কিংবদন্তী সঙ্গীতজ্ঞের নীরব প্রস্থান
সায়েক আহমদ॥ করোনা মহামারীর এ দুঃসময়ে বাংলার আকাশে চলছে দুর্যোগের ঘনঘটা। জাতি হারিয়েই চলেছে একের পর এক শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে। বিদায় নিচ্ছেন বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তীরা। কিংবদন্তী সার্জনের মৃত্যুর ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিদায় নিলেন কিংবদন্তী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এর পর পরই আবার আরেক কিংবদন্তীর নীরব প্রস্থান। তিনি হচ্ছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য সংগীত পরিচালক জীবন্ত কিংবদন্তী সংগীত গুরু আজাদ রহমান। বিখ্যাত সুরকার, বাংলা খেয়ালের স্রষ্টা সেই গুণী সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান। গত ১৬.৫.২০২০ ইং শনিবার বিকেল সাড়ে চারটায় রাজধানীর শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৫ মে শুক্রবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু সকল চিকিৎসা ব্যর্থ করে পরদিন শনিবার করোনার ছোবলে দিশেহারা পৃথিবী হতে চির বিদায় নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান আজাদ রহমান। তিনি স্ত্রী এবং তিন মেয়ে রেখে গেছেন। জানা যায়, বেশ কয়েক দিন আগে আজাদ রহমানের একটা অপারেশন হয়েছিল। তবে তাঁর মধ্যে করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ ছিল না।
‘ভালবাসার মূল্য কতো সেতো আমি জানি না’ কিংবা ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’ এ গান দুটি আজাদ রহমানকে একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে অমর করে রেখেছে। এ দুটি গানসহ তাঁর কণ্ঠে অসংখ্য জনপ্রিয় গান যুগের পর যুগ শ্রোতাদেরকে মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক করেছে। বহুবিধ গুণের অধিকারী আজাদ রহমান একাধারে সুরকার, সংগীত পরিচালক, সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার, পরিচালক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন। তিনি ১৯৪৪ সালের পহেলা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খেয়ালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ফোক গান, কীর্তন, ধ্রুপদী সঙ্গীতের পাশাপাশি খেয়াল ও টপ্পার চর্চা করেন। এছাড়া ঠুমড়ি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, অতুল প্রসাদের গান, দিজেন্দ্র গীতি, রজনী কান্তের গানও তিনি চর্চা করেন। একই সময়ে তিনি একজন খ্রিস্টান পুরোহিতের কাছ থেকে পিয়ানো বাজানো শেখেন।
মাত্র ২০ বছর বয়সে কলকাতার জনপ্রিয় বাংলা ছবি ‘মিস প্রিয়ংবদা’র সংগীত পরিচালনা দিয়ে চলচ্চিত্রের গানে তার সম্পৃক্ততা ঘটে। এই ছবিতে তার সংগীত পরিচালনায় গান গেয়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আরতী মুখার্জি। সেটা ১৯৬৩ সালের কথা। কিন্তু ১৯৬৪ সালে কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর আজাদ রহমান বাংলাদেশে চলে আসেন। তখনকার রেডিও পাকিস্তানে গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি ছায়ানটে উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখাতে শুরু করেন।
১৯৭০ সালে গীতিকার নয়ীম গহর রচিত ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’-এর মত কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানেরও সুর করেছেন আজাদ রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণাদায়ী জাগরণী গানগুলির মধ্যে এই সঙ্গীতটি অন্যতম। এখনো এ গানগুলো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শ্রোতাদেরকে গুণমুগ্ধ করে রাখে।
বাংলাদেশে তিনি প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘আগন্তুক’ ছবিতে। এরপর বাদী থেকে বেগম, এপার ওপার, পাগলা রাজা, অনন্ত প্রেম, আমার সংসার, মায়ার সংসার, দস্যু বনহুর, ডুমুরের ফুল, মাসুদ রানা, রাতের পর দিনসহ প্রায় সাড়ে তিনশো ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী যুগের জনপ্রিয় অসংখ্য গানের সুরকার ও রচয়িতা তিনি। ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত’, ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই’, ‘মনেরও রঙে রাঙাব’, ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি’সহ অসংখ্য গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। এসব গানের কোনটির সুরকার তিনি, কোনটির সঙ্গীত পরিচালক। রাজ্জাক পরিচালিত ‘অনন্ত প্রেম’ ছায়াছবিতে ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই’ বিখ্যাত গানটি বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা এই গানে আজাদ রহমানের সুরে গেয়েছিলেন খুরশিদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিন।
