করোনাভাইরাস ও দেশের অর্থনীতি
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ পবিত্র কোরআনের সুরা আর রোম এর ৪১ নং আয়াতের বাংলা অনুবাদেও মাধ্যমেই আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে স্থলে সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে মূলত আল্লাহ তায়ালা তাদের কতিপয় কাজকর্মের জন্য তাদের শাস্তির স্বাদ-আস্বাদন করাতে চান, সম্ভবত তারা সেসব কাজ থেকে ফিরে আসবে’। এখন পৃথিবীর মানুষ শংকায় ও আতংকে দিন কাটাচ্ছে, প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে করোনাভাইরাসের তথ্যচিত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে নতুন সংক্রমনের খবর। মানুষের প্রাণ হারানোর সংখ্যাও বাড়ছে। এটা বৈশ্বিক মহামারী। এমতাবস্থায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সাময়িক বন্ধ করছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। বাতিল করা হচ্ছে বিশ্বনেতাদেরও পররাষ্ট্র সফর। খেলার মাঠে খেলোয়াররা করমর্দন করা থেকেও বিরত আছেন বলে সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় পৃথিবী যেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিয়েছে নানা সর্তকতামূলক পদক্ষেপ। ফেইসবুক তাদের লন্ডন কার্যালয় সাময়িক বন্ধ রেখেছে। বাড়ি থেকেই কর্মীদের কাজ করার নিদের্শ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে করোনার সংক্রমন শুরু। এরপরে ১৪৭টিরও বেশী দেশে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতি এ ভাইরাস। মারা গেছেন ৫ হাজারেরও বেশী। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৫১ হাজার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গণ পরিবহন এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কর্মকর্তারা। এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা: মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন করোনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন দেশ, বাংলাদেশও উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া বিকল্প নেই। সতর্কতার অংশ হিসেবে সম্ভব হলে গণপরিবহন এড়িয়ে চলতে হবে। তিনি আরো বলেন বিদেশ থেকে কেউ এলেই যে তার মধ্যে সংক্রমন রয়েছে তা ঠিক নয়। কিন্তু সাবধানতা নিতে হবে। তাই বিদেশ থেকে এলে নিজস্ব গাড়ী ব্যবহার এবং গাড়ীর জানালা খুলে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে কেউ এলে পরিবারের সবাইকে বিমানবন্দরে যাওয়া থেকেও বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা। করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। আশংকা করা হচ্ছে ভাইরাস চুড়ান্তভাবে আঘাত করলে বিশ্বের অর্থনীতিতে বছরে উৎপাদন কমবে ৩৪ হাজার ৬৯৭ কোটি ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা ২৯ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর প্রভাবে উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশে রপ্তানি বাণিজ্য কমবে। অর্থনৈতিকভাবে শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে। কাঁচামাল আমাদানি ব্যাহত হওয়ায় কমে যাবে শিল্পোৎপাদন। এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। অর্থনীতির ওপর করোনার প্রভাব সম্পর্কিত জাতিসংঘের ও এডিবির পৃথক দুটি প্রতিবেদনে এই আশংকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি ৬ মাসের বেশী অর্থাৎ তীব্র আকার ধারণ করলে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে ৯৪ লাখ ডলার বা ৮০ কোটি টাকা লোকসান করবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে পর্যটন শিল্পের সাথে সরাসরি যুক্ত বিমান, হোটেল ও পরিবহন খাত। এসব খাতেও বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমান হবে ভয়াবহ। কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল বিশ্বের শীর্ষ ২০ ক্ষতিগ্রস্থ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশের চামড়া. পোশাক ও আসবাবপত্র শিল্পখাত বড় ক্ষতির মধ্যে পড়বে। করোনাভাইরাসে দেশের শেয়ার বাজারে আঘাত দৃশ্যমান হয়েছে। ৯ বছরে বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে সর্বোচ্চ পতন হয়েছে। পণ্য ও গনপরিবহন অনেক ক্ষেত্রে সীমিত হয়ে পড়ায় পৃথিবীর অনেক প্রান্তে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ও মজুদ সংকট দেখা দিয়েছে। কাতার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সহ ১০টি দেশ থেকে কেউ তার দেশে ঢুকতে পারবেনা। এতে সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ সহ অনেক দেশের শ্রমিকরা যারা কাতার থেকে দেশে ছুটিতে গিয়ে আটকা পড়েছেন। সব মিলিয়ে সারা বিশ্বের অবস্থাই এখন ভীতিকর। সৌদি আরবে ওমরাহ হজ্জ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। দেশে করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হওয়ায় স্বভাবতই মানুষের মধ্যে এ নিয়ে এক ধরনের ভীতি বা আতংক কাজ করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মানুষ সতর্ক থাকলে আতংকগ্রস্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং আতংকগ্রস্থ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশংকা থাকে। এ ধরনের প্রাদুর্ভাব যেহেতু পৃথিবীতে নতুন তাই এ রোগ মোকাবেলা করারও পূর্ব প্রস্তুতি বা অভিজ্ঞতা নেই বাংলাদেশের। এক সময় ঝড়, সাইক্লোন ও বন্যায় বাংলাদেশের অনেক মানুষের প্রাণহানী ঘটত, কিন্তু এখন বাংলাদেশের মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুহার কমেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে আমেরিকারও মৃত্যুহার বেশি। আমরা আশা করতে চাই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে বাংলাদেশ নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। আতংকিত না হয়ে আমরা পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকি, মরার আগেই যেন আমরা না মরি এবং সব সময় আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ আমাদের দেশ একটি ছোট্র দেশ। নেই কোনো উন্নত চিকিৎসা। মহামারি করোনাভাইরাস এর মত কঠিন কোনো রোগ তোমার রহমত ছাড়া মোকাবেলা করার সামর্থ্য আমাদের নেই। তুমি তো রহিম-রহমান তুমি আমাদের এই কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা করো। অধ্যাপক ডা: এবিএম আব্দুল্লাহ বলেছেন করোনা ভাইরাস নিয়ে আতংকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সচেতনভাবে ব্যক্তিগত স্থাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হবে।
করোনাভাইরাস যেভাবে ছড়ায় :-
হাঁচি ও কাশির ফলে, আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে, ভাইরাস আছে এমন কোনো কিছু স্পর্শ করলে, হাত না ধুয়ে মুখে, নাকে বা চোখে লাগালে এবং পয়:নিস্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
করোনাভাইরাসের লক্ষণ:- সর্দি, কাশি, জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, মারাত্নক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া শিশু, বৃদ্ধ ও কমরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিউমোনিয়া ও ব্রাংকাইটিস।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়:-
মাঝে মাঝে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, হাত না ধুয়ে মুখ, চোখ ও নাক স্পর্শ না করা, হাঁচি, কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখা, বন্য জন্তু বা গৃহপালিত পশুকে খালি হাতে স্পর্শ না করা, মাংশ বা ডিম খুব ভালাভাবে রান্না করা, মুখে মাস্ক ব্যবহার করা, প্রচুর ফলের রস ও পানি পান করা ইত্যাদি। করোনাভাইরাস থেকে সচেতনতা বাড়াতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে। সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
আল্লাহ যেন বাংলাদেশকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করেন। পৃথিবীর সকল মানুষকে যেন মুক্তি দেন সেই প্রার্থনা করছি।
লেখক:- ব্যাংকার, গবেষক ও কলামিস্ট:
মন্তব্য করুন