একজন সৈয়দ মাসুম এবং তাঁর কমলগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থ
সৈয়দ সোহেল আহমদ॥ সৈয়দ মাসুমের জন্ম ১৯৭৩ সালে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পৌরসভাধীন খুশালপুর গ্রামে। লেখালেখির সাথে জড়িত আছেন ১৯৮৫ সাল থেকে।
১৯৯১ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’বিসর্গ বন্ধনে’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সাল থেকে ‘স্ব-চিন্তা’ সাহিত্যপত্র সহ আরও বেশ কয়েকটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করে আসছেন।
অপদমস্তক কবি এই বরেণ্য লেখক ১৯৯৮ সালের শেষ দিক থেকে ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।
২০০৩ সাল থেকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। গ্রেট ব্রিটেনে বেশ কয়েকটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সৈয়দ মাসুম বার্মিংহাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলামেইলেরও সাহিত্য সম্পাদক।
একজন কবি, লেখক, সম্পাদক, সংগঠক ও শিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি তিনি গবেষণা কাজে সম্পৃক্ত সেই নব্বইর দশকের প্রথম দিক থেকে।
দেশ, বিভাগ, জেলা অথবা নিজ এলাকা এমনকি শিল্প সাহিত্য নিয়ে তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ ও নিবন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
সামাজিক কর্মকান্ডেও সৈয়দ মাসুম জড়িত ছোটবেলা থেকে। ছাত্র জীবনে নিজ এলাকায় গড়ে তুলেন ‘সমাজ সমৃদ্ধি পরিষদ’ নামক একটি এনজিও সংগঠন।
আর এর মাধ্যমে নব্বইর দশকের প্রথম দিকে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষকে রিক্সা ও হাত গাড়ি দিয়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে দেন।
সেই সময়ের কমলগঞ্জ সদর মুন্সিবাজার ও আলীনগর ইউনিয়নের অগনিত মানুষ এখনো তার নীরব স্বাক্ষী। এরই ধারাবাহিকতায় নিজ এলাকায় তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
শমসেরনগর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করছেন। কমলগঞ্জ প্রেসক্লাব ভবন নির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পদক।
এ পর্যন্ত সৈয়দ মাসুমের মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি আর সম্পাদিত গ্রন্থ প্রায় অর্ধ ডজন। ২০২২সাল থেকে ‘স্ব-চিন্তা’ নামে একটি লিটলম্যাগ তাঁর সম্পাদনায় লন্ডন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ।
আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় যা ইতোমধ্যে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে তাঁর আরও এক ডজনের মত বই।
সম্প্রতি সৈয়দ মাসুম এর “কমলগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য” নামে একটি গ্রন্থ বেরিয়েছে। লন্ডনে অনুষ্ঠিত একাদশ বাংলাদেশ বই মেলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবকে সামনে রেখে এই গ্রন্থটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করেছে দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রকাশনা সংস্থা ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’।
বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন বাংলাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট গবেষক কবি ড. শোয়াইব জিবরান আর প্রচ্ছদ এঁকেছেন দেশসেরা প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ। গ্রন্থটি বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
ভূমিকায় ‘কমলগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কবি ড. শোয়াইব জিবরানের মন্তব্য হচ্ছে গ্রন্থটি অত্যন্ত সুলিখিত।
গ্রন্থটির প্রথম কয়েকটি অধ্যায়ে কমলগঞ্জের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছেন সৈয়দ মাসুম। নামকরণ থেকে একদম সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত।