আজাদ রহমান সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। পাশাপাশি তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও খেয়াল গানের চর্চা করতেন। তাকে বাংলাদেশের খেয়াল গানের জনকও বলা হয়। বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা সঙ্গীত বিষয়ক বই ‘বাংলা খেয়াল’। দেশের চলচ্চিত্রের গানে অবদানের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্যও ছিলেন। ১৯৭৭ সালে ‘যাদুর বাঁশি’ চলচ্চিত্রের জন্য এবং ১৯৯৩ সালে ‘চাঁদাবাজ’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ‘চাঁদাবাজ’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কিত প্রথম চলচ্চিত্র তিনিই নির্মাণ করেন। ছবিটির নাম ‘গোপন কথা’। ২০১৬ সালে সংস্কৃতি কেন্দ্র এই কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পীকে আজীবন সম্মননা পুরস্কার প্রদান করে।
‘ভালোবাসার মূল্য কত’, ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই’, ‘মনেরও রঙে রাঙাব’, ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান যতদিন শ্রোতাদেরকে মুগ্ধ করবে ততদিন পর্যন্ত অমর হয়ে থাকবেন কিংবদন্তী সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান। তাঁর আরেকটি পরিচয় না বললে লেখাটিই অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। তিনি কিন্তু বাংলা কাওয়ালি গানেরও স্রষ্টা। এ তথ্য অনেকেরই জানা নেই। বাংলায় কাওয়ালী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে তাঁর মাধ্যমেই। আজাদ রহমানের আরেকটি পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন খ্যাতিমান শিক্ষকও ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনাও করেছিলেন। তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকও ছিলেন। তাঁর সুন্দর বাচনভঙ্গি, হাসি মাখা মুখ, ভরাট কণ্ঠস্বর, মৃদুভাষী স্বভাব সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করে ফেলত। তাঁর চেহারাও ছিল যেন এক সুপুরুষ সাধু সজ্জন ব্যক্তির মত। মার্জিত পোষাকে তাঁকে দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত করতেন শ্রোতা-ভক্তরা।
বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতকে এক অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বিচিত্র গুণের অধিকারী কিংবদন্তী সঙ্গীতগুরু আজাদ রহমান। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর বাংলাদেশের দর্শক-শ্রোতারা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক জগতের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তান সৃষ্টি, ধর্মীয় উস্কানি ইত্যাদি কারণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা যে কয়েকজন কিংবদন্তীতুল্য মহামানব বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন আজাদ রহমান। ভারতীয় বাংলা গান থেকে দর্শক-শ্রোতাদেরকে বাংলাদেশি বাংলা গানের রাজ্যে নিয়ে আসার ভূমিকা যারা গ্রহণ করেছিলেন, তার অন্যতম পথিকৃৎ হচ্ছেন তিনি। তিনি দেশের মানুষকে এমন সুরের রাজ্যে নিয়ে গেছেন, কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এমন মেলোডিয়াস সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন যে শ্রোতারা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। ভারতীয় বাংলা গানে আগাগোড়া নিমজ্জিত বাংলাদেশী শ্রোতারা ফিরে এলেন দেশের সঙ্গীতসাম্রাজ্যে। অজস্র জনপ্রিয় সঙ্গীত একের পর এক সৃষ্টি হতে থাকল সৃষ্টিশীল এ আজন্ম শিল্পীর হাত ধরে। তাই তো আজ বাংলাদেশের সঙ্গীত জগত এত সমৃদ্ধ।
আজাদ রহমানের মৃত্যুতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগত বিশাল একটা ধাক্কা খেল। নিজ কর্মে একাগ্রচিত্তে নিমজ্জিত এমন গুণী শিল্পী বর্তমানে কয়জন জন্মগ্রহণ করছে? আজাদ রহমানের মহাপ্রয়াণে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গণ সেটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করবে।
কিংবদন্তী সঙ্গীতগুরু আজাদ রহমানের ক্ষেত্রেও এ কথা বলা যায় যে, বাংলাদেশের গড় আয়ু হিসেবে তিনি পরিণত বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে এ দুঃসময়ে আকস্মিকভাবে তাঁর চলে যাওয়াটা দেশের জন্য একটা বিশাল ক্ষতি। কতদিনে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে সেটা গবেষণার বিষয়। আমাদের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে, পরজগতে এ মহামানব যেন মহাশান্তিতে চিরনিদ্রা যাপন করেন।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক। ০১৭১২–৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন