কিংবদন্তী শিক্ষাবিদদের নীরব প্রস্থান

May 17, 2020,

সায়েক আহমদ॥ সারাবিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ লড়ছে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে। এর মধ্যেও বিদায় নিচ্ছেন বাংলাদেশের কিংবদন্তীরা। কিংবদন্তী সার্জনের মৃত্যুর ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিদায় নিলেন কিংবদন্তী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বাংলার আকাশে যে কয়টি তারা মিটমিট করে জ্বলছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই জাতীয় অধ্যাপক। তাঁর বিদায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হারালো আরেকজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের ছাত্রী ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শোকাহত হয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি স্যারের টিউটোরিয়াল গ্রুপের শিক্ষার্থী ছিলাম। তাঁর মতো বিদগ্ধ ও জ্ঞানী মানুষের মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।’

ড. আনিসুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরেই ফুসফুসে সংক্রমণসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন। এছাড়াও হৃদরোগ সমস্যার পাশাপাশি কিডনি জটিলতা, পারকিনসন্স, প্রোস্টেট সমস্যায়ও ভূগছিলেন। শেষ দিকে তার রক্তেও ইনফেকশন দেখা দিয়েছিল। এসব সমস্যা নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ২৭ এপ্রিল রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। গত ৯ মে পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পর পরিবারের ইচ্ছায় তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর ১৪ মে, বৃহস্পতিবার বিকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেন কিংবদন্তী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সিএমএইচের চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিবা ও শুচিতা এবং একমাত্র ছেলে আনন্দ জামানসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও গুণগ্রাহীকে শোকসাগরে নিমজ্জিত করে পরজগতে পাড়ি দেন।

বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে। বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক এটিএম মোয়াজ্জেম এবং সৈয়দা খাতুন দম্পতির এই সন্তানটি পারিবারিক পরিমন্ডলেই শিক্ষাজগতে পদার্পন করার প্রাথমিক পাঠ নেন মায়ের কাছ থেকেই। তাঁর মায়ের লেখালেখির অভ্যাস ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। তাঁর বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আনিসুজ্জামান ছিলেন চতুর্থ।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জীবনে তাঁর পিতামাতার অবদান অসামান্য। পিতার কাছ থেকে সময়ানুবর্তিতা এবং মায়ের কাছে থেকে তিনি সত্যবাদিতা শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আব্বার কাছ থেকে সময়ানুবর্তিতা শিখেছি, মায়ের কাছ থেকে সত্যপ্রিয়তা। আব্বা যে সময়ানুবর্তী হতে বলেছিলেন, তা নয়। কিন্তু ওঁর নিজের চলাফেরার মধ্যে এমন কাজ করার অভ্যাস ছিল যে সেটা আমাদের সামনে একটা দৃষ্টান্ত ছিল। ওঁর চলাফেরা দেখলে আমরা বুঝতে পারতাম, কটা বাজে। ফলে আমরাও চেষ্টা করেছি সময়মতো কাজ করতে। যত দিন আব্বার সঙ্গে থেকেছি, তত দিন দুপুর আর রাতের খাওয়া ওই নিয়ম বেঁধেই করেছি। মায়ের সত্যপ্রিয়তা কিছুটা তাঁর জীবনের উদাহরণ, কিছুটা তাঁর উপদেশও। তিনি চাইতেন, আমরা সব সময় সত্য কথা বলি। আমরা নিজেরা কোনো দোষ করে ফেললে সেটাও যেন স্বীকার করি। এ দিক থেকে বলব, মা আমাদের কাছে একটা উদাহরণ ছিলেন। অল্প বয়সে আব্বা আর মাকে যে জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেটা আব্বার কাছ থেকে কখনো শুনিনি। তবে মায়ের কাছে একাধিকবার শুনেছি।’

কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে আনিসুজ্জামানের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে তৃতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর ভারতবর্ষ বিভক্ত হল ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট। তখন আনিসুজ্জামানের পিতা বাংলাদেশে আসতে মোটেও রাজী ছিলেন না। কারণ, কলকাতা তাঁর নিজের শহর। ছেড়ে আসতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। ওদিকে আনিসুজ্জামানের মা-ই জোর করেছিলেন পাকিস্তানে আসার জন্য। শেষে স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে আনিসুজ্জামানের পিতা স্থির করলেন, কলকাতার কাছে খুলনায় যাবেন। কারণ খুলনা কলকাতা থেকে বেশি দূরেও নয়। পাকিস্তান যদি না টেকে, তাহলে কলকাতায় ফিরে আসাও সহজ হবে। এসব দুদোল্যমান অবস্থার মধ্যে অবশেষে দেশভাগের দুই মাস পর ১৯৪৭ সালের ১৫ অক্টোবরে আনিসুজ্জামানের পরিবার বাংলাদেশে চলে আসেন। আনিসুজ্জামান অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। খুলনায় তাঁরা ১৯৪৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। আনিসুজ্জামানের অন্য দুই বোন তখন ঢাকায় থাকায় থাকতেন। তাদের চাপাচাপিতে অবশেষে আনিসুজ্জামানের পরিবার ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে বর্তমান নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত তৎকালীন প্রিয়নাথ হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে এ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে।

