কমলগঞ্জে মৌচাষে নীরব বিপ্লব : বছরে চাষীদের আয় অর্ধ কোটি টাকা
প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ॥ মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার তিন শতাধিক চাষী মধু চাষ করে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন। প্রথমে কোন ধরনের প্রশিক্ষণ কিংবা সরকারী আর্থিক সহযোগীতা ছাড়াই নিজেদের স্বল্প পুঁজি খাটিয়ে দরিদ্র চাষীরা মধু উৎপাদন শুরু করলেও বর্তমানে বিসিক ও বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
৫/৬ বছর আগেও মধু চাষের বিষয়টি যে উপজেলার চাষীদের কেউ কল্পনাও করেনি অথচ সেই চাষীরাই তাদের উৎপাদিত মধু বাজারজাত করে বছরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা আয় করছেন। সরকারী পর্যায়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে এ উপজেলা হয়ে উঠতে পারে মধুচাষের অন্যতম একটি এলাকা।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের কাঠালকান্দি গ্রামের আজাদ মিয়া নামে এক ব্যাক্তি প্রথম মধু চাষের সূচনা করেন। বর্তমানে আদমপুর ও পার্শ্ববর্তী ইসলামপুর ইউনিয়নের মধ্যভাগ কালারায়বিল, ছয়ঘরি, কাঠালকান্দি, কোনাগাও, কানাইদাশী, রাজকান্দি, আধকানি, পুরান-বাড়ি, নয়াপত্তনসহ প্রায় ৩০টি গ্রামের ৪ শতাধিক চাষী মধু চাষে জড়িয়ে পড়েছেন। এখানকার চাষীদের উৎপাদিত এসব মধু মৌলবীবাজার, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমন কি প্রবাসীরাও মধু কিনে বিদেশ নিয়ে যাচ্ছেন। বলতে গেলে এ উপজেলায় মধু চাষে বিপ্লব ঘটেছে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজ মধু, দাশকুলি মধু, মাছি মধু, ঘামি মধু ও মধু মালতি এই ৫ জাতের মধুর চাষাবাদ হলেও এ উপজেলায় হলেও কমলগঞ্জে সবচেয়ে বেশী চাষাবাদ হচ্ছে দাশকুলি মধুর বাক্স (এ্যাপিস সেরেনা) স্থাপনের মাধ্যমে। প্রতিটি বাড়িতে ২/৩টি করে মধু উৎপাদনকারী কাঠের বাক্স স্থাপন করা আছে। এসব বাক্স থেকে বছরে তিন থেকে চারবার মধু সংগ্রহ করেন চাষীরা। স্বল্প খরচে এক একটি বাক্স থেকে ২৫/৩০ কেজি আহরণ করা হয়। বছরে সংগৃহীত মধু বিক্রি করে চাষীরা জনপ্রতি ৩০/৫০ হাজার টাকা আয় করছেন। সে হিসাবে বছরে প্রায় ৩০ হাজার কেজি মধু উৎপাদন করছেন তারা। যার বাজার মূল্য প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। আর এই মধু চাষের কারনে তাদের ঘরে ঘরে এখন আর অভাব অনটন নেই। প্রতিটি পরিবারে ফিরে এসেছে স্বচছলতা। প্রথমে কোন ধরনের প্রশিক্ষন ছাড়াই নিজেদের প্রচেষ্টা মধু চাষে প্রত্যেকেই সাফল্যের মুখ দেখায় এসব গ্রামের নারীরাও এখন নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছেন এতে। তারাও এখন ব্যস্ত দিন কাটান। শুধু তাই নয় নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে তারা গড়ে তুলেছেন ‘কমলগঞ্জ উপজেলা মধু চাষী উন্নয়ন সমিতি’ নামে একটি সংগঠন । বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিসিক) মৌলভীবাজার এর ১ বছর ধরে মধুচাষীদের আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শুরু করে। প্রতিটি ব্যাচে ১০ জন করে প্রশিক্ষণার্থী ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এছাড়া বিসিকের উদ্যোগে কয়েকটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
