কমলগঞ্জে বর্ণাঢ্য আয়োজনে ঊষালগ্নে সাঙ্গ হল মণিপুরী মহারাসলীলা
কমলগঞ্জ প্রতিনিধি॥ কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে তুমুল হৈ চৈ আনন্দ উল্লাস, বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা, ঢাকঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার ঊষা লগ্নে সাঙ্গ হলো মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা।
১৫ নভেম্বর মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের সাথে সাথে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। অতঃপর যার যার নিজ নিজ গন্থব্যস্থলে চলে যান। বর্ণাঢ্য আয়োজনে রাস উৎসবে প্রতিবারের মত এবারও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। মণিপুরী সমপ্রদায়ের এ বৃহত্তম উৎসব উপলক্ষে দুটি স্থানে বসেছিল রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হয়েছিল কমলগঞ্জের মণিপুরী অঞ্চলগুলো। ভিড় সামলাতে পুলিশ-র্যাব সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী সমপ্রদায়ের ১৭৪ তম শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরন উৎসব উপলক্ষে গত সোমবার সকাল ১১টা থেকে গোধূলীলগ্ন পর্যন্ত রাখাল নৃত্য (গোষ্ঠলীলা), সন্ধ্যা ৮টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত চলে গুণীজন সংবর্ধনা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সভাপতি যুগেশ্বর সিংহের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর এমপি। প্রধান আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি।
“দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ” বৃহত্তর সিলেটের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম বিশ্বনন্দিত সাংস্কৃতিক ধারক মণিপুরী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব “রাসলীলা” মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ১৭৪ তম মাধবপুর জোড়ামন্ডপ এবং আদমপুর সানাঠাকুর মন্ডপে ৩১ তম এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বর্ণাঢ্য আয়োজন ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার উষালগ্নে সাঙ্গ হলো মণিপুরী মহারাসলীলা। রাতভর রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপখ্যানের সে রাসলীলা উপভোগ করতে সারাদেশ থেকে ছুটে এসেছিলেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাংবাদিক, দেশি- বিদেশি পর্যটকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষজন। তবে এবার প্রথমবারের মত মৈতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকেরা আদমপুর এলাকায় পৃথক দুটি স্থানে এবার রাসোৎসব করছে। এ উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। রাস উৎসব উপলক্ষে তিনটি স্থানেই বসেছিল বিরাট মেলা। মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মাধবপুর ও আদমপুরে রাসোৎসবের জন্য তৈরী সাদাকাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলো লাখো মানুষের মিলনতীর্থে পরিণত হয়। মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৭৭৯ সালে মনিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রর্বতন করেছিলেন তাহাই রাসোৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশরিভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশগ্রহন করতেন। এর ফলে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় কোন ছেদ পড়েনি। অতীতের সেই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই কোন রুপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলা। তুমুল হৈ-চৈ, আনন্দ-উৎসাহ, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খ ধ্বনির মধ্যদিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে ঘিরেই বছরের অন্য সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ ফিরে পায়।
সোমবার রাত ১২টা থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত চলে শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুকরণ মনিপুরী লাইহারাওবা উৎসব অর্থাৎ মণিপুরী মহারাসলীলা উত্সব। ভোরের সূর্যোদয়ের পর অনুষ্টানের পরিসমাপ্তি ঘটে এই মহামিলন অনুষ্টানের ; তারপর সবাই ফিরে যায়যার যার নিজ গন্তব্যে।
মন্তব্য করুন