কবি নজরুলের আগমন ও সিলেটে নারী জাগরণ

May 26, 2020,

সায়েক আহমদ॥ হযরত শাহ জালাল (র.) ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখার পরে তাঁর মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (র.) কে তা জানান। তাঁর মামা এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে হযরত শাহ জালাল (র.) কে ভারতবর্ষে যাবার পরামর্শ দেন। যাত্রাকালে তিনি হযরত শাহ জালাল (র.) এর হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বললেন, ‘যে স্থানে এই মাটির ‘স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ’ এর মিল হবে, সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে। মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (র.) এর নির্দেশনা মত হযরত শাহ জালাল (র.) সিলেটের মাটির সাথে এর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। এ কারণে আরবের আতিথেয়তার সাথে সিলেটের মেহমানদারির যথেষ্ট মিল আছে। তবে ধর্মীয় রীতিনীতির পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলে কুসংস্কারও প্রবলভাবে জাঁকিয়ে বসেছিল। এর একটি প্রমাণ হচ্ছে একসময় সিলেটের মহিলারা কুসংস্কারের কারণে প্রবল ধর্মীয় অবরোধের মধ্যে বাস করতেন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন ১৯২৮ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য সিলেট সফরে গেলেন তখন মহিলাদের ঘর হতে বাইরে যাবার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হত। কোথাও যেতে হলে বোরকা তো পরতে হতই তার উপর ঘেরা টোপ লাগানো হত। গাড়ী হতে নৌকায় বা পালকিতে উঠতে হলে নৌকার মাঝি বা গারোয়ানদেরকে সরিয়ে দেয়া হত। তারপর আপনজনেরা পর্দা দিয়ে দেয়াল সৃষ্টি করে মহিলাদেরকে অবরোধ করে রাখত। মহিলারা ঐ অবরোধের মধ্য দিয়েই চলাচল করতেন। বিদ্রোহী কবি নজরুলের আগমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সেসব কঠোরতা। মহিলারা অনেকটা বিদ্রোহ করেই বেরিয়ে এলেন স্ব স্ব গৃহ থেকে। মহিলাদের দুঃসাহসিকতা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন কাঠমোল্লা গোত্রের কুসংস্কারওয়ালা ব্যক্তিবর্গ। নজরুলের আগমন নারী সমাজে এমন আলোড়ন সৃষ্টি করে যা সিলেটের নারীসমাজের অবরোধ প্রথা বিলুপ্ত হবার পথ তৈরি করে দেয়। তখনকার সময়ের সিলেটের বিশিষ্ট ঘরের মহিলা মিসেস সিরাজ উদ্দীন এবং মিসেস জোবেদা আবদুর রহিম সকল অবরোধ ছিন্ন করে পুরুষদের সাথে প্রথম কাতারে প্রকাশ্য সভায় যোগদান করেন। তৎকালীন সিলেটের সামাজিক পটভূমিকায় এ ঘটনা ছিল অবিশ্বাস্য এবং সফল বিদ্রোহের শুভসূচনার দিন। সিলেট বিভাগের মহিলা জাগরণের প্রথম সূচনা এবং নারী প্রগতির স্মরণীয় দিন। নারীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সিলেট বিভাগজুড়ে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সমগ্র পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এটা ছিল একটি দুর্দান্ত ঘটনা।
১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুরমা ভ্যালি মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন সিলেটে এক সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার মাটি ও মানুষের নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জ্ঞানতাপস ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিন জনই এক সাথে কলকাতা থেকে সিলেটে এসেছিলেন। এই সফরে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র মুহম্মদ সফিউল্লাহও তাদের সাথে এসেছিলেন।
