একান্ত সাক্ষাৎকারে মোতাহার হোসেন ‘আজও আমার কাঁধে বঙ্গবন্ধুর গন্ধ পাই’
আউয়াল কালাম বেগ॥ রাজনগরের কিংবদন্তি প্রবীণ রাজনীতিবিদ, বাম রাজনীতির পুরোদা রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন। রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৩৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কামারচাক ইউনিয়নের দক্ষিন করাইয়া গ্রামের মরহুম সুরুজ মিয়ার ঘরকে আলোকিত করে জন্ম গ্রহণ করেন। দীর্ঘসময় আলাপচারিতায় ৮৩ বছর বয়সী এই আলোকিত রাজনীতিবিদের কাছ থেকে জানা গেল তাঁর দীর্ঘ রাজনীতি ও বিপ্লবী জীবনের নানা অজানা তথ্য। অনেক সময় আমরা কোন রাজনীতিক ব্যাক্তির উপর কিছু লিখতে গেলে অমুক বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ তমুক বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ শব্দ লিখে থাকি। বাস্তবে উনার সাথে আলাপ করে দীর্ঘ জীবনে নানা আন্দোলন-বিপ্লবে অংশ গ্রহণমূলক অভিঙ্গতার কথা শুনে বর্ষিয়ান বাক্যটি কোন ব্যাক্তির নামের আগে ব্যবহার প্রযোজ্য জানা গেল। বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ মোতাহার হোসেন ১২ বছর বয়স থেকে তাঁর মাঝে সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত হয়। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের ৬দফা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে ছিল তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। জীবনে অনেক বার একাধিক হামলা, মামলা, জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। দীর্ঘ সময় আলাপচারিতার সারসংক্ষেপ এই লেখায় তুলে ধরতে গিয়ে অনেক তথ্য বাদ পরতে পারে সে জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে মোতাহার হোসেন :
১৯৫১ সালে নয়াবাজার কৃঞ্চচন্দ্র হাই স্কুলের ৬ষ্ট শ্রেনির ছাত্র ছিলেন। তখন তার বয়স ১২ বছর। ঢাকাসহ দেশব্যাপি চলতে থাকে মাতৃভাষা রক্ষার দাবীতে সরকারের বিরোদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পাক পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার। রাজাপুরের আবদুল মন্নান, ফকিরটুলার মখদ্দুস বখত, কামারচাকের মায়া মিয়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্টান পরিদর্শন করে ছাত্রদের সাথে মাতৃভাষা আন্দোলনরত ছাত্র হত্যার ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেন। এলাকার সিনিয়র ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে ঢাকার ছাত্র হত্যার ঘটনার সংবাদ জেনে মোতাহার হোসেন সহযোগীদের নিয়ে তারাপাশা এম ই স্কুল থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, শহীদের রক্ত বৃথা দিতে দিবনা এসব স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাজনগরে আসেন। ভাষা আন্দোলনে জনগনকে সংগঠিত করতে মিছিল-মিটিং-সভা-সমাবেশ করেন। তিনি বলেন আমি যখন হাই স্কুলের ৬ষ্ট শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম আমার সাথে ছিলেন কাউকাপনের হাসেন রাজা চৌধুরী। ১৯৫৪ সালে জেল খেকে মুক্তি পেয়ে কুলাউড়ার সৈয়দ আকমল হোসেন, সমসেরনগরের কমরেড মফিজ আলি, পৃত্রিমপাশার আলী সফদর খান রাজা সাহেব আমাদের বিদ্যালয়ে এসে আমাদের সাথে বৈঠক করে প্রগতিসীল ছাত্রদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কমিটি করেন। এই সংগঠনের নাম দেয়া হয় ’প্রগতি না সীমাহীন পথে” এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কুতব উদ্দিন, মোঃ ইলিয়াছ, মুশফিকুর রহমান, টনু মিয়া, আব্দুল মছব্বির ও কৃঞ্চা দেবীসহ কয়েকজন ছাত্রী (এদের কেউ বেঁচে নেই)। এবং সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সংগঠনের লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের মগজ ধলাই করেন।
