এস.এস.সি ও দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কৃতি শিক্ষার্থী এবং স্পন্দন সামাজিক সংগঠনকে অভিনন্দন
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ ২০১৮ সালের এস.এস.সি ও দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কৃতি শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন। অভিনন্দন স্পন্দন সামাজিক সংগঠনকেও। অভিনন্দন এই জন্য যে, স্পন্দন সামাজিক সংগঠন এস.এস. সি ও দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা প্রদান করে একটি অসাধারণ কাজ করেছে। সংগঠন এর এই উদ্যোগটি অত্যন্ত মহৎ। আসলে সামাজিক সংগঠনের মূল কাজই হলো সামাজিক উন্নয়নে কাজ করা। কিন্তু সব সংগঠনের সব সময় করা সম্ভব হয় না। ভালো কাজকে যদি আমরা উৎসাহিত না করি তাহলে সমাজের জন্য আরও ভালো কাজ করতে অন্যরা প্রনোদনা পাবেনা। মৌলভীবাজারের সামাজিক সংগঠন স্পন্দন নতুন হলেও তাদের কার্যক্রম প্রশংসনীয়। যারা ভাল তাদের উৎসাহিত করা এবং যারা খারাপ তারা যেন খারাপ কাজ না করে সেই ব্যবস্থা গ্রহন করা। এটি হলো বিশ্বের সব সভ্য সমাজের অগ্রগতির মূলসূত্র।
বাংলাদেশের মানুষ আজ বিশ্বে নতুন একটা অবস্থান তৈরী করছে। এ অবস্থান মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলার। এজন্য মেধা বিকাশের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। স্পন্দন সামাজিক সংগঠন এর এ উদ্যোগে আমাদের প্রিয় মৌলভীবাজার এর শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশে ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমরা অনেকেই জিপিএ ৫ পেয়েছ আবার কেউ কেউ জিপিএ ৫ পাওনি সকলে জিপিএ ৫ না পেলেও তোমরা সবাই কৃতি শিক্ষার্থী, তোমরা মেধাবী, তোমরা অসাধারণ। ধারাবাহিক সাফল্য অর্জনের জন্য তোমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, স্বপ্ন দেখতে হবে। ভোরের আলো যেমন অন্ধকার দূর করে ঠিক তেমনি মেধাবীরাও আমাদের সমাজ ও দেশকে আলোকিত করেন। মেধা এমন একটি সম্পদ যার কোনো মরন নেই। এটি এমন একটি অস্ত্র যার আঘাত প্রতিহত করার ক্ষমতা কারো নেই। এটা দেশ জাতি ও বিশ্বের সম্পদ।
প্রিয় শিক্ষার্থীরা তোমরা এখন স্বপ্ন দেখ পছন্দের বিষয়ে তোমরা পড়বে, ভাল এবং নামীদামী কলেজে তোমরা ভর্তি হবে, বিশেষ পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে না পারলে মন খারাপ করা যাবেনা। মনে রাখতে হবে জীবন কখনো থেমে থাকেনা, জীবন সময়ের মতোই অস্থির। আর সেখানেই জীবনের সৌন্দর্য। আমরা যা করব, যা পড়ব, যে বিষয়ে পড়ব, সবকিছুই আনন্দ সহকারে করব। এরিস্টটল বলেছেন ÒPleasure in the job put perfection in the work.Ó সক্রেটিস বলেছেন ÒUnexamined life is not worth livingÓ অর্থাৎ চ্যালেঞ্জহীন জীবন অর্থহীন। সুতরাং পছন্দের বিষয়ে পড়তে না পারাটা জীবনের সমাপ্তি হতে পারে না। বরং এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে জীবনটাকে নতুন উদ্যমে শুরু করে ধারাবাহিক সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করা দরকার। মা বাবা এবং অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে মানুষের মনের চাহিদা এবং বাস্তবিক