একজন জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মহৎ মানবিকতাঃ না আমলাতন্ত্র-না আমলা তান্ত্রিক মানষিকতা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ ব্যুরোক্রেসি-আলোচিত-সমালোচিত হলেও সরকারি কর্মকর্তা-আমলা-ব্যুরোক্রেট্্সগন দেশ ও জাতির সম্পদ-পবিত্র আমানত। প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা-সিভিল সার্ভিসের কঠিন প্রতিযোগিতা-রিটেন-ভাইভা-বেরিফিকেশন শেষে বহুঘাট পেরিয়ে স্বপ্নের সিভিল সার্ভিস। পদায়ন-পদোন্নতি-নাম-ডাক শেষে ক্ষমতা প্রাপ্তির সম্মানের শিখরে আরোহন শেষে-এল, পি আর,-অবসর গ্রহন। একজন সুদক্ষ ও সৎ প্রশাসনিক কর্মকর্তা অবসর জীবন শেষেও চাকরিজীবন শেষ হয়েও হয়নি-শেষ। অবসর জীবন শেষেও অনেকেই চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগপান। পূনঃ দেশও জাতির খেদমত করেন। একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদ পাঁচ বৎসর। মেয়াদান্তে সংসদ নির্বাচন সাংবিধানিক বিধি বিধান। কিন্তু একজন পদস্থ আমলার কার্য্যকাল ও ক্ষমতা যোগদান থেকে অবসর গ্রহন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ সংসদের সমান।
রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা গেছে ন’ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী সেনা বাহিনী ও ডান্ডাতন্ত্রের মাধ্যমে প্রাদেশিক সামরীক সরকারের অবকাঠামোদাড় করলেও বেসামরীক সরকারও বেসামরীক প্রশাসন ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারে নি। প্রাদেশিক সামরীক গভর্ণর আব্দুল মুত্তালিব মালেক সরকার ছিলেন ব্যর্থ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভাষায়-ঠেডা মালিক্কা। পাক-সমর্থক কিছু অফিসার ও আমলা থাকলেও কামাল সিদ্দিকী, আকবর আলী খান প্রমুখ জাদরেল সিএসপি অফিসারগণ হানাদার পাক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুক্তিযুদ্ধে যুগদান করতঃ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন-জনগনেরই একটি উচ্চ শিক্ষিত ও সচেতন অংশ। সামরীক স্বৈর শাসক জেনারেল (অবঃ) এইচ.এম. এর্শাদ সরকারামলে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরন কর্ম্মসূচীর আওতায় থানা সমূহকে মান উন্নীত করে উপজেলা এবং পর্য্যায়ক্রমে মহকুমা জেলায় রূপান্তিত হয়। জেলার সর্ব্বোচ্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক। তিনি একজন বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও বটেন। হাল আমলে জেলা প্রশাসক সাহেবানরা শো-কেসের-শো-পিস-নহেন। সচিবালয়ের বাহিরে মাঠ পর্য্যায়ে উপ-সচিবের পদ মর্য্যাদা সম্পন্ন জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কালেন্টারগণ পদাধিকার বলে বিভিন্ন শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সভাপতির গুরু দায়িত্ব পালন করতঃ সমাজ বিকাশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বৃহত্তর সিলেটের দক্ষিন-পূবাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলা মৌলভীবাজার। সুনামগঞ্জের সু-সন্তান প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের মেধাবী কর্মকর্তা শাকির উদ্দিন আহমদ ছিলেন জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সম্প্রতি এ জেলায় জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবেযোগদান করেছেন বিসিএস-এডমিন-ক্যাডারের মেধাবী কর্মকর্তা তোফায়েল ইসলাম। দীর্ঘদেহী-সুদর্শন ও স্পষ্টবাদি এই কর্মকর্তা ইতিমধ্যেই কথাও কাজে সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন-প্রশংসা প্রাপ্ত হয়েছেন।