ষাটের দশকে ১৯৫৪ সালে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন মোতাহার হোসেন, তখন রাজনগরে বিপ্লবী সংগঠনের সাংগঠনিক অবস্থা ভাল ছিল না। কুলাউড়ায় ভারতের কৈলাশহরের কিছু লোক বিপ্লবী রাজনীতি করতেন। তাদের হাত ধরে বিপ্লবী রাজনীতির সাথে যুক্ত হই। ১৯৫৪ সালে ঘড়গাঁও মাদ্রাসা মাঠে যুক্তফ্রন্ট একটি জনসভা করে। ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজার সরকারী কলেজে ইন্টার ১ম বর্ষের ২য় ব্যাচের ছাত্র ছিলাম তখন থেকে রাজনীতির চর্চা করি। দুই চার জন মেয়ে সহ হাতে গুনা কয়েকজন রাজনীতি করতাম আর কেউ রাজনীতির নাম নিতেন না। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হয়। নিষিদ্ধ করা হয় রাজনীতি। আমরা বসে থাকিনি। শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে গোপনে বৈঠক করে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করি। আওয়ামী লীগ করতেননা মোতাহার হোসেন। তিনি মনে করেন, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের স্বচ্ছ কোন জ্ঞানই নেই। অথচ আওয়ামী লীগ এগুলো সমর্থন করত। সারা পৃথিবীতে সর্বহারাদের নেতৃতে শাসন হলে, দেশে দেশে সসস্ত্র বিপ্লব হবে। পাকিস্তান-হিন্দুস্তান জিন্দাবাদের রাজনীতি করে লাভ নাই। সে কারনে ৬দফার রাজনীতিকে তুচ্ছ মনে করতেন।
মোতাহার হোসেন বলেন, মৌলভীবাজার সরকারী কলেজের প্রফেসর সাবিত্রী গুপ্তা। উনার খুবই ভক্ত ছিলাম আমি। উনি আমাকে স্নেহ করতেন। উনার বিবাহ ঠিক হয় শিলং। আমরা যারা রাজনীতি করতাম দাওয়াত করলেন এই বিয়েতে। আমি এক সহপাঠিকে নিয়ে উনার বিয়েতে যাই। এই বিয়েতে নুর পারভিন নামে এক মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক হয়। তার বাড়ি আসামের নয়াগাঁও জেলায়। লেখা পড়া করে শিলং। পরিচয় হয় আরও অনেকের সাথে। তারাও নকশালপন্থী সিপিআই্এমএল রাজনীতি করতেন তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল তাদের রাজনীতি আর আমাদের রাজনীতি সাথে আদর্শগত মিল আছে। যে কারণে তাদের সাথে রাজনীতিক সর্ম্পক আরও গভীর হয়। নকশাল বাড়ি থেকে রাজনীতির শিক্ষা নিয়ে তারা আমাদের রাজনীতির চেয়ে বহু উর্ধ্বে। আমি শিক্ষা নিতে নকশাল বাড়ির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কৈলাশহর গ্রামের মনিপুরী পরিবারের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা। তারাও নকশালপন্থী রাজনীতি করতেন। তাদের সাথে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্ক হয়। তাদের মাধ্যমে আসাম প্রদেশের নয়াগাঁও যাই। সেখানে নকশাল পন্থীদের সাথে গোপনে বৈঠক করি। নকশাল বাড়ি যেতে হলে আমার চোঁখ বাধা হবে বলে শর্ত দেয়। কারন সিপিআইএমএল নকশালবাদী রাজনীতির প্রথা হল নতুন কেউ ওই যায়গায় যেতে হলে চোঁখ বাঁধা হয়। আমি তাদের শর্তে রাজি হই। নকশালদের সাথে রওয়ানা দেই নকশাল বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিছু দুর যেতেই পাহাড়িয়া সড়কে শর্ত মত ঁেচাখ দুটি বেঁেধ আমাকে জীপে তুলা হয়। ভারতের পশ্চিম বাংলায় একটি থানার নাম নকশাল বাড়ি।
