একটি তেলাপোকার শেষ পরিণতি
তাহিরা কামাল॥ এইতো কয়েকদিন আগে রেলে চড়ে যাচ্ছিলাম আমি ঢাকা শহরে। আসনে চড়ে বসতেই দেখা হলো এক ঝাঁক তেলাপোকার সাথে। কেউ কোমরে ধাক্কা দিয়ে বসলো আমার পাশে, কেউ বা লাফ দিয়ে উঠলো আমার পিঠে, কেউ বা আঙ্গুলে চিমটি দিয়ে বলে উঠলো, ‘খানিকটা চিপস দাও বন্ধু, বসেছো যখন পাশে।’ এমন জমজমাট আড্ডা শেষে পৌছালাম গন্তব্যে।
আমার বড় নানুর বাসায় ঢুকতে উঠে পড়লাম লিফটে। লিফটে উঠতেই দেখি চুপ করে বসে আছে একটি তেলাপোকা। আমার মনে হল এর মন খারাপ। বুঝতেই আর বাকি রইলো না এটি আমার বন্ধু এক ঝাঁক তেলাপোকার মা। তখন কাছে গিয়ে একটু ভালোবেসে বললাম, ‘ওরা তো রয়ে গেছে স্টেশনে, ট্রেন থামতেই চলে গেছে ট্রেনের ছাদে।’ বলতে বলতেই চলে গেলাম নানুর ঘরে।
হাত, মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানার উপর। খাওয়ার সময় হাত ধুতে গিয়ে আবার দেখা হলো ওই তেলাপোকাটির সাথে। মনে হলো সে খুব মিতব্যয়ী। তাই আমাদের ফেলে দেয় খাবারগুলো ময়লার ঝুড়িতে বসে বসে খাচ্ছিল।
তারপর টিভি দেখতে বসলাম। তখন দেখতে পেলাম তেলাপোকাটি টিভির নিচে ঝিম ধরে বসে আছে। তখনই টিভিতে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল তেলাপোকা মারার দারুণ ঔষধ ‘লাল হিট’। বিজ্ঞাপনের কথা শুনেই উড়াল দিয়ে পালালো তেলাপোকাটি। যাক বাঁচা গেল।
দুদিন পর আবার রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করতে হলো কিছুক্ষণ। তখন দেখি আমার ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসছে সেই তেলাপোকাটা। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ব্যাগটি ঝাড়া দিতেই ছিটকে গিয়ে পড়ল নিচে। ঠিক ঐ মুহূর্তে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছিলেন প্ল্যাটফর্ম এর দিকে। পড়বি পড় আকস্মিকভাবে তেলাপোকাটি গিয়ে পড়ল তার পায়েরই নিচে। মূহুর্তের মধ্যেই ঘটে গেল ঘটনাটি। ‘ফট’ করে একটি শব্দ হল। ভদ্রলোকের পায়ের নিচে পড়ে তেলাপোকাটির ভেতরের নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে এল। মেঝের মধ্যে লেপ্টে পড়ে থাকল তেলাপোকাটি। নিমিষেই তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
আমার মনটা তখন খুবই খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম আমি যদি ব্যাগটা ঝাড়া না দিতাম হয়তো তেলাপোকাটি এখনো বেঁচে থাকতো। আমার সাথে ট্রেনে উঠলে হয়তো তার বাচ্চাদের সাথে দেখা হতে পারতো। কি আর করা? মন খারাপ করেই বসে রইলাম।
একটু পরেই দেখতে পেলাম একঝাঁক পিঁপড়া এসে তেলাপোকার মরদেহটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিঁপড়েগুলো আকারে ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও তাদের চেয়ে শতগুণ বড় তেলাপোকাটিকে অবলীলায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তেলাপোকাটির মৃতদেহটি পিঁপড়েদের কাঁধে চড়ে হেলেদুলে চলে যাচ্ছে মেঝের একটি গর্তের দিকে। একটু পরই সেই গর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল পিঁপড়েরা। সাথে নিয়ে গেছে তেলাপোকাটিকে।
পৃথিবীর সব জায়গায়ই তেলাপোকার বিচরণ। পৃথিবীর আদিম প্রাণী তেলাপোকারা এখনও টিকে আছে। ডাইনোসরের মতো বড় বড় প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তেলাপোকারা এখনও রাজত্ব করেই যাচ্ছে। যদিও হতভাগ্য তেলাপোকাটির এই বিচিত্র মৃত্যু আমার মনটাকে একটু নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। তারপরও এটাই বাস্তবতা। ছোটবড় সকল প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। যার ভাগ্যে যেভাবে মৃত্যু লেখা আছে তার ব্যতিক্রম হবার তো কোন উপায়ই নেই। ওদিকে গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। তাই দেরি না করে দ্রুত গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। পেছনে পড়ে রইল তেলাপোকাটির মৃত্যু এবং শেষ পরিণতির দৃশ্যটুকু।
(তাহিরা কামাল, চতুর্থ শ্রেণি, বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়।)
মন্তব্য করুন