এসএসসি রেজাল্ট, ক্লাস ও পরীক্ষা
সায়েক আহমদ॥ অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০২০ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হচ্ছে। ৩১ মে, রবিবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনা ভাইরাসের কারণে অশ্চিয়তার মুখে পড়েছিল এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের কার্যক্রমটি। ফলে সারাদেশের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার পরীক্ষার্থীবৃন্দ ও তাদের অভিভাবকগণ হতাশায় দিনযাপন করছিলেন। তবে করোনাকালীন বন্ধের ভেতরেও শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ বিরাট দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এ ফলাফল প্রকাশের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছেন। দুপুর ১২টায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে ফলাফলের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরবেন।
করোনা পরিস্থিতিতে এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ফল জানার সুযোগ নেই। এ কারণে ওয়েবসাইটসহ প্রযুক্তির অন্যান্য পদ্ধতির পাশাপাশি আরও সহজে যাতে শিক্ষার্থীরা রেজাল্ট পায়, সেই ব্যবস্থা করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। এই ব্যবস্থায় যেসব পরীক্ষার্থী নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রাক্-নিবন্ধন করেছে, তাদের মোবাইল ফোনে ফলাফল প্রকাশের দিনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেজাল্ট জানিয়ে দেয়া হবে। প্রায় ১২ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী প্রাক্-নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ২০ লাখ। জানা গেছে, পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যারা প্রাক-নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে তাদের নির্ধারিত মোবাইল নম্বরে আগে আগেই খুদে বার্তা পাঠিয়ে রেজাল্ট জানিয়ে দেওয়া হবে। তবে প্রাক-নিবন্ধনের আওতার বাইরেও রয়েছে প্রায় সাড়ে আট লাখ পরীক্ষার্থী। এরা পূর্বের মত এসএমএস পদ্ধতিতে কিংবা শিক্ষাবোর্ডসমূহের ওয়েবসাইটসমূহ ভিজিট করেও ফলাফল জানতে পারবে। এছাড়া ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে স্বতপ্রণোদিতভাবে ফলাফল জানিয়ে দেয়ার সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হবে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ থেকে। দৈনিক শিক্ষার একটি লাইভ প্রোগ্রাম থেকে জানা গেছে, এবারই প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানপ্রধানগণ নির্ধারিত সময়ে ফলাফল জানতে পারবেন না। তারা ০১.৬.২০২০ ইং, সোমবার বেলা ১২টার পর ফলাফল জানতে পারবেন। এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার পরীক্ষার্থীবৃন্দ এবং তাদের অভিভাবকগণ যাতে ফলাফলের দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ভীড় জমাতে না পারেন সে কারণে নাকি এ ধরণের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
ওদিকে ৩১.৫.২০২০ ইং হতে সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলো সীমিত আকারে খুলবে। তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত দেশের স্কুল-কলেজসমূহ খুলবে না। জানা গেছে, আপাতত জুন মাসে স্কুল-কলেজসমূহ খোলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ কারণে মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হবে না। উল্লেখ্য, জুন মাসেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হয়নি। পাশাপাশি দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষাও সামনে চলে এসেছে। এ কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা দুটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ইতোপূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বর মাসের আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খোলার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, যদি এর পূর্বে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হয়, তবেই সেপ্টেম্বর মাসের আগে হয়ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খোলার চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। তবে দিন দিন যে হারে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, এমতাবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খোলার চিন্তা ভাবনা না করাটাই যুক্তিসঙ্গত। অভিভাবকরা জানিয়েছেন, এক বছর পড়াশোনা না করলে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে ঠিকই, কিন্তু মূর্খ তো আর হবে না। অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ করোনা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আয়ত্ত্বে না আসার আগেই খুলে দিলে তাদের সোনামনিরা লাশ হয়েই বাড়িতে ফিরবে। এ কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খোলার ব্যাপারে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তারা তাদের সন্তানদেরকে মোটেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাবেন না। জানা গেছে, স্থগিত হয়ে থাকা উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষাও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শুরু হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অফিসের কাজকর্ম সীমিত আকারে শুরু হতে চললেও ক্লাস-পরীক্ষা আপাতত বন্ধই থাকবে।
দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে। এর মধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলো ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত সীমিত আকারে খুলে দেয়া হবে। তবে এই সময় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকবে। এমন অবস্থায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রশ্ন, তাহলে কি ১৫ জুনের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়া হবে। তবে বিভিন্ন মাধ্যম এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে জুন মাসেও স্কুল-কলেজ খোলার সম্ভাবনা নেই।
বর্তমানে সারা দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের মোট ২০ হাজার ৬৬০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই স্তরে মোট ১ কোটি ৩৪ লাখের মতো শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা দেখভাল করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, যা সংক্ষেপে ‘মাউশি’ নামে পরিচিত। ‘মাউশি’ মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক জানিয়েছেন এখনো স্কুল-কলেজ খোলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় জুনে অনুষ্ঠেয় অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা ছাড়া উপায় নেই।
সারা দেশে সর্বমোট ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়. কিন্ডারগার্টেন স্কুল , এনজিও পরিচালিত স্কুলসহ বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ আছে। এগুলোতে মোট পৌনে ২ কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে । শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী প্রাথমিকে গত ১৫ এপ্রিল থেকে ২৩ এপ্রিলের মধ্যে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। সেটি তো হয়ইনি বরং আগামীতে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা হওয়ারও সম্ভাবনা নেই।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ জানান, বিদ্যালয় না খুললে পরীক্ষা হবে কীভাবে? তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে টিভিতে ক্লাস হচ্ছে। অনেক জায়গায় শিক্ষকেরা নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে প্রশ্ন পাঠিয়ে মূল্যায়ন করছেন। তবে এটা বাধ্যতামূলক করা হবে না। কারণ, এভাবে জাতীয়ভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।
আরেকটি বৃহৎ পাবলিক পরীক্ষা অর্থাৎ এইচএসসি পরীক্ষা গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু হবার কথা ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে থাকায় গত মার্চ মাসেই এই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ফলে ১৩ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এই পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু হবে না। তবে বিভিন্ন মাধ্যম হতে জানা গেছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমে দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার দু সপ্তাহ পরে এ পরীক্ষাটি শুরু হবে। কাজেই কবে নাগাদ এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হবে তা বলাটা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
দেশ আজ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। কাজেই পরীক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষকবৃন্দকে ধৈর্য্যরে সাথে অপেক্ষা করতেই হবে। তবে অভিভাবকরা জানিয়েছেন, সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রায় ঘরে ঘরেই মোবাইল ফোন পৌঁছে গেছে। শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তারা অনলাইনে চ্যাট, ফেসবুকে পদচারণা, গেমের মধ্যে ডুবে যাওয়া সহ বিভিন্ন কাজে অযথা সময় নষ্ট করছে। এ ব্যাপারে অভিভাবকগণ নিজ নিজ সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তাই তারা সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, শিক্ষকবৃন্দরা যাতে নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী অনলাইনে বেশি বেশি করে ক্লাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং শিক্ষার্থীদেরকে বেশি বেশি করে হোমওয়ার্ক প্রদান করেন। সংসদ টিভিতে প্রচারিত ক্লাসসমূহ অনেক সময় শিক্ষার্থীরা দেখতে অনীহা প্রকাশ করে। এ কারণে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ পরিচালিত লাইভ ক্লাসসমূহ এ ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। এ ব্যাপারে সরকার এবং নীতিনির্ধারকগণ নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে পারেন।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন