্রয়োজন হয় না।
ঈদের নামাযের নিয়ম: প্রথমে এ ভাবে নিয়ত করবে যে, আমি ঈদুল ফিতরের দু’রাকাত ওয়াজিব ঈদের নামায ছয় তাকবীরের সাথে ইমামের পিছনে আদায় করছি আল্লাহু আকবার। এ বলে হাত বেঁধে নিবে এবং ছানা সুবহানাকাল্লাাহুম্মা পুরো দোয়াটি পাঠ করে তাকবীর আল্লাহু আকবার বলবে, প্রত্যেক বার হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে ছেড়ে দিবে এবং প্রত্যেক তাকবীরের পর তিন বার সুবহানাল্লাহ পরিমাণ সময় থাকবে। ৩য় বার তাকবীর বলে হাত ছেড়ে দিবে না বরং দু’হাত পুণরায় বেঁধে নিবে তারপর ইমাম সাহেব আউযুবিল্লাহ-বিছমিল্লাহ পড়ে সুরা ফাতেহা এবং অন্য একটি সুরা পড়বেন। মুক্তাদিরা ইমামের পিছনে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকবে, অতপর অন্যান্য নামাযের ন্যায় রুকু, সেজদা করে ২য় রাকাত পড়ার জন্য দাড়াবে। এই দ্বিতীয় রাকাতে ইমাম প্রথমে সুরায়ে ফাতেহা এবং অন্য একটি সুরা পড়ার পর উপরোক্ত নিয়মে ৩ বার তাকবীর বলবেন। প্রত্যেক বার কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে ছেড়ে দিবে অতপর ৪র্থ তাকবীর হাত উঠানো ছাড়া বলা অবস্থায় রুকুতে যাবে। বাকী নামাযের অন্যান্য নিয়ম দৈনিক নামাযের ন্যায় আদায় করবে।
মাসায়িল: ঈদের নামাজের পর ইমাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবাহ পাঠ করতে হবে। ঈদের নামাজ ঈদগাহে আদায় করা সুন্নাত, কেননা রাসূল (সা) আজীবন ঈদের নামায মাঠে আদায় করেছেন। কারণ বশত: কারোও ঈদের জামাত ছুটে গেলে সে একা ঈদের নামাজ পড়তে পারবে না, কারণ ঈদের নামাযের জন্য জামাত শত। আবার কোন ব্যক্তি জামাতে শামিল হওয়ার পর কোনো কারণে নামায ভঙ্গ হয়ে গেলে একা সেও কাযা পড়তে পারবে না। ঈদের নামায পড়ার স্থানে ঈদের দিন কোন নফল ও বা অন্য কোন নামায পড়া মাকরুহ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
মন্তব্য করুন