এবার সবজি নেই, ধানও নেই খাব কি মনু আর ধলাই আমাদের সর্বস্বান্ত করল

May 4, 2017,

ইমাদ উদ দীন॥ ওই দুই রাক্ষুসি আমাদের সব গিলে খেয়েছে। হঠাৎ উত্তাল হয়ে আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। একবার নয়। দুবারও নয়। এবছর গেল দু’মাসের মধ্যে এ পর্যন্ত পাঁচবার তাদের ভয়ঙ্কর রুপ দেখিয়ে আমাদের সর্বস্বান্ত করেছে। এখন নিজে চলব কি ভাবে। আর সংসার চালাব কি করে। ধলাই নদীর তীরবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার ইউনিয়নের বাদে করিম পুর,করিমপুর,জালালপুর,বাসুদেব পুর,সুরানন্দপুর,মইর আইলপুর,রুপেসপুর, রামকৃষ্ণপুর, রামচন্দ্রপুর ও উবাহাটা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত সবজি ও বোরো ধান চাষীরা এখন এমন দুশ্চিন্তায়। তাদের মত ক্ষতিগ্রস্ত একই উপজেলার পতনঊষার ইউনিয়নের ১০-১৫টি গ্রাম ও পৌরসভা এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। কারন ওই এলাকায় কয়েকটি স্থানে ধলাই নদীর বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারের পানিতে সব ভাসিয়ে নিয়েছে। একই অবস্থা মনু নদীরও। তিন উপজেলার কয়েকটি স্থানে ভাঙ্গন ও ছোট বড় প্রায় ৩৫ টি স্থানে ভাঙ্গনের ঝুঁকির কারনে ক্ষতিগ্রস্থ ও হুমকির মুখে পড়েছেন নদী তীরের কয়েক হাজার স্থানীয় লোকজন। ভারী বৃষ্টি আর উজান থেকে আসা পাহাড়ী ঢলের পানি নাব্যতা হ্রাসের কারনে ধারন ক্ষমতা না থাকায় নদী দুটির পাড় ভেঙ্গে পানি হানা দেয় তীরবর্তী গ্রাম গুলোতে। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান অনেকটা জোয়ার ভাটার মত ওই পানি আটকে থাকেনা বেশি দিন। ১-২ দিনের মধ্যেই নেমে যায় নদী ফুলে ফেঁপে উঠা পানি। কিন্তু ওই পানি নেমে গেলেও পানির সাথে আসা পলি মাটিতে সবজি আর ধান ক্ষেতের ঘটে সলিল সমাধি। নদী দু’টির দূ’কূলের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে গ্রামের পর গ্রাম,বাড়ি-ঘর আর ক্ষেত খামার ডুবিয়ে বার বার স্থানীয় বাসিন্ধাদের সর্বস্বান্ত করলেও রহস্যজনক কারনে হয়না ওই ভাঙ্গা বাঁধের মেরামত। বছরের পর বছর বাধঁ গুলো থাকে যেই সেই। শুধু বর্ষা মৌসুম এলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুরু হয় হৈই চৈই। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এমন অভিযোগ স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের। তারা জানালেন পানি উন্নয়ন বোর্ড,স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা আর জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাসের ফুলঝুরিই যেন শান্তনা পুরুষ্কার। জানা গেল মনু আর ধলাই। এক সময় দুটিই ছিল জেলার খরস্্েরাতা নদী। ওই নদী দ’ুটিরই উৎপত্তিস্থল ভারত। দু’পাশে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়ী টিলায় বেষ্টিত নদী দু’টি বয়ে গেছে জেলার কুলাউড়া,কমলগঞ্জ, রাজনগর ও মৌলভীবাজার উপজেলার উপর দিয়ে। নানা কারনসহ এখন নাব্যতা হ্রাসে নদী দু’টির ঐতিহ্য নেই বললেই চলে। বর্ষা মৌসুমে নদীতে হাঁটু পানি,কোমর পানি আর শুকনো মৌসুমে নদী জুড়ে ধূ ধূ বালুচর। গতকাল সরজমিনে নদী ভাঙ্গনের ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় গেলে বাদে করিম পুর গ্রামের নানু মিয়া (৫৫),মিজান উদ্দিন (৪০), ইমান উল্লাহ (৭০),সুরান্দ গ্রামের আব্দুল কাদির(৫৬),কোনাগাঁও গ্রামের আরজদ মিয়া(৪৫),চাম্পা বেগম (৪৮),কদরুন নেছা (৫০) সহ সবজি চাষীরা জনান আমাদের এলাকা শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন রবিশস্য চাষের জন্য বিখ্যাত। জেলার মধ্যে রবিশস্যের ভান্ডার হিসেবে খ্যাত কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া অঞ্চল। কিন্তু আমাদের এই ঐতিহ্য আর ধরে রাখতে পারছিনা এই দু’নদীর কারনে। সংশ্লিষ্টরা