কমলগঞ্জে চা শ্রমিক উড়িয়া সম্প্রদায়ের ১৩ দিনের “ডন্ড” ব্রত উৎসব

April 2, 2017,

কমলগঞ্জ প্রতিনিধি॥ চা বাগানে বসবাসকারী প্রায় ৮৫টি জাতি গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা- সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য পুজা অর্চনা ইত্যাদি। এই বৈচিত্র্যময় জাতি সম্প্রদায়ের মাঝে উড়িয়া (উড়িষ্যা থেকে আগত) সম্প্রদায় অন্যতম। উড়িয়ারা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ চৈত্র অমাবস্যায় টানা ১৩ দিনের বিশেষ ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ব্রত উৎসব পালন করে। চা বাগান এলাকায় এটি “ডন্ড” উৎসব নামে পরিচিত।
৩১ মার্চ শুক্রবার থেকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর চা বাগান থেকে এ উৎসব শুরু হয়েছে।
১৩ দিনের উৎসবে যোগদানকারীরা ঘর ছাড়ার তিন দিন আগে নিজেকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে নেয়। এজন্য তারা উপবাস থেকে কিছু বিশেষ নিয়ম কানুন পালন করেন। যাত্রার আগের দিন নদী বা পাহাড়ি ছড়ার তীরে গিয়ে মা কালীকে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ দিয়ে আসে। যাত্রার দিনে মা কালীকে তারা পুজা দিয়ে যাত্রা সম্পর্কে নির্দেশনা প্রার্থনা চাওয়া হয়। মা কারী তাদেরকে যে দিকে যেতে বলেন এ দলটি সে দিকে বেড়িয়ে পড়েন। দরে অংশ গ্রহনকারীর সদস্যের স্ত্রীরা স্বামীর মঙ্গল কামনা করেন। যাত্রাপথে যাতে কোন অসুখ বিসুখ ও দুর্ঘটনা না হয় সে জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম কানুন পালন করেন। যেমন- ঝাড়–র পরিবর্তে নিজের পরিধেয় শাড়ি দিয়ে ঘর পরিষ্কার করা, নিরামিষভোজী হওয়া ইত্যাদি।
নিজ এলাকা ছাড়ার পূর্বে এই ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক এই দলটি বিশেষ কিছু প্রস্তুতি নেন। তারপর মা কালীর নামে ১৩ দিনের বিশেষ ব্রত পালনের জন্য ঘর ছাড়েন। লালসালু কাপড় দিয়ে বিশেষ এক ধরনের পোষাক পরিধান করে বাদ্যযন্ত্র (ঢাক করতাল, ঘন্টা, খঞ্জনি ইত্যাদি) মা মণির (কালীমাতা)-র ছবি কাপড়ে মুড়িয়ে হাতে জয়পতাকা নিয়ে এ দলের সদস্যরা ১৩ দিনের জন্য ঘর বাড়ি ছেড়ে এক চা বাগান থেকে আরকে চা বাগানে যান। যাবার পথে তারা বিশেষ কিছু স্থানে পাহাড়ি এলাকার বটগাছের নিচে ও মন্দির পেলে মন্দিরে অবস্থান করে পুজা করে বিশ্রাম নেওয়া হয়।
দলের সদস্যরা পায়ে হেটে এক চা বাগান থেকে আরেক চা বাগানে যান। এভাবে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কি:মি: পথও ভ্রমণ করতে হয়। যাবার পথে তারা নিজ মাতৃভাষায় বিশেষ এক ধরনের স্লোগান দেন। “কড়া গঞ্জিবাড়ো যুগনিদ্রা…সাবধান মনিমা–শিবোসংকরো হে…ভক্তরো মনোবাঞ্চা পূর্ণ করো হে। অর্থাৎ প্রভু শিব জেগে যান আমাদের মনো বাসনা পূর্ণ করুন এলাকার অসুখ-বিসুখ দূর করুন। এগুলো বলে দলটি এসব এলাকার অসুখ বিসুখ, ভুত প্রেতকে সাবধান করে দেন ও ভক্তের মনোবাঞ্চনা পূরণের জন্য ঈশ্বরকে অনুরোধ করেন।
দলটি যে চা বাগানে প্রবেশ করেন সে চা বাগানের সাধারন চা শ্রমিকরা আন্তরিকতার সাথে তাদেরকে গ্রহন করে অবস্থানের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করে দেন। তবে কারো বাড়িতে নয়। মন্দিরে বা বড়গাছের নিচে অবস্থান নিতে হয়। সেখানেই রাত্রি যাপন করেন এক বা দুই দিন। সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিক পুজা শেষে রাতে এ দলের সদস্যরা বিশেষ এক ধরনের ধর্মীয়-সামাজিক নাটক পরিবেশন করেন, যা দেখার জন্য চা বাগানের সাধারন মানুষজন বছরের এ দিনের অপেক্ষায় থাকেন। এ চা বাগানের সকল ধরনের অসুখ বিসুখ ও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য নাটকের এক পর্যায়ে গভীর রাতে মা কালীকে আহ্বান করেন। মা কালী অত্র এলাকার সকল ধরনের সমস্যার সমাধান করেন ও অসুখ-বিসুখ থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষা করেন বলে তাদেও বিশ্বাস।
চার প্রজন্ম ধরে এই বিশ্বাসকে ধারণ ও লালন করা এই জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী “ডন্ড ব্রত”কে বাঁচিয়ে রাখা ও বিকাশ নিজেরাই করছে। কোন প্রকার সরকারী সহযোগিতা নেই বলে সদস্যরা জানান। উড়িয়া সম্প্রদায়ের চা শ্রমিকরা দাবি করে বলেন, তাদের এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণে সরকারী সহযোগিতা করা উচিত।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com