আলাপকালে কমলগঞ্জ উপজেলার প্রথম মধু চাষী কাঁঠালকান্দি গ্রামের আজাদ মিয়া জানান, বছর কয়েক আগে একদিন তিনি রাজকান্দি পাহাড়ে গিয়ে নিজের জন্য মধু সংগ্রহের সময় হঠাৎ ধরা পড়ে রানী মৌমাছি। তিনি বইয়ের সেই কবিতার কথা- মৌমাছি মৌমাছি কোথাও যাও নাচি নাচি’ চরণকে মনে করেই রানী মৌমাছিকে ধরে একটি গাছের ডালে রেখে দিতেই হাজারো মৌমাছি উপস্থিত হয়। সেটাকে তিনি বাড়ি নিয়ে এসে একটি বাক্সে রেখে দেন। কয়েক দিন পর দেখেন মধু আহরণ হয়েছে। তখন থেকে মধু সংগ্রহ শুরু করেন এবং ক্রমশ তা নেশায় ও পেশায় পরিনত হয়ে উঠে। তিনি এখন সম্পূর্ণ মধু চাষের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে তাঁর ২০টি বাক্সে মধু চাষাবাদ চলছে। এই ২০টি বাক্স ছাড়াও পাহাড় থেকে মৌমাছি ও বিভিন্ন ব্যক্তির বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করে বছরে তিন থেকে চার লাখ টাকা আয় হয়। তার এই মধু চাষের বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে অন্যান্যরা মধু চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনি বলেন, মধু চাষাবাদের চেয়ে উন্নতমানের আর কোন চাষাবাদ নেই। অল্প খরচেই লাখ লাখ টাকা উপার্জন করা সম্ভব। মধু চাষাবাদে শুরুতে শুধুমাত্র একটি বাক্সে মৌমাছি সংগ্রহে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ ব্যতিত আর কোন খরচ নেই। এক একটা বাক্সে বছরে চার বারে ২৫ থেকে ৩০ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। বাজারে প্রতি কেজি মধুর দাম ৮শ’ টাকা হিসাবে বছরে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। এমন লাভের আশায় তিন বছরে মধু চাষী সংখ্যা বেড়েছে। আশানুরুপ মধু উৎপাদিত হওয়ায় ক্রমশ: বাড়ছে তাদের মৌমাছি চাষের পরিধি। কম্পিউটার ব্যবসায়ী সুমন দাস ও গৃহিনী রিনা বেগম জানান, বিসিক থেকে মৌ চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। ২ বাক্সের মাধ্যমে তারা এ্যাপিস সেরেনা জাতের এ মাছি পালন শুরু করেন ।
আলাপকালে চাষী বাবুল মিয়া, মাওলানা মছব্বির, জমসেদ মিয়াসহ অনেকেই বলেন, কোন ধরনের প্রশিক্ষন ছাড়াই নিজেদের চেষ্টায় তারা মধু চাষ করছেন। সরকারী উদ্যোগে চাষীদের প্রশিক্ষণ ও তাদের উৎপাদিত মধু বাজারজাত হলে যেমন আরও অধিক উৎপাদন সম্ভব হতো তেমনি বাজারমূল্য আরও বেশী পেতেন। কমলগঞ্জে মধু চাষী উন্নয়ন সমিতির সভাপতি শিক্ষক আলতাফ মাহমুদ বাবুল বলেন, এলাকায় মধু চাষের এমন নীরব বিপ্লব ঘটছে। বর্তমানে বিসিক ও কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারী সহযোগীতা পাচ্ছেন মধুচাষীরা। এই এলাকায় মধু চাষের একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। পুঁজির ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ ও সরিষার চাষাবাদ বৃদ্ধি করা হলে মধু চাষে আরো বিপ্লব হবে বলে দাবী করেন।
কমলগঞ্জের ক্ষদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদ এর সংগঠক সভাপতি, লেখক-গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে এই এলাকা মধু চাষের চিহ্নিত জোন হিসাবে গড়ে তোলা যাবে। বিশেষতঃ আদমপুর, ইসলামপুর ইউনিয়নে মধু চাষে একটা ব্র্যান্ড তৈরী হতে পারে। এখানে একটি স্থায়ী মধু চাষ উন্নয়নে বিসিক বা সরকারের উদ্যোগে স্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে।
মন্তব্য করুন