একাত্তোরের রনাঙ্গঁনের প্রিয় সাথী সৈয়দ মহসীন আলী : তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর ভাবনা : কামনা : -মুজিবুর রহমান মুজিব
চৌদ্দই সেপ্টেম্বর আঠারো সাল, একাত্তোরের বীর-রনাঙ্গঁনের প্রিয় সাথী, মরহুম সাংসদ ও সমাজ কল্যান মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর তৃতীয় মৃত্যোবার্ষিকী। পনেরো সালের চৌদ্দই সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সবাইকে কাঁদিয়ে তাঁর প্রিয়জনকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চীরতরে চলে যান না ফেরার দেশে। তার এই মৃত্যো ছিল আকস্মিক ও অসময়ের। গোল বাটা মুখ, ফর্সা নাদুশ নুদুশ চেহারার সুঠাম শরীরের অধিকারি মাঝারি উচ্চতার সৈয়দ মহসীন আলীর খুব একটা রুগবালাই ছিল না। চেইন স্মোকার এবং ভোজন রশিক হওয়ার কারনে ডায়বেটিস ও রক্তচাপে ভূগছিলেন তিনি। পনেরো সালের পাঁচই জানুয়ারী মৌলভীবাজার সদর আসন থেকে বিনা প্রতিদ্ধন্ধীতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে আওয়ামীলীগ প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রী সভায় সমাজ কল্যান মন্ত্রী নিযুক্ত হন নির্ভীক মুজিব সৈনিক জননেতা সৈয়দ মহসীন আলী। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর প্রিয় দল আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে জেলা সদর থেকে বিএনপির হেভীওয়েট প্রার্থী সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানকে হারিয়ে এম.পি নির্বাচিত হয়ে চমক দেখিয়েছিলেন সাবেক পৌর চেয়ারম্যান সৈয়দ মহসীন আলী। এমন চমকপ্রদ বিজয়ে তখন মন্ত্রী সভায় স্থান পাননি এই একাত্তোরের বীর। পাঁচ জানুয়ারীর বিতর্কিত ও অগ্রহনযোগ্য নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্ধন্ধীতায় এমপি নির্বাচিত হয়ে পূর্ন মন্ত্রী হন সৈয়দ মহসীন আলী। মন্ত্রী হওয়ার পর তার সহজ সরল আচরন, সৌজন্য বোধ এবং নিজস্ব ষ্টাইল ও ভঙ্গীমায় কাজ কর্ম ও কথা বলে গান গেয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। অসুস্থ হলে শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠানো হয়। দেশে হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফার দরগা মসজিদে, আলহাজ¦ মখলিছুর রহমান ডিগ্রি কলেজে তার রুগমুক্তি কামনা করে মিলাদ-দোয়া হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, মহান মৃত্যোকে তিনি আলিঙ্গন করেন-একাত্তোরের অকুতোভয় বীর হেরে যান অসুখের কাছে। তাঁর লাশ দেশে আসার পর সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। সংসদ প্লাজায় তাঁর নামাজে জানাজা শেষে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্টিত হয় তাঁর বিশাল নামাজে জানাজা। নামাজে জানাজার পূর্বে মাগফিরাত কামনা করে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
তাঁর মরদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে পুস্পস্থবক প্রদান করা হয়। জেলা বি.এন.পির পক্ষ থেকে আমি কতেক বি.এন.পি নেতা সহ তার মরদেহে পুস্পস্থবক প্রদান করি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গার্ড অব অনার শেষে নামাজে জানাজা, রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত শেষে তাঁকে হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফার মাজার প্রাঙ্গঁনস্থ গোরস্থানে তাকে চীর শয়ানে শায়িত করা হয়। একাত্তোরে তাঁর একজন সহযোদ্ধা এবং আজীবনের বন্ধু হিসাবে পরবর্ত্তী পর্য্যায়ে এই দরগা মসজিদে বাদ জুম্মা তার প্রিয় খিচুড়ি শিরনী