এ তিন মনীষীর আগমন উপলক্ষে ঢাকঢোল পিটিয়ে নেয়া হয়েছিল প্রস্তুতি। মেহমানরা আসেন ট্রেনে। সম্মেলনের নির্ধারিত দিনের সকালবেলা এই তিন মনিষী একসাথে কলকাতা থেকে সিলেট এসে পৌঁছান। তারা গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে এসেছিলেন চাঁদপুর। তারপর চাঁদপুর থেকে ট্রেনে রওনা হন। সকালবেলা সুরমা মেইল ট্রেনটি সিলেট রেলস্টেশনে এসে পৌঁছায়। স্টেশনে ছিল ভক্তদের গণজোয়ার। তিন মহামানবকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রেলস্টেশনে গিজগিজ করছিল। এই তিন মনিষী এবং দিকপালের একই সাথে সিলেট সফরে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। উদ্যোক্তাদের পক্ষে আব্দুল মুহিত চৌধুরী আগেই কুলাউড়া চলে গিয়েছিলেন তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য।
যথা সময়ে সুরমা মেইল আসে সিলেটে। বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তখন টগবগে যুবক। তিনি সেসময় কবি নজরুলের আগমন এর ঘটনা স্মৃতিচারণ করেছিলেন। কবি নজরুল এর দৈহিক বর্ণনা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘এবার কবিকে দেখাচ্ছে ঠিক বিদ্রোহী কবির মতই। মাথায় হলদে সিল্কের অপূর্ব ঢঙে বাঁধা পাগড়ি। গায়ে সবুজ খদ্দরের গলফকোর্ট, পরিধানে সবুজ খদ্দরের নিকাব, পায়ে সবুজ খদ্দরের তৈরি লেগ গার্ড। পদদ্বয়ে আমেরিকান টোয়ের কালো জুতো।’
সিলেটে সুরমা নদীর উপর তখনো কীনব্রিজ হয়নি। মেহমানরা সবাই জুড়িন্দা নৌকায় চড়ে সুরমা নদী পার হয়েছিলেন। বিকেল চারটায় গিরিশ চন্দ্র বিদ্যালয়ে (রাজা জিসি হাইস্কুল) সম্মেলন শুরু হবে। এ সময়ে ছিল পূজোর ছুটি। নজরুলের ভক্ত অনুরাগী সহ ডাক্তার, উকিল, মোক্তার, শিক্ষক এমনকি শ্রমজীবীরাও এসে জড়ো হয়েছেন। সম্মেলনের জন্য যে প্যান্ডেলটি তৈরি করা হয়েছিল তাতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কারণ অবিভক্ত বাংলার তিন মনীষীকে একসাথে এক মঞ্চে পাওয়া সিলেটবাসীদের জন্য ছিল একটি বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার।
নির্ধারিত সময়ে সম্মেলন শুরু হল । সিলেটবাসীরা সর্বদা দর্শনীয় স্টেজ তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। সম্মেলনের জন্য তৈরিকৃত স্টেজটিও ছিল তাই ঐতিহ্যবাহী। প্রকান্ড ডায়াসে একে একে উঠলেন মেহমানরা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অবিভক্ত বাংলার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তো ছিলেন সম্মেলনের মধ্যমনি।
সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর মঞ্চে আবির্ভূত হলে তাগড়া নওজোয়ান নজরুল। মুহুর্মুহু করতালিতে সম্মেলনস্থল কেঁপে উঠল। এক্ষুনি নজরুল তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গান শুরু করবেন। কিন্তু নজরুলে গান শুরু করার আগেই বিরাট বিপত্তি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত একজন মৌলভী সাহেব প্রশ্ন তুললেন, ‘গান গাওয়া কি জায়েজ?’ মৌলভী সাহেবের প্রশ্নে ক্ষেপে উঠল দর্শকশ্রোতাবৃন্দ। কবি কিছু একটা উত্তর দিতে চাইলেন। কিন্তু তার জবাব দেয়ার আগেই অনুষ্ঠানের সভাপতি শেরে বাংলা একে ফজলুল হক দুহাত তুললেন। সম্মেলনস্থলে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। শেরেবাংলা ঘোষণা দিলেন, ‘গান গাওয়া গায়কের নিয়তের উপর নির্ভর করে’। শেরে বাংলার ঘোষণা তো তখনকার সময়ে একটি অলঙ্ঘনীয় আদেশ। উল্লাসে ফেটে পড়লেন উপস্থিত দর্শকশ্রোতাবৃন্দ।
