ঈদের টানা ছুটিতে কমলগঞ্জের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের ঢল    

June 29, 2017,

প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ॥ ঈদুল ফিতরের টানা ছুটিতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পর্যটন কেন্দ্র লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেইক, হামহাম জলপ্রপাতসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের ঢল নেমেছিল। পর্যটক নিরাপত্তায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সরকারি দিবসের ছুটিতে আনন্দ উপভোগের জন্য অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বেড়ানো। আর যে কোনো ছুটি উপভোগের জন্য দেশের অন্যতম পর্যটন উপজেলা হিসেবে কমলগঞ্জের জুড়ি মেলা ভার। এবারের তিনদিনের ছুটিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দেশি- বিদেশি পর্যটকের আগমনে মুখর ছিল কমলগঞ্জ। কেউ একা, কেউবা দলবেঁধে, কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে এবারের ছুটি কাটাতে এসেছেন কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে। এছাড়া কমলগঞ্জের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর এলাকাগুলোও ঘুরে দেখছেন এসব পর্যটকরা। তাদের স্বতন্ত্র জীবনাচার ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন আগত পর্যটকরা। চা-বাগান পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। চা-বাগান দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা থাকেন উদগ্রীব। চা-বাগান দেখে অপার মুগ্ধতায় ভরে উঠে প্রকৃতিপ্রেমিদের মন প্রাণ। চা-বাগানের নান্দনিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে সহজেই। সেই সাথে চা-বাগানে  সেলফি আর ছবি তোলার কথা ভুলেন না কেউই। ভারী টানা বৃষ্টিতে বড়লেখা উপজেলার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত এলাকায় পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করায় লাউয়াছড়াসহ কমলগঞ্জের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে এবার পর্যটকদের চাপ ছিল বেশী। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও মাধবপুর লেইক এলাকা ঘুরে এ চিত্র পাওয়া যায়।

পর্যটন কেন্দ্র লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানকমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কের মধ্যখানে অবস্থিত রেইন ফরেস্ট লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বিনোদনের অন্যতম এ স্পটটি দেশের বনাঞ্চলের মধ্যে নান্দনিক ও আকর্ষণীয়। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া উদ্যানে দেখা মিলে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির প্রাণীর। ১২৫০ হেক্টর জায়গা জুড়ে নানা জাতের গাছ গাছালিই এখানকার গহীন অরণ্যের রূপ নিয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এ বন বিখ্যাত। পর্যটকদের সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করে বিলুপ্ত বন্য প্রাণী উল্লুকের ডাক। এ ছাড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, চশমাপরা হনুমান, মায়া হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতীর প্রাণী। রয়েছে বিরল প্রজাতির বৃহৎ আকারের আফ্রিকান টিকওক, সারি সারি সেগুন, আগর, জারুল, চাপালিশ, ডুমুর, লকটন, আমলকি, জলপাইসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ। এ ছাড়া পাহাড়ী ময়না, ধনেশ, মথুরা, বন মোরগ,সবুজ ঘুঘুসহ ২৪৭ প্রজাতির পাখী রয়েছে। রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির পাহাড়ী পোকামাকড়। পাহাড়ের উঁচু নিচু টিলায় ২টি খাসিয়া আদিবাসী পল্লী। নিরক্ষীয় অঞ্চলের চিরহরিৎ বর্ষাবন বা রেইন ফরেস্টের মতো এখানেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে ঈদের কয়েক দিনের টানা ছুটি উপভোগ করতে দেশী বিদেশী হাজার হাজার পর্যটকদের আগমন ঘটে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে।

            এদিকে ঈদের ছুটিতে যেন মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয় প্রকৃতির সৌন্দর্য্যরে অপার লীলা নিকেতন সবুজ বনের লাউয়াছড়া উদ্যান আর পদ্মকন্যার মাধবপুর লেকটি। মাধবপুর চা বাগানে অবস্থিত মাধবপুর লেইক। লেকের চারপাশে বিশাল টিলায় সারিবদ্ধ ছোট-বড় গাছ আর সবুজ চা গালিচার টিলার মাঝখানে জলরাশি। টলটলে রূপালী জলের সঙ্গে দিবা-নিশির মিতালি করছে নীল পদ্মফুল। জলের আলো ছায়ার নীল পদ্মের লুকোচুরি খেলা মনমুগ্ধ করে আগত পর্যটকদের। প্রকৃতি অপরূপ সাজে সেজে নিজের রূপ দিয়েই আকর্ষণীয় হয়ে উঠায় জলের পদ্ম কন্যার মায়ায় অ্াঁকড়ে ধরবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের।