দিয়ে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করি, তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়ারও আয়োজন করি। এখনও দরগা এবং দরগা মসজিদে গেলে তাঁর কবর জিয়ারত ও তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি। এই তিন বছরে মুক্তিযোদ্ধা এবং সহজ সরল সাদা মনের মানুষ সদা হাস্য উজ্জল সৈয়দ মহসীন আলীর কবরের মাটি পুরাতন হয়ে গেছে। গজিয়েছে ঘাস লতাপাতা, ফুটেছে নাম না জানা ঘাসফুল। কিন্তু এখনও তিনি স্মৃতির হভীরে হারিয়ে যান নি। তিনি আছেন আমাদের সকলের মনের মনি কোঠায়। মরহুম সৈয়দ মসহীন আলীর তৃতীয় মৃত্যোবার্ষিকীতে তার উজ্জল স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
বয়সে কিঞ্চিত কনিষ্ট হলেও একই শহরের বাসিন্দা সৈয়দ মহসীন আলী আমার একজন ভালো বন্ধু ছিলেন। একাত্তোরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে তার সঙ্গেঁ আমার সম্পর্কের গভীরতা। ষাটের দশকে আমি ছিলাম বাঙ্গাঁলী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন কর্মি ও সংঘঠক। কলেজ শাখা এবং অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। সৈয়দ মহসীন আলী ছিলেন একজন নির্ভীক মুজিব সৈনিক। স্বচ্ছল-সম্ভ্রান্ত পরিবারের সু-সুসন্তান সৈয়দ মহসীন আলী বাল্য কাল থেকেই স্মার্ট, হ্যেন্ডসাম, কর্ম চঞ্চল এবং বন্ধু বৎসল, একজন নির্লোভ সিঃস্বার্থ সমাজ সেবক। স্বাধীনতা উত্তরকালে তিন মেয়াদে মৌলভীবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠন রেডক্রসের সেক্রেটারি, রোটারি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসাবে একজন সার্বক্ষনিক সমাজ ও দেশ কর্মি হিসাবে তিনি দেশ, জাতি এবং সমাজকে সেবা দিয়েছেন। তিনি একজন সার্বক্ষনিক সমাজ সেবি ও সমাজ কর্মি ছিলেন। তাঁর যোগ্য জীবন সঙ্গীঁনি বেগম সায়রা মহসীন তাঁর সকল কাজের প্রেরনার উৎস ছিলেন। দারুন মনের মিল ছিল দূজনে দূজনার। তাঁর মৃত্যোর পর জাতীয় সংসদ, মৌলভীবাজার তিন শূন্য আসনে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হন সৈয়দা সায়রা মহসীন। তিনি প্যেনেল স্পীকারও নির্বাচিত হয়েছেন।
মরহুম সৈয়দ মহসীন আলীর সঙ্গেঁ আমার প্রায় পাঁচ দশকের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এই পাঁচ দশকের ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব- এই সব হাসি কান্না আনন্দ বেদনা এই মহাকাব্য পাঁচ পাতায় লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। সৈয়দ মহসীন আলী এবং আমি একে অন্যের কোন নিকটাত্বীয় নই, একে অন্যের ব্যবসায়ীক অংশীদার ছিলাম না। আমি কোন ব্যবসায়ী নই একজন আইনজীবী হই। এক পাড়ার বাসিন্দা কিংবা একে অন্যের নিকট প্রতিবেশী ছিলাম না, রাজনীতি, দল ও দর্শনগত ভাবে ভিন্নমতাবলম্বী একে অন্যের বিপরীতমুখী, তবুও শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মানব প্রেম সংক্রান্ত কারনে আমাদের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক ছিল। আমাদের মধ্যে একটি গভীর রাজনৈতিক মত পার্থক্য থাকলেও কোনদিনই কোন মনোমালিন্য হয়নি। যৌবনকালে আমরা দুজনই মেজাজী ছিলাম। কিন্তু কোনদিনই ঝগড়া বিবাদ করিনি। তাঁর সঙ্গেঁ আমার একটি পারিবারিক সম্পর্ক ছিল-আছেও। তার সহধর্মিনী আমাকে সহোদর ভাইর মত দেখেন, কনিষ্ট ভ্রাতাগন আমাকে অগ্রজের মত, কন্যাগন চাচা ডাকেন, আপন চাচার মতই দেখেন। রাজনীতিগতভাবে সৈয়দ মহসীন আলী ছিলেন একজন নিখাদ নির্ভীক মুজিব সৈনিক। আওয়ামী যুবলীগ এবং জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসাবে তিনি বলিষ্ট ও একনিষ্ট ভাবেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কট্টর