১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন চলছিল তখন আনিসুজ্জামান ছিলেন ঐ কলেজেরই প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হলে যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ তোয়াহাকে ভার দেয়া হল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে একটা পুস্তিকা লিখে দেয়ার জন্য। তোয়াহা সাহেব ব্যস্ততার জন্য সময় পাচ্ছিলেন না। তখন অলি আহাদ আমাকে বললেন, আপনি লেখেন। আমি তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র, কী-ই বা জানি? বললাম, আমি কী লিখব? তিনি বললেন, আপনি যেভাবে পারেন লেখেন, আমি দেখে দেব। আমি জানতাম, পৃথিবীর একাধিক দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। পূর্ব বাংলার মানুষ টেলিগ্রাফ ফরমে, মানিঅর্ডার ফরমে, ডাকটিকিটে, কারেন্সি নোটে বাংলা না দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয়। এসব কথা মিলিয়ে লিখলাম। পাণ্ডুলিপি অলি আহাদ দেখে দিলেন। খুব একটা বদলাননি। যুবলীগ থেকে ‘ভাষা আন্দোলন: কী ও কেন’ নাম দিয়ে সেটা বের হলো। সেটাই ১৯৫২ সালে প্রকাশিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রথম পুস্তিকা। ওইটুকুই আমার গৌরব যে প্রথম পুস্তিকাটা আমিই লিখেছিলাম। পরে যখন তোয়াহা সাহেব লিখতে পারলেন না, তখন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ বদরুদ্দীন উমরকে দায়িত্ব দিলেন লেখার। উনি লিখেছিলেন। ওটা আমার চেয়ে বড় হয়েছিল, ভালোও হয়েছিল।’

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং কিংবদন্তী শিক্ষাবিদ মুনীর চৌধুরীর সান্নিধ্যে থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন সমৃদ্ধ হয়। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলা একাডেমির গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। একই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করেন এবং ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন। পরবর্তী সময়ে ভারত গিয়ে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবেও যোগ দেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবেও তিনি গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন।

তিনি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। শিল্পকলাবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা যামিনী এবং বাংলা মাসিকপত্র কালি ও কলম এর সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তাঁর গবেষণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ২০১২ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সভাপতি ছিলেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য এই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয়। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তিনি পদ্মভূষণ পদকটি গ্রহণ করেছিলেন।

সাহিত্যে অবদান রাখায় ২০১৫ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দুবার আনন্দবাজার পত্রিকার আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রী এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক পেয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যেও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), আমার একাত্তর (১৯৯৭), সাহিত্যে ও সমাজে (২০০০), পূর্বগামী (২০০১) ও কাল নিরবধি (২০০৩)।