জগতের প্রয়োজন সব সময় এক ও অভিন্ন হয় না। তোমরা অবশ্যই মনে রেখ জীবনকে ভারসাম্য বজায় রেখে চালাতে হয়। আইনস্টাইন বলেছেন জীবন হলো বাইসাইকেলের মতো সব সময় ভারসাম্য বজায় রেখেই চালাতে হয় তা না হলে তুমি পড়ে যাবে। হাল ছেড়ে দিয়ো না। প্রিয় মেধাবী শিক্ষার্থীরা তোমাদের আর একটি বিষয় মনে রাখতে হবে জীবনের সঙ্গে পরীক্ষার ফলের মিল কিন্তু খুবই কম। পরীক্ষায় ভালো ফল তোমাকে কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দেবে, ভালো চাকরিও পাবে হয়তো তার মানে এই নয়, কেবল ভালো ছাত্ররাই জীবনে ভালো করে। অর্থাৎ জীবনকে সর্বাবস্থায় উপভোগ করতে হবে।
বাংলাদেশ অনন্ত সম্ভাবনাময় দেশ। দেশের প্রায় সাড়ে চার কোটি ছাত্র/ছাত্রী দেশের জন্য বড় সম্পদ। পৃথিবীর এমন অনেক দেশ আছে যাদের সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যাও নেই। ২০০০ সালে নতুন মিলেনিয়াম শুরু হয়েছে, পৃথিবীর জ্ঞানীগুনী মানুষ ঘোষণা দিয়েছেন এই সহ¯্রাব্দের সম্পদ হলো জ্ঞান। অর্থাৎ জ্ঞানই হলো সম্পদ। ন্যালসন ম্যান্ডেলা বলেছেন ÒEducation is most powerful weapon which you can use to change the world.অর্থাৎ শিক্ষা হলো এমন এক ক্ষমতাসম্পন্ন হাতিয়ার যার ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলে দেয়া যায়। তোমরা নিজেরা সত্যিকারের শিক্ষা গ্রহন করে জ্ঞানবুদ্ধি অর্জন করে নিজেরা বদলে যাবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকেও বদলে দিবে। এখন বাংলাদেশ ডিজিটাল, তোমরা এই বাংলাদেশের ব্রিলিয়ান্ট আইটি জেনারেশন, তোমরা কত বড় হবে এর কোন পরিমাপ নেই, এটি নির্ভর করবে তোমাদের সৃজনশীলতার ওপর, তোমাদের ইচ্ছা শক্তির ওপর, তোমাদের স্বপ্ন কত বড় হবে তার ওপর। তোমরা এই বয়সে কতটুকু কত সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করবে সে বিষয়টিও চিন্তা করতে হবে। এখন প্রায় সকলের পকেটেই এক বা একাধিক মোবাইল ফোন থাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে তথ্য অনুসন্ধান কখনো এত সহজ ছিল না। দুঃখজনক হলেও সত্য এই অবাধ তথ্য ভান্ডার আমাদের জ্ঞান আহরণ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা স্বাভাবিক ধরে নিচ্ছি। তোমরা তথ্য জানার জন্য মোবাইল ফোনের সহযোগিতা না নিয়ে বেশী বেশী পত্রিকা বিশেষ করে ইংরেজী পত্রিকা ও ভাল ভাল বই পড়ার দিকে মনোযোগী হবে। আমি তোমাদের সেই অনুরোধ করছি।
খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন “মস্তিষ্ককে তোমরা কিভাবে ব্যবহার করবে তার ওপর নির্ভর করবে তোমার, তোমার দেশের এবং পৃথিবীর ভবিষ্যৎ”। তিনি আরও বলেছেন “শিক্ষক হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি ২০১৩-২০১৪ সাল থেকে ছাত্র/ছাত্রীদের মাঝে এক ধরনের গুনগত অবক্ষয় শুরু হয়েছে। তাদের মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। আমার মনে হয় এটি ফেইসবুকজাতীয় সামাজিক নেটওয়ার্ক বাড়াবাড়ির আসক্তির ফল।” এই আসক্তি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। জ্ঞান দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনে আগ্রহী উৎসাহী না হলে পরিশ্রম না করলে মেধাবী শব্দটির কোন গুরুত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কালজয়ী লেখক হুমায়ুন আহমদ একবার একজায়াগায় লিখেছেন একটা কচ্ছপের আয়ু তিনশত বছর অথচ একজন মানুষের আয়ু মাত্র ষাট-সত্তর বছর। মানুষের ক্ষণস্থায়ী এই জীবনকে সার্থক করতে হলে নিজের জন্য নিজের পরিবারের জন্য এবং অন্যের জন্যও কিছু করতে হবে।