এ পর্যায়ে আমার যে বিষয়টি সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো, তিনি এ পর্বে ইতিহাসের নানাপর্বকে তুলে ধরেই দায় সারেননি, প্রয়োজনীয় স্থানে ইতিহাসের নানা তথ্য তুলে ধরে তা বিশ্লেষণ করে নিজস্ব যুক্তিসংগত মতামতটি প্রদান করেছেন।
কমলগঞ্জের নামকরণের প্রসঙ্গে তাঁর যুক্তিগুলো এতদিনের জানা ইতিহাসকে পুনর্বিবেচনার পরিসর তৈরি করবে। আর ইতিহাসকে তিনি মোটাদাগে তুলে ধরেননি।
একেবারে ইউনিয়ন পর্যায়ের ইতিহাসকেও তুলে ধরেছেন। এতে একটি উপজেলার পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপটি উঠে এসেছে। বইটি কমলগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
যারা এ পর্যন্ত বইটি পাঠ করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বিলেতের বিশিষ্ট গবেষক, বাংলা একাডেমির বিশেষ সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ফারুক আহমেদ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সৈয়দ মাসুমকে দেওয়া বইটি সম্পর্কে এই প্রতিথযশা গবেষকের মন্তব্য হচ্ছে, ‘‘কমলগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ আজ ভোর থেকে পড়ছি।
যেমন দেখতে, তেমনি বিষয়বস্তু, তেমনি উপস্থাপনা, তেমনি ছাপা ও বাঁধাই। অসাধারণ একটি বই। লেখক ও প্রকাশক উভয়কে ধন্যবাদ। পড়া শেষ হবার পর সময় ও সুযোগে রিভিউ লিখব।
বাকি জীবনে আপনার আর কোনো বই না লিখলেও চলবে। এই বইটি যে লেখক হিসেবে আপনাকে অমরত্ব দান করবে তা বলাই বাহুল্য।
এ ধরনের বইয়ের ক্রেতার অভাব কোনে কালে ছিল না, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। কমলগঞ্জের মানুষতো বটে সিলেট বিভাগের ইতিহাস লিখতে হলে এই গ্রন্থটি অবশ্যই পড়তে হবে।
কমলগঞ্জ উপজেলা নিয়ে এর আগেও বিভিন্ন সংকলন সরকারি ও বেসরকারি ভাবে প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু একক কোন লেখকের লেখা এটাই প্রথম গ্রন্থ।
গত ১০ সেপ্টেম্বর লন্ডন বই মেলায় গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচিত হয়। প্রকাশকদের কাছ থেকে পাওয়া তত্ত্ব মতে লন্ডন বইমেলায় যে দুই চারটি বই সব চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে তার মধ্যে একটি ছিল কমলগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর বার্মিংহাম বইমেলায় এই বই বেস্ট সেলার বুকের মর্যাদা লাভ করে। দু’টি বইমেলাতেই লেখক ও প্রকাশক উপস্থিত ছিলেন। ম্যানচেষ্টার বইমেলাতেও গ্রন্থটি যাচ্ছে।
আগামীতে ঢাকায় একুশের বইমেলা, কলিকাতা, নিউইয়র্ক এমনকি ফ্রাংফুর্ট বইমেলাতেও এই গ্রন্থটি নিয়ে যাওয়া হবে বলে প্রকাশক সূত্রে জানা গেছে।
গ্রন্থটির বাংলাদেশে মূল্য রাখা হয়েছে ৬০০টাকা, ব্রিটেনে ১০ পাউন্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশক সংস্থা মুক্তধারা, জ্যাকসন হাইটস, নিউইয়র্ক এবং কলিকাতায় বই বাংলা।
অনলাইন ক্রেতারা পাবেন rokomari.com/ ittadi othoba.com/ ittadi boibazar.com/ ittadi boiferry.com/ ittadi থেকে।
২৮৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি ২৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত। গ্রন্থটিতে কমলগঞ্জ উপজেলার ১১৯৫ সাল থেকে ২০২৩ অর্থাৎ প্রায় এক হাজার বছরের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ, ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তানী আমল, মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, ঘটন ও অঘটন কোন কিছুই বাদ যায়নি।
কমলগঞ্জ উপজেলা সম্পর্কে একজন মানুষের যত কিছু জানার প্রয়োজন মোটামোটি তাঁর সবকিছুই রেফারেন্সসহ বর্ণিত হয়েছে সৈয়দ মাসুম এর ‘কমলগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থে।
লেখক : ব্যাংকার ও নির্বাহী সম্পাদক– স্ব–চিন্তা, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
মন্তব্য করুন