কানাডায় প্রথমবারের মতো গণহত্যা দিবস পালিত হলো বাংলাদেশ হাইকমিশনে
সিবিএনএ কানাডা থেকে॥ ২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর নির্মম, বর্বরোচিত ও জঘন্যতম গণহত্যার ভয়াল কালরাত স্মরণে কানাডায় এই প্রথম গণহত্যা দিবস পালিত হলো রাজধানী অটোয়ায়। বাংলাদেশ হাইকমিশন আয়োজিত এই গণহত্যা দিবস পালন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর হাইকমিশনার মিজানুর রহমান। দূতাবাসে অনুষ্ঠিত এ দিবস পালনের সময় সকল কূটনীতিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, প্রথিতযশা কানাডীয় শিক্ষাবিদবৃন্দ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও তরুণ সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রথমেই বাঙালীর মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রক্কালে ২৫শে মার্চের সেই নারকীয় গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। ঢাকা থেকে প্রেরিত মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাণী পাঠ করেন যথাক্রমে দূতাবাসের কাউন্সিলর মাকসুদ খান ও প্রথম সচিব আলাউদ্দিন ভুইয়া। এরপর বড় স্ক্রীনে প্রদর্শন করা হয় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত “”Genocide in ১৯৭১ and The Killing Fields শীর্ষক প্রামাণ্য ভিডিও ডকুমেন্টারী। এতে ‘৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার ভয়বহতার চিত্র প্রত্যক্ষ করেন উপস্থিত অটোয়াবাসী। লাখ লাখ বাঙালীকে এহেন নিষ্ঠুরভাবে হত্যাকারী পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতা দৃশ্য দেখে এ সময় অনেকেই চোখের অশ্রু সম্বরণ করতে পারেননি।
প্রামান্যচিত্র প্রদর্শনের পর অনুষ্ঠিত হয় গণহত্যা দিবসের বিশেষ আলোচনা সভা। এতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ্লগনকুইন কলেজের অধ্যাপক ও অটোয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর সেলিম শের বলেন, ‘৭১ এর ২৫শে মার্চ কলরাতে তিনি নিজের চোখে দেখেছেন কী নৃসংশভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে ছাত্র-শিক্ষকদের ধরে নিয়ে মাঠে দাঁড় করিয়ে একসাথে মেরে ফেলা হয়েছে, গণকবর দেওয়া হয়েছে। তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান এ দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সিন্ধান্তের জন্য। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি আরিব সাইফুদ্দিন জানায় বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত এই ভয়ঙ্কর গণহত্যার বিষয়ে সে কানাডার শিশু কিশোরদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করে যাবে। আওয়ামী লীগ নেত্রী সোমা সাইফুদ্দিন বলেন, আমাদের একথা ভাবতেই কষ্ট হয় যে বাংলাদেশেরই কতিপয় অকৃতজ্ঞ মানুষ আজ মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। “এদের কত বড় সাহস!” এদের ঘৃণা করার আহ্বান জানান তিনি। আওয়ামী লীগ নেতা মুন্সী বশীর বলেন, বাংলাদেশের সকলের উচিত পাকিস্তানী ঘাতক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালালদের মুখোশ উন্মোচিত করা। এই ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার জন্য তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান।
বিশেষ আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানে যোগ দেন ও বক্তব্য রাখেন অটোয়া ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট’-এর অধ্যাপক নিপা ব্যানার্জী। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, তাঁর বাড়ী বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তবে তিনি গর্ববোধ করেন এই কারণে যে তিনি একজন বাঙালী এবং সেই সময়ে, ১৯৭১ -এ একজন বিদেশী ছাত্রী হিসেবে অটোয়ায় থাকা অবস্থায়ই তিনি পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যার বিরূদ্ধে পার্লামেন্ট হিলে জনমত সংগঠিত করেন এবং প্রতিবাদ সমাবেশে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলেন, কানাডার তৎকালীল প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডো (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পিতা) সেই সময় বাংলাদেশকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান । তিনি বলেন, আজ বাংলাদেশ নিজের যোগ্যতায় অত্যন্ত সাফল্যের সাথে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজিক উন্নয়ন ও নারী অধিকারের ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে, যা দেখে তিনি বাংলাদেশের একজন বন্ধু হিসেবে গর্ববোধ করেন। ১৯৭১ সালে বাঙালীদের wbabhÁ‡K Genocide অভিহিত করে এই কানাডীয় অধ্যাপক বলেন, “গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে অবশ্যই বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে”।