আবারও একটি বাঁধা আসল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আরেকজন প্রশ্ন করলেন, ‘কবি নামাজ পড়েন কিনা?’ এবার নজরুল নিজেই এটার উত্তর দিলেন। বললেন, ‘এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং অপরকে জিজ্ঞেস করার কিছুই নেই।’ নজরুলের উত্তর শোনে আবারও উল্লাসে ফেটে পড়লেন উপস্থিত দর্শকশ্রোতাবৃন্দ। সঙ্গীত পিপাসু শ্রোতাবৃন্দের চাপে নজরুল গান ধরলেন। মুহুর্মুহু করতালিতে আবারো কেঁপে উঠল সম্মেলনস্থল।
নজরুল হারমোনিয়াম নিয়ে গাইলেন উদ্বোধনী সংগীত, ‘চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল’ গানটি। এ গানটি এখন বাংলাদেশের রণসংগীত। তারপর তিনি একে একে গাইলেন, ‘বাজলো কিরে ভোরের সানাই’, ‘মিঠা নদীর পানি’ ও ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ প্রভৃতি গান। মন্ত্রমুগ্ধের মত শ্রোতাগণ গান শুনলেন।
সম্মেলনের তিনটি অধিবেশন হয়েছিল। তৃতীয় দিনে ছিল ছেলেদের ডন কুস্তি প্রদর্শনের পালা। সেসময়ে সিলেটের বিখ্যাত ডন কুস্তিগীর ছিলেন ইব্রাহীম মিয়া। নজরুল ইব্রাহীম মিয়ার কুস্তি দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি ইব্রাহীম মিয়ার ডনের পদ্ধতি দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইব্রাহিম তোমার শরীর দেখে মনে হল গ্রীক ভাস্করের খোদাই করা মূর্তি।’
ঐ সময়ে সিলেটের দুই কিশোর কবি তাদের কবিতার পান্ডুলিপি নিয়ে কবির সাথে দেখা করেছিলেন। এরা হচ্ছেন কবি আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল গফ্ফার দত্ত চৌধুরী। নজরুল ধৈর্য্যরে সাথে তাদের কবিতাগুলো পড়লেন। তারপর তাদেরকে উৎসাহিত এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করলেন। তিনি বললেন, ‘তোমাদের দুজনেই বিরাট প্রতিভা আছে। তোমরা সামেন এগিয়ে চলো।’ নজরুলের এ আহ্বানে কিশোর কবিদ্বয় বিরাট অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তীতে যখন এ দু’জনই কবি হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন, সে ঘটনার মধ্য দিয়ে। এতে নজরুলের ভবিষ্যদ্বাণীও নির্ভূল প্রমাণিত হয়েছিল। এভাবেই সম্পূর্ণ একটি মাস পুরো সিলেটজুড়ে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চলের সৃষ্টি হয়। সিলেটের সর্বত্র অনাবিল আনন্দ ও ফূর্তির বান বয়ে যায়।
এবার তার বিদায়ের পালা। বাংলা কার্তিক মাস। সিলেটের আকাশে মৃদু মেঘমালা। অনেক লোক নদীর পারে জড়ো হলেন। তাদের চোখে মুখে বেদনার ছাপ। সজল চোখে সবাই তাকে জানালো বিদায়। তিনি অনেকের সাথেই আলিঙ্গন করলেন। ট্রেনে উঠে বসলেন কবি। ঝিকঝিক করে ট্রেন ছুটলো। ট্রেন সিগন্যাল পার হয়ে গেলেও দেখা গেল, তার হাতে একখানা রুমাল উড়ছে।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সিলেট সফরটি ছিল ঐ সময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সফর। এ সফরে নজরুল তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পুরো সিলেটকে উত্তাল করে গিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে কাজটি তিনি করে গিয়েছিলেন তা হল সিলেটে নারী স্বাধীনতার শুভ সূচনা করা। ঐ সময়ে যদি নারীরা বিদ্রোহ করে ঘর থেকে বেরিয়ে নজরুলের অনুষ্ঠানে যোগদান না করতেন, তবে সিলেটে নারী স্বাধীনতা কবে আসত, কীভাবে আসত, তা হত গবেষণার বিষয়। কাজেই বলা যায় সিলেট তথা বাংলাদেশের নারী স্বাধীনতায় নজরুলের সিলেট সফরটি ছিল অবিস্মরণীয়!
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com