            অপরদিকে কমলগঞ্জের কুরমা সীমান্তের গহীন অরণ্যে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম হামহাম জলপ্রপাত। প্রায় ১৬০ ফুট পাহাড়ের ওপর হতে স্পটির স্বচ্ছ পানি আচড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের গায়ে। রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের প্রায় ৯ কি.মি. অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন এই হামহাম জলপ্রপাত। রোমাঞ্চকর দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাত গহীন বনের ওই ঝর্ণা ধারা। এছাড়া কমলগঞ্জের বীরশ্রেষ্ট হামিদুর রহমান স্মৃতিস্তম্ভ, মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, শমশেরনগর স্যুইচ ভ্যালী রিসোর্ট, উচু-নিচু টিলায় সবুজ গালিচার বিভিন্ন চা বাগান, ডবলছড়া ও মাগুরছড়া খাসিয়া পল্লীদের জীবন ধারা উপভোগ করতে এসব স্থানেও পর্যটকদের আগমন ঘটেছে।

            সম্প্রতি টানা ভারী বৃষ্টিতে বড়লেখা উপজেলার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত প্রবেশ পথসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কর্তৃপক্ষ এখন মাধবকুন্ডে পর্যটকদের প্রবেশ আপাতত নিষিদ্ধ করেছেন। আর এ ঈদে এসব পর্যটকদের চাপ পড়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেইক, হামহাম জলপ্রপাত, বিভিন্ন খাসিয়া পল্লী ও চা বাগানের সবুজ চায়ের গালিচা পরিদর্শণে।

গত তিন দিনে সরজমিন লাউয়াছড়ায় গিয়ে দেখা যায় পর্যটকদের ঢল। যানবাহনের সংখ্যাও ছিল লক্ষণীয়। ঢাকা থেকে ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। নাম শিল্পা ম্যাক। তিনি প্রথম এসেছেন এই এলাকায়। কথা হয় তার সাথে। লাউয়াছড়া বর্ষা বন দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি এক কথায় বললেন ‘অসাধারণ’। শিল্পা বললেন, গত তিনদিনের ছুটি যেন এই স্থবির জীবনটাকে প্রাণ দিয়েছে। নতুন গতি দিয়েছে। দিয়েছে প্রিয়জনের অনুভব মাখানো কিছুটা ছোঁয়া। গাছগাছালিতে ছেয়ে থাকা বনের শীতলতার পরশে আচ্ছন্ন লাউয়াছড়া আমার হৃদয়ের গহিনে এক অসাধারণ অনভ’ূতির জন্ম দিয়েছে এবং থেমে থাকা একঘেয়েমি গতিহীন জীবনটাকে ফিরিয়ে দিয়েছে নবজীবন।

বি-বাড়িয়া থেকে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে মাধবপুর লেইকে পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসা ডাক্তার ফজলুর রহমান বলেন, প্রকৃতির অপার লীলা নিকেতন মাধবপুর লেইক দেখে তারা মুগ্ধ।  রাস্তা খারাপ হওয়া সত্ত্বেও এখানে বেড়াতে এসে পর্যটকেরা নিজেদের সাধ্যমতো আনন্দ উপভোগ করার চেষ্টা করছেন। জলের মধ্যে উচু নিচু পাহাড়ে চা বাগান ঘেরা, এ এক আলাদা মায়াবী টান। আর এ আকর্ষণেই কিশোরগঞ্জ থেকে বেড়াতে আসা জাহিদুল হক বলেন, আমরা বন্ধুরা মিলে এখানে ছুটে এসেছি এখানে অনেক পর্যটকের অনেক উপস্থিতিও দেখলাম, এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দয্যে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। ঢাকা থেকে স্ব-পরিবারে আসা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আং রব, তার স্ত্রী শাহনাজ পারভীন, কলেজ পড়ুয়া মেয়ে তিথি, কুমিল্লা থেকে প্রকৌশলী আফরোজ চৌধুরী, তার স্ত্রী ফাতেমাতুজ্জোহরা, সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে আসা প্রবাসী কায়েছ আহমেদ, সুমি আক্তার, টাঙ্গাইল থেকে আসা ব্যবসায়ী শামীম আহমদ, তার স্ত্রী শবনম আরাসহ কয়েকজন পর্যটকের সাথে আলাপকালে তারা জানান, তিনটি পর্যটনকেন্দ্রে যেতে রাস্তার দুরবস্থা পর্যটকদের বেশি ভোগাচ্ছে। এ দুর্ভোগের আশঙ্কা সত্ত্বেও পর্যটকেরা বেশি আসছেন এসব এলাকায়। রাস্তাগুলো সংস্কার করা গেলে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সম্ভাবনা শতভাগ কাজে লাগানো সম্ভব হতো।

            পর্যটকদের বাড়তি চাপের ও তাদরে নিরাপত্তায় এবার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পর্যটন পুলিশের  সাথে সিপিজি (কমিউনিটি পেট্রোল গ্রুপ) পাহারাদার দল  কাজ করতে দেখা গেছে। তাছাড়া থানার বাড়তি পুলিশও মোতায়েন করা হয়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোসাদ্দেক আহমদ (মানিক) বলেন, পর্যটকের আগমনে লাউয়াছড়া ছিল মুখরিত । সেহেতু পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।

            কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, কমলগঞ্জ এখন দেশী বিদেশী পর্যটকদের খুব পছন্দের স্থান। হামহাম জলপ্রপাত এলাকা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বলে সেদিকেও নিরাপত্তা জোরদার ছিল।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com