এরপর ‘৭১ এর গণহ্ত্যা ও বর্বরতার জন্য দায়ী পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের তীব্র ঘৃণা জানিয়ে রচিত কবি শামসুর রাহমানের কালজয়ী কবিতা “অভিশাপ দিচ্ছি” -এর প্রাঞ্জল ও আবেগঘন আবৃত্তি করেন দূতাবাসের প্রথম সচিব দেওয়ান মাহমুদ। পাকিস্তানী বাহিনীর এই গণহত্যা যে একটি পরিকল্পিত গণহত্যাকান্ড ছিলো এবং বাঙালীদেরর পৃথিবীর বুক থেকে নির্মুলের ষঢ়যন্ত্র ছিলো-সেই দিকটি তথ্য-পরিসংখান ও ঘটনাপঞ্জীর সূত্রসহ উপস্থাপন করেন প্রথম সচিব আলাউদ্দিন ভুইয়াঁ। এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে গবেষণার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেন ঐ সময়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের বীভৎসতা ও এর নীলনক্সার কথা। সাবলীল উপস্থাপনার মাধ্যমে পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন দূতাবাসের প্রথম সচিব অপর্ণা রাণী পাল। সমন্বয়ে ছিলেন প্রথম সচিব আলাউদ্দিন ভুঁইয়া। আলোচনা অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম সচিব সাখাওয়াত হোসেন।
সভাপতির ভাষণে কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর হাইকমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পুরো জাতি যখন স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ হয়েছিলো, ঠিক তখনই ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ আমাদের উপর নেমে আসে পৃথিবীর ইতিহাসের নৃসংশতম ও বর্বরোচিত গণহত্যা, যা ঘটায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসরররা। ঐ রাতের ভয়াবহতার কথা বর্ণনা করে তিনি বলেন, শুধু ২৫শে মার্চ রাতেই নয়, পরবর্তী নয় মাস জুড়েই ‘৭১ সালে বাংলাদেশকে এক বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিলো তারা চালিয়েছিলো তাদের বীভৎসতার তান্ডবলীলা। বর্তমানে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ও সুযোগ্য নেতৃত্বে সেইসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ চলছে, অনেকেরই বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। আরও বেশ কিছু রায় ও বিচারকার্য প্রক্রিয়াধীন আছে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত “Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide” এ প্রদত্ত সংজ্ঞায় বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত হত্যাকান্ডগুলো সুস্পষ্টভাবে গণহত্যার আওতায় পড়ে, কেননা, এর উদ্দেশ্য ছিলো বাঙালী জাতিকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়। তাই জাতীয় পর্যায়ে এ দিবস পালনের সাথে সাথে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের স্বীকৃতি। তিনি বলেন, এই কানাডারই ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রবাসী বাঙালীদের দাবীর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের সক্রিয় উদ্যোগের ফলে আজ বিশ্বব্যাপী ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। সেটিকে তাদের জন্য উদাহরণ হিসেবে নিয়ে২৫শে মার্চকেও আন্তর্জাতিকভাবে “গণহত্যা দিবস” হিসেবে পালনের জন্য স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে জোর দাবী তোলার জন্য সেই কানাডা প্রবাসীদেরকেই তিনি পূনরায় আহবান জানান। তিনি বলেন, ৭১’এ বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য যারা দায়ী তাদের সকলের উপযুক্ত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তিনি গণহত্যা দিবসের অনুষ্ঠানে আসার এবং আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
এরপর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাতে নির্মম গণহত্যার শিকার শহীদদের এবং ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও ‘৭৫ এর কালরাতে শাহাদাত বরণকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর শহীদ পরিবারবর্গের সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনায় এবং দেশ পরিচালনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করে ফাতিহা পাঠ ও বিশেষ মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো: রফিকুল ইসলাম।
মন্তব্য করুন