স্বাধীন বাংলাদেশে যে কয়জন শিক্ষাবিদ উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করে নিরলস আলো জ্বালিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অন্যতম। বহুবিধ গুণের অধিকারী বাংলাদেশের এই জাতীয় অধ্যাপকের কীর্তি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধুমাত্র ভিজিটিং ফেলো নয় বরং বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্তি তাঁর বিশাল ব্যাপ্তির পরিচয় বহন করে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কিছুটা আত্মভোলাও ছিলেন। বর্তমান সময়ে আমরা কোয়ারেন্টিন শব্দটির সাথে যথেষ্ট পরিচিত হয়ে গেছি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কিন্তু ১৯৭৩ সালেই এই শব্দটির সাথে শুধু পরিচিতই নয় বরং ভুলোমনের কারণে অকারণে কোয়ারেন্টিনেও গিয়েছিলেন। ঘটনাটি হল ওয়ার্ল্ড পিস ওয়েভের কনফারেন্সে বুদাপেস্টে গিয়েছিলেন। প্রথমে তাকে মস্কো যেতে হয়েছিল। কনফারেন্স বসবে বুদাপেস্টে। মস্কোতে রাতে থেকে পরদিন দুপুরে আবার বিমান ধরবেন। ঐ সময়ে সেখানে তীব্র শীত। হোটেলে গিয়ে খেয়েই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে এয়ারপোর্ট যাবার জন্য তাঁর ডাক পড়লো। আনিসুজ্জামান অবাক হলেন। তাঁর বুদাপেস্টের বিমান ছাড়বে দুপুরে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখনই কেন যেতে হবে?’ কিন্তু যে তরুণীটি বার্তা নিয়ে এসেছিল সে মোটেও ইংরেজি জানে না। কাজেই সে সংক্ষেপে উত্তর দিল ‘নো ইংলিশ, এয়ারপোর্ট।’ কি আর করা! বাধ্য হয়ে তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে হোটেলের লাউঞ্জে এসে বসলেন আনিসুজ্জামান। সেখানে গিয়ে তাঁর হেলথ কার্ড খুঁজে পাচ্ছিলেন না। হেলথ কার্ডটা খুবই দরকার ছিল। কারণ তখন বিদেশ যেতে কয়েকটা ভ্যাকসিন শরীরে নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হতে হতো। হেলথ কার্ডে ভ্যাকসিনগুলো নেওয়া হয়েছে কি না, উল্লেখ থাকত। কাজেই হেলথ কার্ড না থাকলে ইমিগ্রেশন পার হওয়াই মুশকিল। ওদিকে বিমানবন্দরে যাওয়ার বাস ছেড়ে দিচ্ছে। আবার হেলথ কার্ডও পাচ্ছেন না। অস্থির ভঙ্গিতে দৌড়ে হোটেলের রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে আবার ঘরে গিয়ে খুঁজে দেখলেন। কিন্তু হেলথ কার্ড পাওয়া গেল না। ফিরে এসে বাসে উঠলেন। কিছুদূর গিয়ে বুঝতে পারলেন, হেলথ কার্ড খুঁজতে গিয়ে ওভারকোট ফেলে এসেছেন। ফিরে গিয়ে নিয়ে আসবেন, সে উপায়ও নেই। কারণ বাসের চালক ইংরেজি বুঝে না। নিরুপায় হয়ে হেলথ কার্ড ছাড়াই মস্কো থেকে বুদাপেস্ট এলেন। ইমিগ্রেশনে বললেন, ‘আমি মস্কোতে ঢোকার সময় হেলথ সার্টিফিকেট দেখিয়েছি। প্রয়োজন হলে তোমরা সেটার খোঁজ নাও।’ কিন্তু সবাই বলল এতে কাজ হবে না। ওদিকে তীব্র শীতে তিনি ওভারকোট ছাড়াই মস্কোতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এ কারণে সবাই কৌতুহল ভরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি মস্কোর শীতে কোট ছাড়া বাইরে পা দিলে কেমন করে?’ এরপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এল। আনিসুজ্জামানকে নিয়ে যাওয়া হল কোয়ারেন্টিনে। ছোট্ট একটি ঘর। ঘরের একটা দেয়াল কাচের। তাঁকে সে ঘরে ঢুকিয়ে তালা মেরে দেওয়া হলো। দুদিন আলাদা হয়ে থাকতে হবে। এরপর এক ভিয়েতনামি ডাক্তার এসে ইংরেজিতে বললেন, ‘তোমাকে আবার ইনজেকশন নিতে হবে। এতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। আর দুদিন বাদে তুমি ছাড়া পাবে।’ ভাগ্য ভালো পরদিন ডাক্তার এলেন। বললেন, ‘হোটেলের লাউঞ্জে তোমার ওভারকোট উদ্ধার করা হয়েছে। এর পকেটে হেলথ কার্ডও পাওয়া গেছে। ভালোই হয়েছে। তোমার দুটো সার্টিফিকেট হলো। আমাদেরটা কাল সকালে পাবে।’

আসল ঘটনা হচ্ছে ভুলোমনের কারণে মস্কো বিমানবন্দরে দেখিয়ে হেলথ কার্ড ওভারকোটের পকেটে রেখে দিয়েছিলেন। ওই পকেটে কিছু রাখেন না বলে পরে আর খোঁজ করেননি। এই কারণে অকারণ কোয়ারেন্টিন শেষে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে আনিসুজ্জামান চললেন বুদাপেস্টের আরামদায়ক হোটেলে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে হারিয়ে বাংলাদেশ হারালো কিংবদন্তী শিক্ষাবিদকে। তাঁর বহুবিধ গুণের কথা সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করা অসম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে জন্ম নেয়া এ মহামানব বাংলাদেশকে ভালবেসে তাঁর মমতাময়ী মায়ের আসনেই স্থান দিয়েছিলেন। তাইতো তাঁকে সক্রিয়ভাবে পাওয়া যায় ভাষা আন্দোলনে, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, স্বাধীনতা যুদ্ধে। বাংলাভাষায় তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য বর্তমান শিক্ষাবিদদের কাছে বিস্ময়ই হয়ে আছে। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মুনীর চৌধুরীর সান্নিধ্য তাঁকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এবং গড় আয়ুর হিসেবে ৮৩ বছর অনেক লম্বা সময়। তাঁকে হারানোটা জাতির জন্য ছিল সময়েরই ব্যাপার মাত্র। কিন্তু ভয়াবহ করোনা সংক্রমণের সময় দেশ যখন করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে, তখন তাঁর প্রস্থানটা নীরব প্রস্থানই বলা যায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে শিক্ষাবিদরা হারালো একজন অভিভাবককে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শোকবার্তা আমাদেরকেও এ বার্তা দিয়ে গেল যে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শূন্যতা জাতি অচিরেই অনুভব করবে।

[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক। ০১৭১২-৯৬২৩৯৩]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com