৩ জানুয়ারী জেলাধীন কমলগঞ্জ উপজেলা সফর করছিলেন তিনি। রাস্তায় জটলাদেখে স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে গাড়িথেকে নামেন জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম। দেখলেন সড়ক দূর্ঘটনায় একজন দরিদ্র মহিলা মৃত্যোবরন করেছেন। দাফন-কাফনের জন্য এই দরিদ্র মহিলার নিকটাত্মীয় কেউ না থাকায় জেলা প্রশাসক সাহেব স্বেচ্ছা প্রনোদিত হয়েই তাৎক্ষনিক ভাবে আর্থিক সহায়তা দিলেন। কিন্তু দূর্ঘটনা জনিত অস্বাভাবিক মৃত্যো হলে ময়না তদন্ত ছাড়া লাশ দাফনে আইন-কানুনি জটিলতা ও বিধি নিষেধ আছে। প্রার্থীত মতে বিশেষ ব্যবস্থায় দূর্ঘটনাজড়িত মামলা না করতে চাইলে জেলা প্রশাসক ময়না তদন্ত ছাড়া লাশ দাফনের অনুমতি দিতে পারেন। সড়ক দূর্ঘটনাজনিত কারনে নিহত এই দরিদ্র মহিলার কোন স্বজন না থাকায় মামলা দায়েরে কেউই-উৎসাহী ছিলেন না। হৃদয়বান তোফায়েল ইসলাম কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মকর্তাকে আদেশদেন স্থানীয় ইউ পি চেয়ারম্যান এর সুপারিশ সহ তিনি যেনো তাঁর কাছে লাশ ময়না তদন্ত ব্যতিত দাফনের অনুমতি জানিয়ে আবেদন করেন। সেই মর্মে ওসি কমলগঞ্জ স্থানীয় ইউ পি চেয়ারম্যানের সুপারিশ সহ আবেদন পত্রটি একজন পুলিশ কর্মকর্তা মারফত জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে পাঠালে সাদা মনের সরল মানুষ তোফায়েল ইসলাম যাবতীয় আমলাতান্ত্রীক বিধি বিধান প্রথা-প্রদ্ধতি পরিহার করে কমলগঞ্জ থানাধীন মাধবপুর থেকে তার নিজের গাড়ির উপর কাগজটি রেখে দাফনের অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করেন। সামাজিক মূল্যবোধের মারাত্মক রকমের অবক্ষয়, নৈতিকতার নিদারুন ক্রমোবনতি, কতেক নেতা-সরকারি কর্মকর্তাদের দূর্ণীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার-লাগামহীন গলাবাজি, বানিজ্যায়ন-দূবৃত্তায়ন-স্পীডমানি ও ভ্রষ্টাচারের জোয়ারের মাঝে একজন পদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তার এই মহৎ মানষিকতা প্রশংসনীয়। অনুকরনীয়। স্বজনহীণ এক হত দরিদ্র মহিলার আবেদন নিয়ে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে আসার লোকই নাই। অফিসের আনুষ্টানিকতা-প্রাসঙ্গিকতা এডিএম/এনডিসি সাহেব জুডিশিয়াল পেস্কার হয়ে জেলা প্রশাসক সাহেব সমীপে পেশ হতে বেশ সময় লেগে যেত। সকল আমলাতান্ত্রীক প্রথাপদ্ধতি পরিহার উপেক্ষা করে মহৎ মানুষ তোফায়েল ইসলাম মানবিকতার পরিচয় দিলেন। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ২০১৭ সাল দৈনিক মানবজমিনে ডিসির মানবিকতা শিরোনামে কমলগঞ্জ প্রতিনিধি প্রদত্ত একটি সচিত্র সংবাদ পরিবেশিত হয়। সংবাদ চিত্রে দেখা যাচ্ছে জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম তাঁর গাড়িতে রেখে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করছেন। তাঁর এক আদেশের প্রেক্ষিতে হতদরিদ্র স্বজনহীন বৃদ্ধার লাশ দাফন কাফনে আর কোন আইনী বিধি নিষেধ রইল না।