আওয়ামীলীগার হলেও পরমতের প্রতি সৈয়দ মহসীন আলী ছিলেন সহনশীল সংবেদনশীল। “আপনার মতের সঙ্গেঁ আমি একমত না হতে পারি, কিন্তু আপনার মত প্রকাশের জন্য আমার জানটা দিতে পারি-” দার্শনিক ভলতেয়ার এর এমন মতের সমর্থক ছিলেন তিনি। জনপ্রতিনিধি হিসাবে তিনি সকল দল মত পথের মানুষের কথা শুনেছেন-সম্মান দিয়েছেন। মৌলভীবাজার পৌরসভার তিন মেয়াদের চেয়ারম্যান হিসাবে তার অভিভাবকত্ব বলিষ্ট নেতৃত্ব সার্বজনীন সৌহার্দ্য ও সম্প্রিতি মনে রাখার মত। স্মরন করার মত। জনপ্রতিনিধি হিসাবে সৈয়দ মহসীন আলী ছিলেন দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধে। তার মধ্যে কোন হীন মন্যতা ছিলনা, বরং তিনি ছিলেন উদার সহজ সরল বন্ধু বৎসল প্রানবন্ত প্রাণের মানুষ।
রাজনীতিবিদ-সংষ্কৃতিসেবী সৈয়দ মহসীন আলী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। এককালে আমরা দীর্ঘদিন একসাথে মোতাওয়াল্লী আলহাজ¦ সৈয়দ খলিলুল্লাহ ছালিক, সৈয়দ মফচ্ছিল আলী সহ দরগা মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতাম। তিনি সবাইকে দামী আতর বিলাতেন। বিশাল দরগা জামে মসজিদ নির্ম্মানেও তার বলিষ্ট ভূমিকা ছিল। নির্ম্মানাধীন জেলা জামে মসজিদ এর একটি অনুষ্ঠানে কমিটির সেক্রেটারি হিসাবে দাওয়াত দিয়ে এনেছিলাম। জেলা জামে মসজিদ এর পেশ ইমাম স্থানীয় কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত ইমাম মুফতি সামশুল ইসলাম সাহেব, কোরআনে হাফিজ একজন ছানি ইমান সহ আমাদের মাদ্রাসায় একাধিত আলেম শিক্ষক আছেন এতসব ইমাম সাহেবদের উপস্থিতির মধ্যেও সৈয়দ মহসীন আলী চাইলেন তিনি নিজেই মোনাজাত পরিচালনা করবেন।
মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি হিসাবে আমি মাইক্রোফন তার হাতে হস্তান্তর করি। মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী একটি চমৎকার মোনাজাত পরিচালনা করেছিলেন, এই মসজিদের নির্মান কাজ সুসমাপ্তির জন্য মহান আল্লাহর রহমত বরকত কামনা করেছিলেন সেক্রেটারি হিসাবে আমি দায়িত্বে আছি বলে একাধিকবার আমার নাম উল্লেখ করে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেছিলেন। নির্মান কাজে তাঁর নিজের পক্ষ থেকে এক লক্ষ টাকা দানও করেছিলেন। তাঁর দান ঘোষনার পর অনেকেই আমাকে বলেছিলেন মন্ত্রী সাহেব ব্যস্ত থাকেন চাঁদার টাকার জন্য আমাকেই দৌড়াতে হবে। কিন্তু চাঁদার টাকার জন্য আমাকে দৌড়াতে হয়নি, তিনি নগদ এক লক্ষ টাকা আমার বাসায় পাঠিয়েছিলেন। আমি আমাদের মসজিদ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম সাহেবকে জানিয়ে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নাহিদ হোসেন মারফত একাউন্টে জমা করিয়ে নেই। মহান আল্লাহর মেহের বানীতে জেলা জামে মসজিদ আংশিকভাবে নির্মান কাজ শেষ হয়েছে। আনুষ্টানিকভাবে শুভ উদ্ভোধন হয়েছে। এমন দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার মসজিদ দেখলে তিনি খুবই খুশী হতেন। মিষ্টি করে তৃপ্তির মুচকি হাসি হাসতেন। সৈয়দ মহসীন আলীর কন্যা আমার ¯েœহের ভ্রাতস্পুত্রী সৈয়দা সানজিদা শারমিন মোবাইল মারফত তার পিতার স্মৃতিচারন মূলক একটি লেখা চাওয়াতে একদিনের নোটিশে এই ক্ষুদ্র স্মৃতি চারন।
একাত্তোরের বীর – রনাঙ্গঁনের প্রিয় সাথী মরহুম সৈয়দ মহসীন আলীর তৃতীয় মৃত্যো বার্ষিকীতে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান মালিক তার বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করছি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট, সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। কবি ও কলামিষ্ট
মন্তব্য করুন