সিলং থেকে দেশে আসার পথে তামাবিল সীমান্ত থেকে ভারতীয় পুলিশ গ্রেফতার করে শিলং নিয়ে যায়। তখন ১৯৬১ সাল। পুলিশ আমাকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেফতার দেখায়। আমাকে একটি থানায় রাখা হয়। সেখানে এক পরিচিত পুলিশকে ডেকে এনে কানে কানে বলি আমার এক মামা ও সাবিত্রী গুপ্তার স্বামী আকাশ চৌধুরীকে একটা খবর দেও। সাবিত্রী গুপ্তার পরিচিত একজন উকিল আমার মামার বন্ধু। তিনি শিলং জজ কোটের উকিল। খবর পেয়ে আকাশ চৌধুরী এসে থানা হাজতে আমার সাথে দেখা করেন এবং আমাকে পরামর্শ দেন যে, আমি বাড়ি থেকে অভিমান করে এই জায়গায় এসেছি, পরে আমি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হই এমন কথা প্রশাসনের উর্ধ্বতন অফিসারকে বলার জন্য। তারাও ডিসির কাছে আমার জন্য সুপারিশ করে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনেন। বডার গার্ড আমাকে তামাবিল হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে দেয়।
মোতাহার হোসেন আরো বলেন, নকশালীরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করত। আমিও নকশালী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ভিতরে ভিতরে আমার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রেরণা ছিল যদিও আমি আওয়ামীলীগের রাজনীতি করতামনা। ১৯৬৯ সালে নকশালীদের জানিয়ে দেই, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে আমার প্রেরণার কথা। তারা অনুমতি দিয়ে বলেন, দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ বাঁধলে বা দেশের স্বার্থে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করতে পারেন। আমরা বাধাঁ দিবনা।
মোতাহার হোসেন বলেন, ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়। রাজনগর থেকে আওয়ামী লীগের একজন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করার মত কোনো আওয়ামী লীগ নেতা পাওয়া যায়নি। তখন আওয়ামী লীগের নাম নিয়ে রাজনীতি করার সাহস ছিল না। ঘরগাঁও গ্রামের মরহুম বারি মিয়া আওয়ামী লীগ করতেন। কিছু করতে পারেননি। করার মত তার পিছনে কোনো মানুষ ছিলনা। তিনি বলেন, যদিও আমি আওয়ামী লীগ করতাম না কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। তারা আমাকে বলেন, আমি একজন প্রার্থী দেয়ার জন্য। আমি মশাজান গ্রামের আবু তাহির আহমদের নাম প্রস্তাব করি। তিনি তখনকার সময় সিলেটের বিখ্যাত তাহির ট্রেভেলস এর মালিক। পরে এক সময় তাহির আহমদ নির্বাচন করতে অপারগতা প্রকাশ করলে তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয় মুসলিমলীগ (ফাতেমা জিন্নাহ) থেকে আসা তোয়াবুর রহিমকে। আমিই একমাত্র ব্যাক্তি ছাত্র-যুবক-সাধারণ মানুষকে ডেকে তোয়াবুর রহিমকে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা করি। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশ্যে সিলেট সফরে আসেন। টেংরা বাজারে সংক্ষিপ্ত পথ সভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান। সে সভায় মাইকে উপস্থাপনা করেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের বর্তমান এমপি সৈয়দা জহুরা আলাউদ্দিনের স্বামী আলাউদ্দিন বুলবুলি। বঙ্গবন্ধুর টেংরা বাজার সফরকে সফল করতে সকল ব্যবস্থাপনা আমাকে করতে হয়েছে। মোতাহার হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর টেংরাবাজার পথসভাস্থলে বাঁশের স্টেইজে উঠার সময় বঙ্গবন্ধুর বাম হাত দিয়ে আমার কাঁেধ উপর ভর দিয়ে স্টেইজের উপর যান, আবার স্টেইজ থেকে নেমে আসার সময়ও আমার কাঁধের উপর ভর করে নেমে পড়েন । আমি আজও আমার কাঁধে বঙ্গবন্ধুর গন্ধ পাই।
স্বাধীনতার যুদ্ধে মোতাহার হোসেন :
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহীনির হত্যাকান্ডের ঘটনা শোনার পর ২৬ মার্চ নিরাপত্তা জণিত কারনে টেংরা বাজার বাসা ছেড়ে দক্ষিন করাইয়ায় আমার গ্রামের বাড়ি চলে যাই। ২৭ মার্চ পাঞ্জাবী মিলিটারীরা আমার বাসায় হানা দেয় এবং আমাকে খোঁজতে থাকে। ২৯ মার্চ ভারতের কৈলাশহর চলে যাই। রাজা সাহেবের সাথে দেখা হয়। সেখানে মুজিববাহিনীতে যোগ দেই। এপ্রিল মাসে ট্রেনিং শুরু হয়। এ ট্রেনিংয়ে আমার টিমে ২০ জন ও গ্রেটার সিলেটসহ অন্যান্য এলাকার আরও দুই/আড়াইশ জন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করি। পাহাড়ের পাদদেশে গহীন জঙ্গলে এমন কঠিন গেরিলা ট্রেনিয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। খেয়ে না খেয়ে জীবন বাজি করে ট্রেনিংয়ে সফল হই। ভারতীয় আর্মি অফিসার আমাদের সিইনসি স্পেশাল ফ্রিডম ফাইটারের উপাধি দেন। ভারতীয় মেজর আমাকে ট্রেনিং কমান্ডার মনোনীত করেন।
মে মাসে মফিজ আলী আমি সহ মাত্র আটজন মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা যুদ্ধ করি। চাতলাপুর মূর্তিছড়া, কৈলাশহর, কমরপুর, আলীনগর, সুনছড়া, পাকিস্তান সেনা ঘাটিতে তিন শতাধিক পাকসেনাদের সাথে আটজন মুক্তিযোদ্ধ নিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আশ্রয় নেই চাকমা সম্প্রদায়ের এক বাড়িতে ওই বাড়ির বৃদ্ধ লোক আমার দাদার বন্ধু ছিলেন। আমার বয়স যখন ৩/৪ তখন ওই বৃদ্ধ চাকমা ব্যাক্তি আমার দাদার কাছে আসা-যাওয়া করতেন। তিনি আমাকে চিনতে পেরে খুবই আনন্দিত হন। তারা আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করে , পেট ভরে খাবার দেয়। তাদের অবদান ভুলার নয়। মোতাহার হোসেন বলেন, হাজার হাজার পাবলিক মুক্তিবাহিনীতে ট্রেনিং নিয়েছেন যুদ্ধ করেছেন শতে দুই/একজন। বাকী মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করতে সাহস করেনি। তারা বিভিন্ন অজুহাতে আত্মীয়র বাড়িতে পালিয়ে বেড়াতেন। বিএলএফ ট্রেনিংপ্রাপ্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধা বর্ডারের ধারে কাছে আসতেন না। আবার অনেকে ট্রেনিং না নিয়েও উৎসাহী হয়ে যুদ্ধ করেছেন। আমি বর্ডারে যুদ্ধ করেছি। নভেম্বর মাসে শমসেরনগর ঘাটিতে পাঞ্জাবীদের উপর আক্রমণ করি। কার্টাপ পাটির হয়ে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে লুকিয়ে থেকে শমসেরনগর মৌলভীবাজার রোডে গেরিলা যুদ্ধ করি। টিলার উপর এলএমজি নিয়ে পাঞ্জাবীদের সাথে সম্মুখ গুলাগুলি হয়। তখন আমাকে টার্গেট করে তিনটি বোমা ফেলে। আমিও পাল্টা গুলি করি। কৌশল বদল করে সেখান থেকে সড়ে পড়ি। ওই জায়গায় আরেকটি বোমা পরে। এখান থেকে না সড়লে বোমা আমার উপর পড়ত। অল্পের জন্য বেঁচে যাই। অসংখ্য গেরিলা যুদ্ধ করি। তাছাড়া আলীনগর, সুনছড়া, কামারছড়া, ছাতলা পুর ফাড়িবাগান, জুড়ির লাটি টিলা, ফুলতলার বর্ডার, মুরির ছড়া, পাঞ্জাবীদের উপর আক্রমণ করি। সেখান থেকে পাঞ্জাবীরা পালিয়ে যায়। কামারছড়া স্থল যুদ্ধে ১১জন পাকসেনাকে আমরা হত্যা করি।