নদী শাসনের উদ্দ্যোগী না হওয়ায় প্রতিবছর কয়েকবার নদীর দুকূলের বাধঁ ভেঙ্গে তীরবর্তী গ্রাম গুলোর সবই কেড়ে নেয়। এবছরও সংসারের লোকজন নিয়ে খাওয়া বাচাঁর মত কোন সবজি কিংবা বোরো ধান অবশিষ্ট রাখেনি বাঁধ ভাঙ্গা ওই দু’নদীর পানি। বাদে করিমপুর গ্রামের চাষী হারুন মিয়া ও তার স্ত্রী ছালেখা বেগম জানান একটি এনজিও সংস্থা থেকে থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তারা ৩ বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ করেছিলেন। কিন্তু এপর্যন্ত পাচঁবারই তাদের ক্ষেত নষ্ট করে বাঁধ ভাঙ্গা নদীর পানি। এখন ১০ জনের সংসার চলবে কিভাবে আর সপ্তাহে ৬৫০টাকা হারে ঋণের কিস্তি দিব কি দিয়ে। বাসুদেব পুরের সবজি চাষী বাবুল চন্দ, প্রণয় চন্দ ও সুরানন্দ পুরের সুনু মিয়া বলেন আমার ৩ বিঘা জমি গ্রাস করেছে ধলার নদীর বাঁধ ভাঙ্গা পানি। মাত্র দু’ থেকে ওই পানি চলে গেছে। কিন্তু পলি মাটি দিয়ে সব সবাজি আর ধান কবর দিয়ে গেছে। এখন সবজি গাছ গুলোরও চিহ্নি দেখা যায় না। ১৫-২০ হাজার টাকা ঋণ ধার করে ওই সবজি চাষ করেছিলাম এখন আমার সব শেষ। এখন ঋণ দিব কি করে। আর খাব কি বেঁচে। তাদের মত দু’নদীর তীরবর্তী গ্রামের কয়েক হাজার চাষী হেক্টরের পর হেক্টর জমি চাষ করেছিলেন মিষ্টি কুমড়া, লাউ, জালিকুমড়া, দেঢ়শ, মুকি,বরবটি, লালশাক,নালি শাক,ঝিঙ্গা, পুঁইশাক,করলা,চিংিগা,পইঠা,ডাটা শাকসহ নানা জাতের গ্রীষ্মকালিন সবজি। ফলনও হয়েছিল ভালো কিন্তু এখন কিছুই নেই। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সুত্রে জানা যায় এবছর পাহাড়ী ঢল ও আগাম বন্যায় জেলায় আংশিক ও সম্পূর্ণ মিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৭ হাজার ৪শ ৩২ হেক্টর বোরো ধানের জমি। আর সবজি ৮০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে কমলগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৪শ হেক্টর বোরো আর সবজি ৫০ হেক্টর। আর কুলাউড়ায় ৪ হাজার ৫শ হেক্টর বোরো আর সবজি ৩০ হেক্টর। তবে জেলা প্রশাসন কার্যালয় সুত্রে জানা যায় এই ক্ষয়ক্ষতি প্রতিদিনই হালনাগাদ করা হচ্ছে। মুন্সিবাজার ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো: নওরুজ বলেন বার বার নদীর বাঁধ ভাঙ্গা স্থান দিয়ে গ্রামগুলোতে পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও এখন মেরামত করা হয়নি। ওই স্থান গুলো মেরামত না করায় নতুন করে এর আশপাশ এলাকায়ও ভাঙ্গনের সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারী তরফে প্রাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা পর্যাপ্ত নয় বলে তিনি অভিযোগ করেন। কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় আওমীলীগের সদস্য অধ্যাপক মো: রফিকুর রহমান বলেন জেলার শস্য ভান্ডার হিসেবে এই উপজেলার খ্যাতি। কিন্তু নদী ভাঙ্গনে তীরবর্তী গ্রাম গুলোতে এখন আর সবজি চাষের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছেন না চাষীরা। খর¯্রােতা ধলাই ও মনু ভরাট হয়ে যাওয়াতে এখন বর্ষার সময় নদী তীরের একাধীক স্থানে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। এখন পানি উন্নয়ন বোর্ড যদি উদ্দ্যোগী না হন তাহলে সবজি ক্ষেতের পাশাপাশি তীরবর্তী গ্রামগুলোই বিলিন হয়ে যাবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলো পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এখনই ভেঙ্গে যাওয়া বাধঁ গুলো মেরামতের প্রয়োজন। তবে আশা করছি পানি কমতে শুরু করলে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন জেলার সবকটি নদীর তীরবর্তী মানুষের ক্ষতি এড়াতে আর নদী বাঁচাতে ডেজিং আর দীর্ঘস্থায়ী বাঁধ নির্মাণেরও প্রয়োজন।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com