বাংলাদেশ এখন বিপুল সম্ভাবনার দেশ। এখন বাংলাদেশের মর্যাদা বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়ে অগ্রগতির এক মাইল ফলক হলো বাংলাদেশ। আমরা যে বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক সেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব ঘোষিত হয়েছে মহাকাশেও। এখন প্রায় ৯৯ ভাগ ছেলে-মেয়ে স্কুলে যায়, হাজার হাজার শিক্ষার্থী এখন জিপিএ ৫ পায়। সারা বাংলাদেশে এ বছর ১ লাখেরও বেশী শিক্ষার্থী এস.এস.সি-তে জি.পি.এ ৫ পেয়েছে। খেটে খাওয়া খুব সাধারণ মানুষের ছেলে-মেয়েরাও এখন অনেক ভালো ফলাফল করে। শতসহ¯্র প্রতিকুলতার মাঝেও এ সমস্ত ছেলে-মেয়েরা অনেক ভালো রেজাল্ট করে। তোমরা কিন্তু তাদের চেয়ে অনেক স্বচ্ছল অনেক ভালো অবস্থানে আছ। সে বিষয়টি মাথায় রেখে সব সময় তোমরা বড় স্বপ্ন দেখবে ভালো কিছু করার। উইনস্টন চার্চিল বলেছেন “তুমি যখন সবচেয়ে বাজে মুহুর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছ, তখনও থেমো না চলতে থাকো।”
প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আর একটি বিষয় মনে রাখতে হবে জিপিএ ৫ এর লড়াইয়ে জীবনকে পরীক্ষাময় করা ঠিক হবে না। শেখার জন্য জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়তে হবে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু জিপিএ ৫ পাওয়া নয়। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো যোগ্যতা অর্জন, দক্ষতা অর্জন, জ্ঞান অর্জন, সবকিছুতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন, চৌকস মানুষ হওয়া, ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে ওঠে নিজের মনকে বড় করা, সুন্দর মানুষ হওয়া, সত্যিকারের মানুষ হওয়া, মানবকল্যানের চিন্তা ও সাধনাকে লালন করে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতা সৃষ্টি করতে পারলেই শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা। তোমরা সেরকম মানুষই হবে আমি সর্বান্তকরনে সেই দোয়াই করি। শেষ করার আগে উপমহাদেশের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি প্রয়াত অধ্যাপক ড. এপি জে আব্দুল কালাম এর Governance for the growth of India গ্রন্থ থেকে মানুষের সক্ষমতা প্রমানে চারটি পদক্ষেপের কথা তোমাদের জন্য উপস্থাপন করলাম।
১. কুড়ি বছরের মধ্যে জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে হবে।
২. বিরতিহীনভাবে জ্ঞান আহরন করতে হবে।
৩. কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যে কোন সমস্যাকে পরাস্ত করতে হবে।
৪. প্রচন্ড আতœবিশ্বাস থাকতে হবে যে, আমিই মহৎ কিছু করব।
লেখক-মোহাম্মদ আবু তাহের , ব্যাংকার ও কলামিস্ট, মৌলভীবাজার। মোবাইল: ০১৭১১-১৩৭২৯৮.Email: taherpbl@gamail.com
মন্তব্য করুন