স্বাধীনতার ঘোষনা সম্পর্কে মোতাহার হোসেন বলেন :
চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার থেকে ”আমি মেজর জিয়া বলছি’ আই ডিগলেয়ার দি ইন্ডিপেনডেড অব বাংলাদেশ” কথা বলার সাথে সাথে বেতারে বসে থাকা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুই নেতা ভুল তথ্য বলছেন বলে জিয়াকে বসিয়ে দেন। এ ঘোষনা অস্ট্রেলিয়া রেডিও কয়েকবার প্রচার করে। ঘোষণা পত্র সংশোধন করে পুনরায় জিয়া ঘোষনা করেন ”আমি মেজর জিয়া বলছি, অন বি হাফ অফ আওয়ার গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান, আই ডিক্লেয়ার দ্যা ইন্ডিপেনডেড অব বাংলাদেশ। এই কথাটি জিয়ার কন্ঠে বার বার বিভিন্ন বেতারে প্রচারিত হয়। আকাশ বাণী রেডিওতে নিজের কানে শুনেছেন মোতাহার হোসেন।
মোতাহার হোসেন বলেন, মে মাসের শেষ দিকে ধর্মনগর ডাকবাংলোয় আতাউল গনি ওসমানী সফরে আসেন। মাইক হাতে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনীর কমান্ডার অফ ইনচাজর্, আমার বাড়ি সিলেটে কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো আমি আজ পর্যন্ত জানিনা এই এরিয়ায় কি পরিমান পাঞ্জাবী মিলিটারী আছে, কতটা ক্যাম্প আছে, পাঞ্জাবীদের হাতে কি পরিমাণ অস্ত্র আছে। সে হিসাব আমাকে আজও জানানো হয়নি। এ কথা শুনে সকলে চুপসে যান। তখন আমি দাঁড়িয়ে বলি যে আপনি কি চান, আমাকে বলেন, আমি সংগ্রহ করে দিব, তখন তিনি বলেন আমার সাথে ডাকবাংলোয় দেখা করিও, আমি উনার সাথে দেখা করি আমারে সাথে ফরিদ বেগও ছিল। দায়িত্ব গ্রহন করি হিসাব দেয়ার। আমি ও ফরিদ বেগ ছদ্মবেশ ধারণ করে মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, সালুটিকর, বিমান বন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঞ্জাবী ঘাটিতে গিয়ে সৈন্যের পরিমান, কতটি ক্যাম্প নানান তথ্য সংগ্রহ করে ওসমানীর কাছে দিয়েছি। ডিসেম্বর প্রথমে আমার পাশের গ্রাম মশাজানের নজব মাষ্টার ও আওয়ামী লীগ কর্মী ফটিকের বাড়িতে কিছু রাজাকার লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে। আমার (মোতাহার হোসেন) নেতেৃত্বে মুক্তিবাহিনী আগমনের খবর পেলে রাজাকাররা পালিয়ে যায়।
মোতাহার হোসেন বলেন ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের জন্ম হয়। ১৯৭৪ সালে আমি জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হই। এবং জাতীয় শ্রমিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি নির্বচিত হই। এরশাদ বিরোধী আন্দলোনে আগ্রনী ভ’মিকা ছিল মোতাহার হোসেনের। তখনকার সময় সারা দেশের শ্রমিক নেতাদের ঢাকায় মহাসমাবেশ অনুষ্টিত হয়। সমাবেশে শ্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চুরান্তরুপ নিতে সিদ্ধান্ত হয়। মোতাহার হোসেনের নেতৃত্বে চট্রগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ জেলায় শ্রমিক ফ্রন্টের সমাবেশ হয়।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহন করতে আমাকে সহযোগীতা করেছেন এম খছরু চৌধুরী।
লেখক : আউয়াল কালাম বেগ, সভাপতি, রাজনগর প্রেসক্লাব।
মন্তব্য করুন