সাধারন পাঠকের অবহতি ও অবগতির জন্য দূর্ঘটনা জনিত অস্বাভাবিক মৃত্যো পরবর্তী আইনী কার্যক্রমে কিঞ্চিত আলোকপাত করা যেতে পারে। প্রথমে মৃত্যোর সুরত হাল রিপোর্ট-ইনকোয়েষ্ট তৈরী করা হয়। অতঃপর সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল বোর্ড লাশের ময়না তদন্ত-পোষ্ট মর্টেম-করেন। এই রিপোর্টটি মৃত্যোর কারন নির্ণয় করে। লাশ সংক্রান্ত মামলা বিচারে উঠলে বাঃ দঃ বিঃ ৩০২/৩০৪/এ/বি ধারায় মামলায় হত্যার প্রমানস্বরূপ উল্লেখিত মেডিকেল রিপোর্ট এবং চিকিৎসকগণের স্বাক্ষী লাগে। একটি কনটেষ্টিং-প্রতিদ্ধন্ধীতামূলক হত্যা মামলায় এসব ডকুমেন্টারি এভি ড্যেন্স এবং সাক্ষী প্রাসঙ্গিক। কিন্তু একটি নন কটেষ্টিং মামলায় এসবের প্রয়োজন নেই। আপোষ কিংবা অন্য হয়রানী জনিত কারনে অনেকেই হত্যা মামলা করতে চান না। এসব ক্ষেত্রে একজন হতভাগ্য লাশের পোষ্ট মর্টেমে আইনী বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়-এই আইনটি আংশিক পরিবর্তনযোগ্য।
আইনের সংস্কার সংশোধনী সংযোজনী পরিবর্ধন-পরিমার্জন এখন সময়ের দাবী। বৃটিশ ভারতে বৃটিশের প্রশাসনিক –রাজনৈতিক সুবিধার জন্য প্রনীত মান্দাতার আমলের আইনদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ চলতে পারে না। তখন বৃটিশরা ছিল ভারত বাসির প্রভু-জনগন ছিলেন গোলাম-রায়ত-প্রজা। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র একটি প্রজাতন্ত্র-প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগন। এই প্রেক্ষিতে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের মান্যবর প্রধান বিচারপতি মিঃ জাস্টিস এস কে সিনহা-যথার্থই বলেন-্আইওয়ান্ট টু-চেইজ্ঞ দি হইল সি আর পি সি-প্রধান বিচারপতি মিষ্টার সিনহা আইনের সংস্কার ও সংশোধনী, বিচার বিভাগের ভাবমূতি ও মর্য্যাদা রক্ষা এবং সহজে সল্প সময়ে জনগনের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছেন। আইনজীবী সমাজ-দেশ ও জাতিকে এতদ সংক্রান্ত বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।
প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া একটি আধুনিক কল্যানকামী গনতান্ত্রীক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে খ্যাত ও স্বীকৃত। সাংবাদিক নির্য্যাতন, হত্যা, গুলির মাঝে ও জীবন বাজি রেখে সচেতন সাংবাদিক সমাজ দেশ ও জাতির জাগ্রত বিবেক হিসাবে কাজ করছেন। শুধু নেতিবাচক-নিন্দনীয় নয়-ইতিবাচক প্রশংসনীয় দিক ও দেশ ও জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করছেন-দেশে প্রকৃত ও সত্যিকার বিরোধী দলের অভাব ও অপূর্ণতার মাঝে দেশীয় জনগোষ্টির সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার অপ্রকাশিত কথাও কাহিনী তালাশÑখুঁজ-চোখ এর মাধ্যমে তুলে ধরছেন।
এই কঠিন সময়ে একজন জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলামের এই মহৎ কর্ম ও মানষিকতা প্রশংসনী। এমনি একটি চমৎকার আশাব্যাঞ্জক সংবাদের জন্য দৈনিক মানবজমিন এবং কমলগঞ্জ প্রতিনিধিকে ধন্যবাদ।
(সেক্রেটারী, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিওর এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিষ্ট)
মন্তব্য করুন